ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অভিমত

শহীদ মিনার যেমন চাই একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই শহীদ মিনার সাজানো হয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়, নিরাপদ রাখা হয়। তারপর শহীদ মিনার গোটা বছর থাকে অরক্ষিত। ময়লা, আবর্জনা, পথশিশুদের আনাগোনা, গরু-ছাগল ও কুকুরের বিচরণ। যে মিনারটির সঙ্গে আমাদের ভাষা এবং ভাষা শহীদদের সম্পর্ক সেটা কেন অরক্ষিত থাকবে, বিশৃঙ্খলা ও আবর্জনাযুক্ত থাকবে তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। শহীদ মিনার যে নক্সা অনুসারে তৈরি করার কথা ছিল সেভাবেই তৈরি করলে তা হয়ে উঠতে পারে দেশের একটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী। আমরা জানি আমাদের শহীদ মিনারের নক্সা করেছিলেন শিল্পী হামিদুর রাহমান। সেই নক্সাটি ছিল ঠিক এই ধরনের। শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলোতে এখন যে লোহার শিক দেয়া হয়েছে তা শিল্পী হামিদুর রাহমানের মূল পরিকল্পনায় ছিল না। শিল্পীর নক্সার পরিকল্পনায় লোহার শিকের পরিবর্তে ছিল অজস্র চোখের নক্সা। লেবু-হলুদ গাঢ় নীল রঙের স্টেইন্ট গ্লাসে তৈরি হবে চোখগুলো আর মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গাতে মার্বেল পাথর- এই ছিল শিল্পীর পরিকল্পনা। সামনের মেঝেতে স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতরঙা বর্র্ণালী মেঝেতে সৃষ্টি হতো। পুরো মিনারটির সামনে একটি রেলিং থাকার কথা ছিল। রেলিংটা আগাগোড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি করার স্বপ্ন ছিল শিল্পীর। আর একটি কথা রেলিংয়ে বার বার লেখা থাকার কথা ছিল- একুশে ফেব্রুয়ারি, তোমায় কি ভুলিতে পারি। যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশকিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহীদের স্মরণের আর কিছু বিশাল কালো পায়ের ছাপ দানরেব প্রতীক হিসেবে থকার কথা ছিল। এই প্রশস্ত স্থানটিতে নভেরা আহমদের দুটি ভাস্কর্য থাকার কথা ছিল। আর এই মিনারের পাশেই থাকার কথা বাঙলা সাহিত্যের একটি পাঠাগার। সেই পাঠগারের দেয়ালে তৈলচিত্র রাখার পরিকল্পনা ছিল। মিনারের সামনে একটি সুন্দর ঝর্ণা থাকার কথা ছিল। চোখের মতো অনেকটা দেখতে হবে এর আকৃতি। কালো বিরাট চোখটাই একটা ঝর্ণা। অনবরত অশ্রুর মতো ঝরবে পানি। সেই পানি আবার জমা থাকবে, মনে হবে মহাকাল থেকে ঝরছে এই অশ্রুধারা। এই ঝর্ণার পরপরই তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজের পাচিল ঘেঁষে আবার মিনারের মতো একটা উঁচু বেদি উঠে যাবার কথা। যাতে দুদিকে ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটা বিশাল এলাকাজুড়ে শহীদ মিনারের অস্তিত্বটা টের পাওয়া যায়। শিল্পীর পরিকল্পনা ছিল স্টেইনলেস গ্লাসের মেঝেতে পড়া বর্ণালীর মাধ্যমে একটি কাল্পনিক ঘড়ি প্রতিষ্ঠিত করা, যেমনÑ আটটা বাজলে বেগুনী রং। বারোটাতে নীল। পাঁচটায় কমলা। প্রতিদিন দেখতে দেখতে ঘড়িটার রং পরিচিত হয়ে যেত। আর একটা ঘড়ি থাকার কথা ছিল, উঁচু টাওয়ার ঘড়ি, তার সময়গুলো বাঙলা লেখা হতো। শহরের একটা প্রধান সময় দেখার কেন্দ্র হিসেবে মিনারের এই ঘড়ি একটি দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেত। এক হাজার ফুটের একটি ম্যুরল চিত্র যেটা মিনারের ভেতরের কুঠুরিতে রাখার পরিকল্পনাও ছিল শিল্পীর। যদি এই শিল্পটি হতো তাহলে সেই সময় সেটা হতো পৃথিবীর দীর্ঘতম শিল্পচিত্রগুলোর অন্যতম। এর কাজও শুরু করেছিলেন তিনি, মাত্র দুটোস্তরের কাজ বাকি ছিল। ১৯৫৬ সালে হামিদুর রাহমান নক্সা প্রস্তুত করেন। শহীদ মিনারের কাজ ১৯৫৭ সালে শুরু হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও আন্দোলন মধ্যে থাকার কারণে সেই সময়ে শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ কাজ ১৯৬৩ সালেও শেষ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এটি উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বর্বররা এটি আবারও ধ্বংস করে ফেলেন। বর্তমান শহীদ মিনার হামিদুর রাহমানের মূল নক্সা একটু সংশোধন করে ১৯৭৩ সালের ৫ মে কাজ শুরু করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার সময় পাকিস্তান দম্ভ করে বলেছিল, ‘হার ঘর শহীদ মিনার বানা দেঙ্গা’ অর্থাৎ প্রতিটি ঘরকেই শহীদ মিনার বানিয়ে দেব। সেই সময় পাকিসেনারা প্রায় প্রতিটি ঘরেই কাউকে না কাউকে শহীদ করেছিল। ভেঙ্গে ফেলেছিল দেশের সব শহীদ মিনার। আর সেই শহীদদের উত্তরসূরিরা প্রতিটি প্রাঙ্গণে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে এবং একুশে দিবসের আগে যার যার বাড়ির আঙ্গিনায় ও পাড়ার মাঠে শহীদ মিনার বানিয়ে জবাব দিয়েছে, ‘আমাদের প্রতিটি ঘরেই শহীদ, আমাদের প্রতিটি প্রাঙ্গণেই শহীদ মিনার।’ বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত শহীদ মিনারের আবহ ও তাৎপর্য ছিল বিদ্রোহের প্রতীক। স্বাধীনতার পর শহীদ মিনার সামাজিক প্রতিবাদের সর্বজনীন প্রতীক, আমাদের মানবিক সংস্কৃতির আস্থা। তাই তো আমরা সামাজিক কোন দুর্যোগ দেখা দিলেই ছুটে যাই শহীদ মিনারে। আমরা চাই শহীদ মিনার যেন তৈরি হয় হামিদুর রাহমানের মূল নক্সা ও পরিকল্পনা অনুসারে। সারা বছর ধরে যেন শহীদ মিনারে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বজায় থাকেÑ সেই প্রত্যাশাই করি।
×