ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর জাতীয় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী

দানবদের প্রতিহত করে শান্তি ফিরিয়ে আনব

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দানবদের প্রতিহত করে শান্তি ফিরিয়ে আনব

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাজীপুর, ১২ ফেব্রুয়ারি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গী ও সন্ত্রাসীর ঠাঁই নেই। দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বিএনপি-জামায়াত দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। যারা অকারণে সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারছে, তারা কি মানুষ না দানব? বিএনপি-জামায়াত জোট যা করছে তা জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। যারা জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে তারা দেশের শত্রু। আমরা এই দানবদের কোন ছাড় দেব না। দানবের কাছে মানুষ হারতে পারে না। আমরা দানবদের প্রতিহত করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনব। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব ইনশাআল্লাহ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করছি। সকলের সহযোগিতায় ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতামুক্ত ও প্রযুক্তি নির্ভর বাংলাদেশ গঠনের মাধ্যমে উন্নয়নের পথ ধরে সামনে এগিয়ে যাব। কোন বাধাই আমাদের রুখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা এদেশের ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার দায়িত্ব হাতে নিয়েছি। আর বিএনপি-জামায়াত দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পেট্রোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষ হত্যা করছে। মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। তারা ধর্মের কথা বলে। অথচ তারা বিশ্ব এজতেমা, মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর জন্ম-ওফাত দিবস মিলাদুন্নবীর দিনেও হরতাল অবরোধ দিয়েছে। ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর এসএসসি পরীক্ষা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোটি কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এরা বাংলাদেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়। তিনি আনসার ভিডিপি সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের সকলের মনে রাখা প্রয়োজন দেশের জনগণ সবার ওপরে। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনগণের জান-মালের হেফাজত করা পবিত্র দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে আপনারা সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাবেন, এ প্রত্যাশা করি। আমি আশা করি বিগত দিনের মতো আপনারা ভবিষ্যতেও উন্নয়নের যোগ্য অংশীদার হিসেবে দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হয়ে নিজ নিজ ভূমিকা রাখবেন। বৃহস্পতিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরে আনসার ভিডিপি একাডেমির ইয়াদ আলী প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৫তম জাতীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী যে নজিরবিহীন নাশকতা চালানো হয়, তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেলপথ রক্ষায় আনসার সদস্যদের মোতায়েনের পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক হ্রাস পেয়েছিল। দুঃখের বিষয় ২০১৫ সালের জানুয়ারি হতে বিএনপি-জামায়াত জোট আবারও একই কায়দায় পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে। রাজনীতির নামে বাস-রেলগাড়িতে হামলা করে তারা নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারছে। তাদের নৃশংস হামলায় এ পর্যন্ত প্রায় একশ’ মানুষ নিহত হয়েছে। কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়েছে। পেট্রোলবোমায় পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদে হাসপাতালগুলোর বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। পেট্রোলবোমায় যারা পুড়ছেন ও মারা যাচ্ছেন- তারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, বাস-ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে তাদের জীবনের কোন মূল্য নেই। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। বিদেশে আমাদের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ ৭ বছর পর সৌদি আরবে আবার আমাদের দেশ থেকে অত্যন্ত কম খরচে কর্মী নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। মালয়েশিয়ায় আমাদের কর্মীরা যাচ্ছেন। প্রায় ৮৫ লাখ বাংলাদেশী বিদেশে কাজ করছেন। দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ১১৯০ ডলার হয়েছে। আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দিচ্ছি। দ্রব্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল। মূল্যস্ফীতির হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে সফিপুর আনসার একাডেমিতে আসেন। পরে সেখানে সকাল ১০টার দিকে তিনি আনসার একাডেমির ইয়াদ আলী প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ নাজিম উদ্দীন তাকে স্বাগত জানান। পরে তিনি খোলা জিপে চড়ে প্যারেড পরিদর্শন করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার সদস্যদের কুচকাওয়াজ ও সালাম গ্রহণ করেন। আনসার বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আনসার বাহিনীর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আনসার বাহিনীকে জাতীয় পতাকা প্রদান করা হয়। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। তাই মহাসড়ক এবং রেলপথে নাশকতা ঠেকাতে আমরা পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবি’র পাশাপাশি আনসার বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করেছি। রেলপথে নাশকতা রোধে এক হাজার ৪১ পয়েন্টে ৮ হাজার ৩২৮ জন আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন সড়কেও পর্যায়ক্রমে ১২ জন করে ৯৯৩ পয়েন্টে আনসার সদস্যদের মোতায়েন করা হচ্ছে। পূর্বে চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে ব্যাটালিয়ন আনসারদের স্থায়ী করা হতো। তা হ্রাস করে পর্যায়ক্রমে ১২ ও ৯ বছর করা হয়েছে। চাকরি স্থায়ীকরণের এই মেয়াদ আরও কমানো যায় কি না আমরা তা পরীক্ষা করছি। ব্যাটালিয়ন আনসারদের মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাইমস্কেল, বিশেষ বিবেচনায় ২টি বার্ষিক বর্ধিত বেতন ছাড়াও রেশনভাতা ৫০ থেকে ৮০ টাকা উন্নীত করা হয়েছে। ব্যাটালিয়ন আনসারদের পারিবারিক রেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্তব্যরত অবস্থায় কোন সদস্য মৃত্যুবরণ করলে ৫ লাখ টাকা এবং গুরুতর আহত হলে ২ লাখ টাকার আর্থিক অনুদান প্রদানের নিয়ম চালু করা হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি নতুন ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পিসি/এপিসি সদস্যদের র‌্যাংক ও ব্যাজ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। ব্যাটালিয়নের সকল সদস্যদের হাতে উন্নতমানের অস্ত্র দেয়া হয়েছে। আনসার সদস্যরা এখন সেনাবাহিনী এবং সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। যারা অস্থায়ী তাদের কোন মহার্ঘভাতা প্রদানের বিধান ছিল না। আমরা অস্থায়ী ব্যাটালিয়ন আনসার, বিশেষ আনসার, হিল আনসার, অঙ্গীভূত আনসার সবার জন্য মহার্ঘভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেছি। গত বছর ৬৭২ জন মহিলা আনসার সদস্যকে স্থায়ী পদে পদায়ন করা হয়। মহিলা থানা প্রশিক্ষকদের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে। তাদের জীবনবীমার আওতায় আনা হয়েছে। এ অবস্থায় একজন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের সদস্যরা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আশা করা যায় চলমান কাজ বাস্তবায়িত হলে এ বাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা আরও সহজ হবে। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে প্রায় ৬০ লাখ সদস্য রয়েছে। এদের প্রায় অর্ধেকই নারী। নারীর ক্ষমতায়নে আনসার ও ভিডিপি বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা ইতোমধ্যে দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পে এ বাহিনীকে সম্পৃক্ত করেছি। আমরা আনসার সদস্যদের কল্যাণের জন্য আনসার ও ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। এটি আপনাদের নিজস্ব ব্যাংক। এ বাহিনীতে নিয়োজিত সকল মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ভূমিহীন হতদরিদ্র সদস্যগণ তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এ ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীরত্ব ও পেশাগত উৎকর্ষের জন্য ৭ ক্যাটাগরিতে ৯৭ জন আনসার ও ভিডিপি সদস্যকে পদক ও চেক প্রদান করেন। বক্তব্য শেষে তিনি বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৫তম জাতীয় সমাবেশের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সমাবেশ চলাকালে প্যারেড গ্রাউন্ডের দক্ষিণ পশ্চিম পার্শ্বে আনসার ও ভিডিপি’র ৬শ’ সদস্যা মনোজ্ঞ ডিসপ্লে প্রদর্শন করেন। সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনসার একাডেমির লেকের পাশে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন ও কুটির শিল্প পরিদর্শন করেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সেনা বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভুইয়া, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল মোঃ এনামুল বারী, নৌ বাহিনীর প্রধান ভাইস এ্যাডমিরাল এম ফরিদ হাবিব, স্ব^রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোঃ নাজিম উদ্দীন, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
×