ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির ওয়াটার লু ॥ কেজরিওয়ালের বসন্ত

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মোদির ওয়াটার লু ॥ কেজরিওয়ালের বসন্ত

মাত্র আট মাস। লোকসভা নির্বাচনের পর খোদ রাজধানী দিল্লীতেই পায়ের তলার মাটি সরে গেল বিজেপির। কাজ হলো না মোদি ম্যাজিকে। ব্যর্থ আরএসএসের ‘লৌহদৃঢ়’ সংগঠনও। এক বছর ধরে ঝুলে থাকা দিল্লী বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বাজিমাত করে দিলেন কেজরিওয়াল ও তাঁর আম আদমি পার্টি (আপ)। রাজনীতিতে পা রাখা মাত্র আড়াই বছরের একটা দল যাকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এর আগে ২০১৩ সালের বিধানসভা ভোটে কোন গুরুত্ব দিতে চাননি, হাস্যকৌতুকও করেছিলেন কেউ কেউ অথচ দিল্লীর ‘আম আদমি’রা তখনও অলক্ষ্যে হেসেছিলেন আর এবার তো সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পার করে প্রায় পুরো বিধানসভাই দিয়ে দিলেন আপকে। ৪৬ বছরের টগবগে, উদ্যেমী অরবিন্দ কেজরিওয়াল পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তারপর ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে যোগ দিয়ে আয়কর দফতরের কমিশনার। ২০০১ সালে চাকরি করতে করতেই ‘পরিবর্তন’ নামে এনজিও গঠন করেন। ২০০৬ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর সমাজকর্মী। ২০১১ সালের আন্না হাজারের লোকপাল আন্দোলন থেকে বিপুল পরিচিতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই রাজনৈতিকভাবে করতে হয় আর সে জন্য তিনি ও তাঁর সহযোগীরা মিলে ২০১২ সালে গঠন করেন ‘আম আদমি পার্টি’। বিগত দু’বছরে দিল্লীর যে কোন সমস্যায় লড়াইয়ে প্রতিবাদে ‘আপ’-এর আপোসহীন নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখেছে দিল্লীবাসী। সে দামিনী ধর্ষণ হত্যার সময় সারারাত জনপথে থেকেই হোক কিংবা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদই হোক। আম আদমির পাশে এখন দিল্লীর শিক্ষিত যুবসমাজ, দিল্লীর অটোরিক্সা চালকরা, গরিব বস্তির দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক-মজুররা। হ্যাঁ, সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরিব এই শ্রেণীদের নিয়ে তাদের লড়াইটা রাস্তায় নেমে করেছে আপ। করেছে প্রতিটি মহল্লাতে প্রত্যেকের বাড়িতে টোকা দিয়ে। দেশের প্রধান দল যখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে কোন পাত্তা দিতে চায়নি আম আদমি-কে, আপ কিন্তু তখন হয় যন্তরমন্তরে কিংবা এইমসের সামনে রাস্তাজুড়ে প্রতিবাদে। অরবিন্দ ঘুরছেন বস্তিতে বস্তিতে যেখানে বাড়তি বিদ্যুত বিল মেটাতে না পারার জন্য গরিব মানুষের বিদ্যুত সংযোগই কেটে দিয়ে গেছে বেসরকারী মুনাফাখোর বিদ্যুত কোম্পানি। কেজরিওয়াল সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ছোটবড় সমস্যাগুলো নিয়ে সোচ্চার। আপ জোর দিয়েছে ডিটেলিংয়েÑ তারা কোন ‘শর্টকাট’ রাস্তায় হাঁটেনিÑ যেটা যে কোন সাফল্যের অন্যতম প্রধান এবং পূর্বশর্ত। আমজনতা তাই ভোট দিয়েছে আম আদমিকেই। ৭০ বিধানসভা আসনের মধ্যে কেজরিওয়াল ঝড়ে বেসামাল হয়ে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৩ আসন আর কেজরিওয়ালের আপ ৬৭। এবারের নির্বাচনে শতাংশ হিসেবে আম আদমি পেয়েছে ৫৫ শতাংশ, বিজেপি ৩২ শতাংশ আর কংগ্রেসের তথৈবচ অবস্থা। আম আদমির কাছে বিজেপি শুধু পরাজিত হয়নি, রীতিমতো গো-হারা হেরেছে। খোদ রাজধানী দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি তথা তাদের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রীর ব্যর্থতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটা জিনিস স্পষ্ট করে দিচ্ছেÑ দেশের জনগণ সবসময় পছন্দ করে স্বচ্ছ বিকল্প। এর আগে মাত্র ৪৯ দিনের আপ সরকার ৩টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল। বিদ্যুতের দাম অর্ধেক। জল সরবরাহ দ্বিগুণ এবং পুলিশের সবরকম তোলাবাজি বন্ধ। কেজরিওয়াল দেখিয়ে গিয়েছিলেন সদিচ্ছা থাকলে কাজ করা যায়। আর কোন নেতা কাজের কাজ করলে দেশের মানুষও তাঁর সঙ্গে সায় দেয় এবং পরে প্রতিদানের সময় এলে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করে। এবারের ভোটে শাহী দিল্লী সেটা দেখিয়ে দিল। বস্তুত দু’দিন আগেও বিভিন্ন মিডিয়ার তৈরি ‘মোদি ঝড়’ আজ দিল্লীতে ‘আপ ঝড়ে’ বেসামাল। দিল্লীতে অন্তত কেজরিওয়ালের জনপ্রিয়তার কাছে মোদি চূড়ান্ত ব্যাকফুটে এবং সম্পূর্ণ পরাজিত। সোশ্যাল সাইটগুলো থেকে শুরু করে মিডিয়া সব জায়গাতেই এখন লাইমলাইটে দিল্লীর ‘জনতা কা সিএম’। সরকারের কাছে দিল্লীর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা সস্তায় বিদ্যুত, জলের ব্যবস্থা, কম দামে খাদ্য। মোদি সরকার দেশের ক্ষমতায় এসে যেভাবে ভর্তুকি ছাঁটাই এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গুটিয়ে ফেলার কাজে নেমেছে, তাতে প্রমাদ গুনেছেন দিল্লীর সাধারণ মানুষ। তাঁরা বুঝেছেন এই দল যদি দিল্লী রাজ্যেও ক্ষমতায় আসে তাহলে তাদের দুঃসময়ের অন্ত থাকবে না। আর এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে কেজরিওয়ালের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার, দলকে ঠিক করতে হলে প্রয়োজন তার দলের অর্থনৈতিক নীতি ঠিক করার। কারণ তাদের প্রধান লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাই ঠিক করতে হবে তারা কোন্্দিকে হাঁটতে চায় উগ্র বেসরকারীকরণ নাকি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ অভিমুখী অর্থনীতিতে। সমগ্র বিশ্ব আজ এই কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থে রচিত মুক্তবাণিজ্য অর্থনীতির ইঙ্গ-মার্কিন সূত্রে আক্রান্ত, যার ফলস্বরূপ আকাশছোঁয়া দুর্নীতি, লাগামছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, চাকরিতে অস্থায়িত্ব। সাধারণ মানুষ তাই আজ দিশেহারা। সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণে বলা যায়, সার্বিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি যে অরাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, দিল্লীতে নাগরিক সমাজ থেকে উঠে আসা নতুন দল আম আদমি পার্টি সেই পরিস্থিতিকে এক নতুন রূপ দিয়েছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে আপের কর্মীরা নিঃশব্দে মহল্লায় মহল্লায় দিনরাত পড়ে থেকে সংগঠনকে কিভাবে আরও জনপ্রিয় ও সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া যায় সেই কাজ করে গেছেন আর বিজেপি সে সময় ব্যস্ত ছিল বিজয় উৎসবে। আপের পূর্ববর্তী মাত্র ৪৯ দিনের সরকার অল্পদিনে পুলিশী জুলুম বন্ধ করতে পেরেছিল। তার ফলে নিম্নবিত্ত ও গরিবরা এই নির্বাচনের আগে থেকে ছিল আপপন্থী। বস্তুত এ উপমহাদেশের যে কোন দেশে বা প্রদেশের ভোটে জয়ী দল সে-ই হয়, যার বাক্সে গরিব মানুষের ভোট পড়ে। এছাড়া দিল্লীর বিধানসভার ভোট করতে অনেক দেরি করে ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। মামলা শেষ অবধি গড়ায় কোর্টে। আসলে বিজেপি কোনদিন আত্মবিশ্বাসী ছিল না, না হলে লোকসভার ভোটের পরপর দিল্লী বিধানসভা ভোট করে ফেললে মোদি হাওয়াতে কিছুটা ভাল ফল হলেও হতে পারত। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাসটা বিজেপির কোনদিন তৈরি হয়নি দিল্লীতে, উপরন্তু তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে দলের গোষ্ঠীকোন্দল, কম করে ৪ জন মুখ্যমন্ত্রী পদের মুখের দাবিদার হিসেবে ছিলেন আর তাদের বাদ দিয়ে হঠাৎ সাবেক আইপিএস কিরণ বেদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদে প্রজেক্ট করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা করে আরও ফ্যাসাদে পড়ে গেল বিজেপি। মানুষের কাছে শাসক দলের কোন চমকই কাজে দিল না। আসলে মানুষ চায় মাটির কাছাকাছি স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ, কেজরিওয়াল সেক্ষেত্রে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবসময় দিল্লীর আমজনতার প্রথম পছন্দের মানুষ। ভোটদাতারা বা সাধারণ মানুষ এখন অতীতের নোংরা রাজনীতির খেলা বরদাস্ত করছে না। আগে যা হতো বা যেভাবে নির্বাচন হতো, সেই সব এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে। ভোট টানতে নোংরা পদ্ধতিগুলোর দিকে মানুষের রাগী দৃষ্টি ক্রমে বাড়ছে। তাঁরা সব কিছুই লক্ষ্য রাখছেন। সব চেয়ে বড় কথা, রাজনীতিবিদদের নোংরামি নিয়ে মানুষ এখন কথা বলছেন এবং শাস্তি দেয়ার বিষয়েও মনস্থির করে ফেলছেন আর দিয়েও দিচ্ছেন ভোটযন্ত্রে। ২০১৩ সালে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৩ শতাংশ ভোট, গত ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে সেটা বেড়ে হয় ৪৬ শতাংশ, এই ১৩ শতাংশ বাড়তি সমর্থন এবার বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি, কারণ মোদির ওপর মানুষের বিপুল প্রত্যাশা ছিল অথচ বিগত ৯ মাসে সরকারের কাজকর্মে সেই প্রত্যাশার ফানুস অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। আবার দিল্লীতে একদিকে বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর অন্যদিকে কেজরিওয়াল বার্তা দিয়েছেন তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। সবসময় হাসিমুখে থেকেছেন, আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। প্রতিদিন ৩-৪টি করে জনসভা করেছেন। ভিড় উপচে পড়েছে সেগুলোতে। ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে যাননি, নীতির সঙ্গে কৌশলের অভূতপূর্ব সামঞ্জস্য ঘটিয়ে নিজের পক্ষে ঝড় তুলে দিয়েছেন ‘মাফলার ম্যান’। কেজরি শুধু গরিবের নন, এবারের ফলাফলে বোঝা গেছে তিনি সমাজের সব পেশার মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন, আসলে মানুষ চায় দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ সমাজ, যার মূল ভিত্তি একটা স্বচ্ছ প্রশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা। আর সবকিছুর উর্ধে এ পরাজয় মোদির। শেষ ৯ মাসে মোদিকে দেখা গেছে দেশকে সাফসুতরো করার। ‘হাই টেক’ সিটি বানানোর; কিন্তু দেশে সাফ তো দূরের কথা, উল্টো তার দশ লাখ মূল্যের সোনার জরি দিয়ে বোনা কোটের গল্প ও ছবি এখন ফেসবুক, টুইটার, খবরের কাগজের পাতায়। দেশের গরিব মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না ‘সেলফি’ কি জিনিস; আর মধ্যবিত্তরাও প্রথম প্রথম ঘোরে থাকলেও এখন বুঝে উঠতে পারছেন না বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নিত্যনিয়মিত চায়ের বৈঠকে সাধারণ মানুষের কী উপকার হচ্ছে! আর যাই হোক, দিল্লীর গরিব মানুষ অন্তত বুঝে গেছেন গরিবের প্রধানমন্ত্রী মোদি নন। তাই বেশি দিন সময় লাগেনি মাত্র আট মাসের মাথায় ১৪ শতাংশ ভোট হারাল বিজেপি। এ অবস্থায় যে অস্বস্তিকর প্রশ্ন বিজেপিকে ভাবাচ্ছে সেটা হলো- এ বছর আর আগামী বছর মিলিয়ে বিহার, কেরালা, তামিলনাড়ু, অসম, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ প্রধান রাজ্যগুলোতে বিধানসভার ভোট। দিল্লীর হারের প্রভাব অবশ্যই এতে পড়বে, কারণ দিল্লীর মানুষই প্রথম দেখিয়ে দিলেন মোদি ও তাঁর জেনারেল অমিত শাহ অপরাজেয় নন। দিল্লীর বাজারে আজ ‘ঝাড়ুর’ দাম উঠেছে ২০০ টাকা। দেদার বিকোচ্ছেও। দিল্লীর আম আদমির এখন উৎসবের দিন। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক
×