ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা

কবি গালিবের গযলের দুটো পঙ্ক্তি হচ্ছে : ওহ্ ফুল ফুলহি নেহী জিস্্ ফুল্মে খুশ্্বু নেহী/ওহ্্ দীল্ দিল্হি নেহী জিস্্ দীলমে মুহব্বত নেহীÑ ঐ ফুল তো ফুলই না, যে ফুলে সুগন্ধি নেই। ঐ অন্তর তো অন্তরই না, যে অন্তরে ভালোবাসা নেই। মূলত ভালোবাসা বা মুহব্বতের চূড়ান্ত সৌরভ-সৌরভী নিহিত রয়েছে আরবী ‘ইশ্্ক শব্দের মধ্যে।’ কুরআন মজীদে ইশ্্ক শব্দের উল্লেখ নেই, তবে আরবী সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকেই এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ভালোবাসা, মুহব্বত, প্রীতি, বন্ধুত্ব ইত্যাদি অর্থবোধক শব্দের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে। আরবী হুব্ব শব্দের অর্থও ভালোবাসা। হুব্্বুল ওয়াতনি মিনাল ঈমান-দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ এই বিখ্যাত উক্তিটি সর্বজনবিদিত। ভালোবাসার নানামাত্রিক রূপ ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আল্লাহ্্ জাল্লাহ শানুহু কাদের ভালোবাসেন তাঁর উল্লেখও যেমন কুরআন মজীদে রয়েছে এবং তিনি কাদের ভালোবাসেন না তারও উল্লেখ কুরআন মজীদে রয়েছে। আল্লাহ্্ কাদেরকে ভালোবাসেন সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া আন্ইফকু ফী সাবীলিল্লাহি ওয়ালা তুল্্কু বিয়াইদীকুম্্ ইউহিব্বুল মুহ্সিনীন- তোমরা আল্লাহ্র পথে ব্যয় (দান) কর এবং নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না। তোমরা পরোপকার করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্্ পরোপকারীদের ভালোবাসেন (সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৫)। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী ও মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল, আল্লাহ্্ ইহসান করণেওয়ালাদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৩৪), ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুক্সিতীনÑ নিশ্চয়ই আল্লাহ্্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৪২), ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুত্তাকীনÑ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুত্তাকীনগণকে ভালোবাসেন (সূরা তওবা : আয়াত ৪), ওয়াল্লাহু ইউহিব্বুল মুত্তহিরীনÑ আর আল্লাহ্্ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন। (সূরা তওবা : আয়াত ১০৮)। আল্লাহ্ জাল্লাহ শানুহু যাদেরকে অপছন্দ করেন বা ভালোবাসেন না তাদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তার শরিক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন এতিম অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ভালোবাসেন না দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে। (সূরা নিসা : আয়াত ৩৬)। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসভঙ্গকারী পাপীকে ভালোবাসেন না। (সূরা নিসা : আয়াত ১০৭), আল্লাহ্ সন্ত্রাসীদেরকে ভালোবাসেন না। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৬৪), নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৮৭), নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ্) অপচয়কারীদের (মুস্রিফীন) ভালোবাসেন না। (সূরা আন’আম : আয়াত ১৪১), তিনি (আল্লাহ্) যালিমদের ভালোবাসেন না। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ৫৫), নিশ্চয়ই তিনি অহঙ্কারীদের (মুস্্তাক্বিরীন) ভালোবাসেন না। (সূরা নহল : আয়াত ২৩), আল্লাহ্ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান কর এবং দুনিয়া থেকে তোমার নিস্যা ভুলে যেও না। তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ্ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেও না। আল্লাহ্ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ভালোবাসেন না। (সূরা কাসাস : আয়াত ৭৭), আল্লাহ্্ ভালোবাসেন না। উর্ধতা ও অহঙ্কারীদেরকে। (সূরা হাদীদ : আয়াত ২৩)। আল্লাহ্র ভালোবাসা পেতে হলে রসূলের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু নিজেই। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : কুল্্ ইন্্কুন্্তুম্্ তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্্তাবিউনি ইউহ্বিব্ কুমুল্লাহু ওয়া ইয়ার্গ্ফ্ লিাকুম্্ যুনূবাকুমÑ (হে রসূল) আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসো তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ্্ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ মাফ করে দেবেন (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৩১)। এই আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, নবীপ্রেম ছাড়া আল্লাহ্্র ভালোবাসা লাভ করা সম্ভব না। কুরআন মজীদে ভালোবাসার বিবরণ লক্ষ্য করা যায়। হযরত ইউসুফ আলায়হিস্্ সাল্লাম আল্লাহ্র নবী ছিলেন। তাঁকে বাল্যকালে তাঁর সৎ ভাইয়েরা একটি কূপের মধ্যে ফেলে দেয়। সেখান থেকে একদল বণিক তাঁকে উদ্ধার করে মিসরের বাজারে বিক্রি করে দেয়। মিসরের যে ব্যক্তি কিশোর ইউসুফকে কিনে নেন তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরাক্রমশালী, তিনি ’আযীখ মিসর নামে পরিচিত ছিলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে এবং এভাবে আমি (আল্লাহ্্) ইউসুফকে সেই দেশে (মিসরে) প্রতিষ্ঠিত করলাম (সূরা ইউসুফ : আয়াত ২১)। সে (ইউসুফ) যখন পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলো তখন আমি তাঁকে হিকমত ও ইল্্ম দান করলাম (সূরা ইউসুফ : আয়াত ২২)। সে (ইউসুফ আ.) যে স্ত্রীলোকের (আযীয) পতœী যার নাম জোলেখা বলে জানা যায়। গৃহে ছিল সে (জোলেখা) তা হতে অসৎ কর্ম কামনা করল এবং দরজাগুলো বন্ধ করে দিল ও বলল এসো। সে (ইউসুফ) বলল : আমি আল্লাহ্র শরণ নিচ্ছি (মা’আযাল্লাহি)। তিনি আমার রব্, তিনি আমার থাকবার সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। নিশ্চয়ই সীমা লঙ্ঘনকারীরা সফলকাম হয় না। সেই রমনী (জোলেখা) তো তাঁর (ইউসুফের) প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং সেও তাঁর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তাঁর রবের নিদর্শন আল্লাহ্ প্রদত্ত বিবেক প্রত্যক্ষ করত। আমি (আল্লাহ্্) তাকে (ইউসুফকে) কুকর্ম ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখবার জন্য এভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। সে (ইউসুফ) তো ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত (সূরা ইউসুফ : আয়াত ২৩-২৪)। কুরআন মজীদে হযরত ইউসুফ (আ.) এর আব্বা হযরত ইয়াকুব আলায়হিস সাল্লামের পুত্রের প্রতি ভালোবাসার কথাও উল্লিখিত আছে। পিতাপুত্রের ভালোবাসার সে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ভালোবাসা আছে বলেই মানবিক মূল্যবোধ আজও টিকে আছে। ভালোবাসা আল্লাহ্্র খাস্ নি’আমত। এই ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সৃষ্টি রহস্য। হৃদয়ের টানে সঞ্চারিত হয় ভালোবাসা। ভালাবাসা চিরন্তন, শাশ্বত। হাদীস শরীফে আছে যে, যখন আল্লাহ্্ কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি জিব্্রাঈলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ভালোবাসি। তুমিও অমুককে ভালোবাস। জিব্্রাঈল তাকে ভালোবাসে এবং আসমানে ঘোষণা করে, আল্লাহ্ অমুককে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাস। আসমানের বাসিন্দাগণ তাকে ভালোবাসতে থাকে এবং তাঁর দু’আ পৃথিবীতে কবুল হতে থাকে। (মুসলিম শরীফ)। এরাই ওলী আল্লাহ্। এঁদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চিত জানবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্র ওলীগণের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে যেন তাকে ভালোবাসার কথা জানায় (তিরমিযী শরীফ)। হাদীস শরীফে আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে পর্যন্ত আমাকে তোমরা তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর চেয়ে অধিকতর ভালো না বাসো সে পর্যন্ত তোমরা পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ) । এ কথা শুনে হযরত উমর রাদিআল্লাহ্্ তা’আলা আন্্হু বললেন, হে আল্লাহর রসূল আমার সন্তান-সন্ততি সকল আপনজন থেকে আপনাকে আমি ভালোবাসি, কিন্তু আমার মনে হয়, আমার প্রাণ অধিকতর প্রিয়। প্রিয়নবী (সা.) তাঁর পবিত্র হাত হযরত উমর (রাদি.)-এর বুকে স্পর্শ করলেন। হযরত উমর (রাদি.) তখন বলে উঠলেন, হে আল্লাহ্র রসূল। আপনি আমার নিকট আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়। ইলমে তাসাওউফ ইশ্কের গুরুত্ব অপরিসীম। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্্তী রহমাতুল্লাহি ‘আলায়হির কাব্য কর্ম দীউয়ানে মুঈনুদ্দীন চিশতী সমগ্রটা জুড়ে ইশ্কের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, আয় নূরে ইশ্কাত তাফ্তে আন্দার সোবেদায়ে দেলমÑ তোমার ইশ্কের জ্যোতি প্রজ্বলিত আমার এই আঁধার অন্তরে। তিনি অন্য এক গযলে বলেন : ইশ্্ক আয্্লা মাকান নোযুল কোনাদ/র্দ্ দেলে আশেকান নোযূল কোনাদ ইশ্কের অবতরণ ঘটে লা মাকান থেকে/আশেকদের অন্তরে তা করে অবতরণ।... তিনি আরও বলেন, যা বাহুরে ইশ্ক য়্যাক কত্রে যোহূরে সেরবে মনসূবাস্্ত-ইশ্কের সাগর থেকে মাত্র এক কাতরা মনসূর রহস্য করল বিভাসিত।... আমরা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাতেও প্রচুর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটতে দেখি। আল্লাহ প্রেম তাঁর কাব্য কর্মে বিভাসিত হয়েছে এইভাবে : খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে/ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে/... কয়েস যেমন লায়লী লাগি, লভিল মজনু খেতাব/যেমন ফরহাদ শরীর প্রেম হলো দীওয়ানা বেতাব্/বেখুদীতে মশগুল আমি তেমনি মোর খোদার তরে।... ভালোবাসার প্রকৃত সৌরভ আল্লাহ্র ভালোবাসা ও নবী প্রেমে বিকশিত হয়। তাসাওউফে যে ফানাফিশ্্ শায়খ, ফানাফির রসূল, ফানাফিল্লাহ্্র কথা বলা হয়েছে তাতে ভালোবাসার স্বরূপ প্রতিফলিত হয়। খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্্তী (রহ.) বলেন : যদি তুমি ইশ্কের রহস্য পাঠ করতে চাও/তাহলে জেনে নাওÑ তা শুধু পাঠ করা যায় হৃদয় ফলকে। ভালোবাসার প্রকৃত আবেদন পবিত্রতার মধ্যে নিহিত। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×