ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা দেখিয়ে যোগ করা হচ্ছে এনজিওদের

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা দেখিয়ে যোগ করা হচ্ছে এনজিওদের

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ প্রকল্প বাস্তবায়নে দাতাদের এনজিও প্রীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারী বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ইদানিং এনজিওদের দিকে ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক সমীক্ষার সুপারিশেও বিষয়টি উঠে এসেছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) মনে করে বিষয়টি উদ্বেগজনক। কেননা সরকারকে পাশ কাটিয়ে এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রবণতাকে সমর্থন করা যায় না। এটি আর্থিক শৃঙ্খলার ব্যত্যয়। এতে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, দাতাদের এনজিও প্রীতির বিষয়ে আমরাও কিছুটা দায়ি। আমাদের সরকারী সিস্টেমে যেতে গেলে অনেক সময় কার্যক্রম সেøা হয়। ফলে দাতারা হতাশ হয়ে এনজিওর দিকে যায়। অন্যদিকে এনজিওদের জবাবদিহিতা কম, ফলে তারা দ্রুত অনেক কাজ করতে পারে। তাছাড়া কোন কোন কাজ আছে যেগুলো এনজিওরা ভাল করে। প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে বিদ্যুত নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, এমন এলাকায় সরকারী কর্মকর্তারা কাজ করতে চায় না। এনজিওরা ওইসব এলাকায় লোক নিয়োগ দেয়, ধরে রাখে, যেমন টিকা ও পুষ্টিসহ ইত্যাদি কাজ। তবে যদি দেখা যায় এনজিও মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রবণতা বাড়ছে তাহলে মানা যায় না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন,পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু কিছু উন্নয়ন সহযোগী প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং জটিলতার যুক্তি দেখিয়ে সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাদ দিয়ে তাদের নিজস্ব এজেন্ট এবং এনজিওর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী। ইতোমধ্যেই এমন বেশকিছু নিদর্শনও দেখা গেছে। এ অবস্থায় সুপারিশ দেয়া হয়েছে যে, বিষয়টি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অতিসত্বর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া উন্নয়ন সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর অনুমোদন ত্বরান্বিত করা উচিত। এ বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মানুষ কন্ট্রাকটরকে দিয়ে তাদের কাজ করায়, এর কারণ হচ্ছে, ওই কন্ট্রাকটরের অভিজ্ঞতা আছে এবং দক্ষতা আছে। ঠিক তেমনি বিশেষ করে রুট লেভেলে যেসব এনজিও কাজ করে মাঠ পর্যায়ে তাদের ডেলিভারি সিস্টেম আছে, মাঠ পর্যায়ে উপস্থিতি আছে, তারা লোকাল কন্ডিশনের সঙ্গে পরিচিত তাই কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো এনজিদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করলে ভাল হয়। কেননা তারা জানে ওই এলাকায় কি ধরনের রোগ হয়, কি ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন। দাতারা নিজেদের ইচ্ছেমতো এনজিও নিয়োগ দিয়ে থাকে এরকম এক প্রশ্নের ড. জাহিদ বলেন, বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মতো দাতারা সাধারণত নিজেরাই এনজিও নিয়োগ দেয় না। কেননা আমরা তো সরকারে ঋণ দেই, তাই সরকার কাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করাবে সেটি সরকারের ব্যাপার। ঋণের টাকা সরকারকেই পরিশোধ করতে হবে। তবে আমাদের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়। এটা ক্রয়সহ বিভিন্ন ধাপেই নিতে হয়। সূত্র জানায়, ২০১২ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দেয়া অনুদানের প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। এ টাকা এনজিওদের পেটে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। কেননা আর্থিক শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এনজিওর মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তাছাড়া অনুমোদনের আগেই দাতা সংস্থার খেয়াল খুশি মতো নিয়োগ দেয়া হয়েছিল বাস্তবায়নকারী হিসেবে একটি এনজিও। এনজিওটি আবার নিয়োগ করার কথা আরও ৭টি এনজিওকে। এ পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভায় এটি অনুমোদন না দেয়ার সুপারিশ হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়ার সুপারিশের জন্য বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা ডাকা হলেও সভায় উপস্থিত অধিকাংশ সদস্যের বিরোধিতার কারণে শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত রাখা হয়েছিল। স্থগিত রাখার কারণ হিসেবে জানা গেছে, অনুমোদনের আগেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের পছন্দ মতো এনজিও নিয়োগ দেয়ায় অনুদানের এ টাকার সঠিক ব্যবহার না হওয়ার শঙ্কা করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। ইনস্টিটিউশনাল সাপোর্ট ফর মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কাস রেমিটেন্স শীর্ষক কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) মোট ১৪ কোটি ৮৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা অনুদান অনুমোদন করে। এ বিষয়ে ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি সরকারের সঙ্গে একটি অনুদান চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় প্রকল্পটির অনুমোদন নিয়ে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর ২০১২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশন মতামত দেয় যে, প্রকল্পটি এডিবির অনুদানে জানুয়ারি ২০১২ হতে ডিসেম্বর ২০১৪ মেয়াদে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপির (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) ৫নং অনুচ্ছেদে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেখানো হলেও টিপিপির (টেকনিক্যাল প্রজেক্ট প্রপোজাল) ২১ দশমিক ৩নং অনুচ্ছেদে দেখা যায় বাস্তবায়নকারীর সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব অল্টারনেটিভ ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (ইনাফি) নামে একটি এনজিও। টিপিপির (টেকনিক্যাল প্রজেক্ট প্রপোজাল) ৩০ পৃষ্ঠায় দেখা যায়, ইনাফি এ প্রকল্পের কার্যপত্রের ১০নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করবে। প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত (কার্যপত্রের ১০নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত) কাজগুলোই এ প্রকল্পের মূলকাজ, যা ইনাফি নামক এনজিওটি সম্পাদন করবে। সরকারের প্রচলিত নিয়মে শতভাগ অর্থায়নে এনজিওকে সহায়তা প্রদান কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রকল্প বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা আদৌ যৌক্তিক হবে না। কার্যক্রমগুলো এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের অর্থনৈতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এনজিও বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বা রাখছে। এটি স্বীকার করতেই হবে। অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, এক্ষেত্রে আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে। সেই সঙ্গে শুধুমাত্র বৈদেশিক সহায়তার প্রকল্পের জন্য মনিটরিং টাস্ক ফোর্স গঠন করা যেতে পারে। পাশাপাশি সরকার ও এনজিও এর মধ্যে গ্যাপ কমানো উচিত। এনজিও ব্যুরোকে শক্তিশালী করে এনজিওদের কার্যক্রমে তদারকি বাড়ানো দরকার।
×