ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাঁরা সব বোঝেন কেবল গণতন্ত্র বোঝেন না!

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তাঁরা সব বোঝেন কেবল গণতন্ত্র বোঝেন না!

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনপরবর্তী একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, যে বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আজ থেকে সেই শান্তি ক্রমশ দূরবর্তী হতে শুরু করবে। কারণ একপক্ষ শান্তি চাইবে আর বিভিন্ন পক্ষের মিলিত শক্তি শান্তিকে কেবল দূরেই ঠেলতে থাকলে, সেই শান্তি শীঘ্র যে অর্জিত হবে না, বিভিন্ন দেশে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বহুজনের বহুবিধ প্রশ্ন থাকতে পারে এবং তাঁরা সেটি উত্থাপনও করছেন। কিন্তু নির্বাচনপরবর্তী সরকারটির কর্মকা- কি কোনভাবেই দেশের জন্য অকল্যাণকর ছিল? ৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখের আগের এক বছর আমাদের কী দেখিয়েছে? আমরা দেখেছি, যে কোন সূচকেই দেশ এগিয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলো যদি বাদও দিই তাহলেও বলা যায় যে, বিগত এক বছরের স্থিতিশীলতা বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এখানে প্রশ্ন দুটো, এক- রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য যদি দেশের উন্নয়ন হয় তাহলে কে করল তা মুখ্য হতে পারে না, তাই না? দুই- আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে, এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে কিন্তু তার জন্য আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার রাজনৈতিক ও সুশীলীয় মিলিত ষড়যন্ত্রের কারণ কী হতে পারে? আমরা বিএনপি-জামায়াতের আওয়ামী-বিরোধিতা নিয়ে প্রথমে বিশ্লেষণ করি। ধরেই নিচ্ছি যে, এদের জন্মশত্রু আওয়ামী লীগ, ফলে আওয়ামী লীগ যদি দেশটাকে সোনা দিয়ে মুড়েও দেয় তাহলেও তারা খুশি হবে না। তারা চাইবে আওয়ামী লীগের ধ্বংস, তা সে যে প্রকারেই হোক। তাই ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের পরের এক বছর যখন দেশ সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা মনে করেছে যে, আওয়ামী লীগকে এবার থামাতে হবে, নইলে সব দিক দিয়েই ক্ষতি। উন্নয়নের যে উদাহরণ আওয়ামী লীগ তৈরি করে দিচ্ছে তা বিএনপি-জামায়াত কখনই পূরণ করতে পারবে না। মানুষ ক্রমশ আশাবাদী হয়ে উঠছে এবং সচেতনও হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সব সময়ই চেয়েছে মানুষকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের আখের গোছাতে। কিন্তু এই আশাবাদী সচেতন জনগোষ্ঠীকে আরও সচেতন হওয়ার আগেই পুড়িয়ে মারতে হবে কিংবা আতঙ্কিত করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি এখানে বিএনপি-জামায়াতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো একে তো সাংবিধানিকভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি ‘গ্রে এরিয়া’ বা কারচুপির মেশিন ব্যবস্থা আর দেশে বলবত নেই। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণীত হয়েছে। এ সব কোনটাই আসলে বিএনপি-জামায়াতের নির্র্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না। তারা নির্বাচনের নামে প্রথমে রাজনীতির জল ঘোলা করে সেখান থেকে ক্ষমতার মাছ শিকার করতে অভ্যস্ত। এ অভ্যস্ততা এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পথে। বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তদ্বীয় পুত্র তারেক জিয়া দুর্নীতির দায়ে পলাতক, আরেক পুত্র দুর্নীতির ভার মাথায় নিয়ে পরলোকে। এমতাবস্থায় তাদের আর হারানোর কিছুই নেই, অর্জন ছাড়া। কিছুদিন আগে আরেকটি লেখায় আমি লিখেছিলাম, জোট হয়ত থাকবে কিন্তু ভোট থাকবে তো? তখন মাথায় আসেনি যে, আসলে ভোটের জন্য তারা এই আগুন নিয়ে খেলছে না, তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে রাজনীতির মাঠটাকে ফাঁকা করতে চাইছে কিছুদিনের জন্য। তারপর সেই ফাঁকা মাঠে তারা তাদের কারসাজি শুরু করবে। অর্থাৎ তারা মানুষ পুড়িয়ে প্রথমে আওয়ামী লীগকে ব্যর্থ বানিয়ে একদল সুযোগসন্ধানীকে সার্থক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেই সব সুযোগ সন্ধানীরা ইতোমধ্যেই বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখাটেখা করে এসেছেন এবং নিশ্চিতভাবেই জানিয়ে এসেছেন যে, বিএনপি-জামায়াত মানুষ পোড়ানোর কাজটুকু করুক আর তারা এই আগুনে ঘি ঢালার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন খয়রাত করার কাজটি করবে। সফল হলে দু’পক্ষেরই লাভ, একপক্ষ কিছুকাল ক্ষমতায় থাকার আনন্দ পাবে আর বিএনপি-জামায়াত সেই ফাঁকে তত্ত্বাবধায়কের মতো কারচুপির মেশিন ফিরিয়ে আনতে পারবে এবং তারপর তো ক্ষমতাই ক্ষমতা! এবার আসি আরেকটি পক্ষ যারা বিএনপি-জামায়াত জোটের এই মরণকামড়ে কখনও দূর থেকে কখনও একেবারে কোলে উঠে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তাদের কথায়। এখানে কারও নামোল্লেখ না করলেও এ লেখার পাঠক নিশ্চিতভাবেই বুঝবেন আমি কাদের কথা বলতে চাইছি। ১/১১-এর সময়ে এদের আমরা দেখেছি কত চমৎকারভাবে তাঁরা অনির্বাচিত ও অরাজনৈতিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। তখনকার অনির্বাচিত সরকারকে তাঁরা সমর্থন দিতে পারলে ৫ জানুয়ারির সরকারকে কেন সমর্থন দিতে পারবেন না? প্রশ্নটি তাদের করা সঙ্গত হলেও আজ পর্যন্ত কাউকেই করতে দেখিনি। আমি নিশ্চিত যে, যেহেতু ৫ জানুয়ারির সরকারে তাঁদের কোন ভাগ নেই, সেহেতু তারা এই সরকারকে সমর্থন করতে পারছেন না; কিন্তু ১/১১-এর সরকারে তাদের ভাগ ছিল, ভরণপোষণ ছিলÑ তাই তারা সেই সেনাসমর্থিত সরকারের পক্ষে জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছেন, কলম ধরেছেন, রাজনৈতিক দল গঠন করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং মাইনাস টু থিওরির নামে মূলত শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বাদ দেয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। কী অপূর্ব তাদের বিশ্লেষণ, আজকে তারা পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলছেন ‘রাজনীতি কম’ বা ‘গুডবাই ডেমোক্রেসি’র মতো শিরোনাম দিয়ে। অথচ ১/১১-এর সময় তারাই লিখেছিলেন- ‘দুই নেত্রীকে বিদায় নিতে হবে’, ‘ব্যাটল অব টু বেগমস।’ আমাদের স্মরণ রয়েছে যে, দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ তখন অরাজনৈতিক সরকারের গুণগান করতে গিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন যে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রকেটে উঠেছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি যে, উন্নয়নের নামে লবডঙ্কা হয়েছে দেশের, বরং দেশ পিছিয়েছে সকল সূচকেই। ১/১১-এর আমলে ‘গুডবাই ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে কলাম লেখার মতো সাহস বা ক্ষমতা তাদের ছিল না, এখনও আছে এবং তারা কোমর বেঁধে নেমেছেন সেই ক্ষমতা প্রয়োগে। তারা আসলে সবকিছুই বোঝেন, কেবল গণতন্ত্রটাই কম বোঝেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আবারও একটি প্রশ্ন তুলি। বিএনপি-জামায়াত তাদের নেতাদের ও দলকে রক্ষায় দেশব্যাপী আগুন জ্বালিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, পৃথিবীময় তাদের এ অপকর্মের নিন্দা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এ গণতন্ত্রকামী সুশীল বিবেকবান মানুষদের কাউকে কি এ প্রশ্নটি তুলতে দেখেছেন যে- মানুষ পুড়িয়ে গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় কিনা? নাহ, তাঁরা গণ পুড়িয়ে কেবল তন্ত্রই চান। খুব ভাল কথা, তাহলে বেগম জিয়ার আগুন নিয়ে খেলার রাজনীতির সহযোগী বা সমর্থক হিসেবে যে সকল সুশীল/গণতন্ত্রবাদী তার সঙ্গে দেখা করে তাকে উস্কে দিয়ে এসেছেন, তারাও কেন সমানভাবে দোষী হবেন না? বেগম জিয়া হুকুমের আসামি হলে তারা আগুন-নায়িকার সহচরী নিশ্চয়ই? বাংলা সিনেমার নায়িকারা কখনও একা একা পুকুরঘাটে জল আনতে যায় না, অনেক সখী পরিবেষ্টিত হয়েই যায়। আমরা ‘ব্ল্যাক পলিটিক্স’ নামক ভয়ঙ্কর সিনেমায়ও দেখতে পাচ্ছি খালেদা জিয়ার চারপাশে সহচর-সহচরী হিসেবে বিখ্যাত সব গণতন্ত্রকামী চেহারাকে। তারা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের মতো হাতে পেট্রোলবোমা নিয়ে সরাসরি বাসভর্তি মানুষের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন না বটে, কিন্তু ঠিকই তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের কপালে এদের কারণেই সবচেয়ে বড় দুঃখটি রয়েছে বলে আমার মনে হয়। কারণ বিএনপি-জামায়াত আসলে রাজনৈতিক দল, নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য তারা নানাবিধ অ-কাজ, কু-কাজ করে কিন্তু এ সব বিবেকবান মানুষ যখন আওয়ামী লীগ বা সরকার-বিরোধিতার নামে তাদের সঙ্গে হাত মেলায় তখন দেশের ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে উঠতে দেরি লাগার কথা নয়। আসলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা সোমালিয়ার মতো অকার্যকর রাষ্ট্র না বানালে তো এদের করে খাওয়ার উপায় নেই। যদি তাই-ই সত্য না হবে, তাহলে ৫ জানুয়ারি ২০১৫ সালের আগের এক বছরের স্বাভাবিক অবস্থাকে তারা কেন দেশের জন্য মঙ্গলকর ভেবে অহিংস রাজনীতির পথটি বেছে নিলেন না? কেউ কেউ তর্ক করতে পারেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি। আমি সেই তর্কে কোন প্রকার দ্বিমত করব না। কিন্তু সভা-সমাবেশ করতে দেয়নি এ কথাও যেমন সর্বাংশে সত্য নয়, তেমনই এ কথাও ঘোরতর সত্য যে, বিএনপি-জামায়াত আসলে সভা-সমাবেশ করতেই চায়নি। তারা চেয়েছে সভা-সমাবেশ যাতে করতে না দেয় আওয়ামী লীগ সে ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করা, তারা ক্রমাগত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগকে আঘাত করেছে। আঘাতের পাল্টা আঘাত গাজীপুরে এবং ঢাকায় সভা-সমাবেশ করতে না দেয়া এবং তারও পরে বেগম জিয়াকে অন্তরীণ করে রাখা, যা অবশ্যই নিন্দনীয়। প্রশ্ন হলো, এ নিন্দা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে কি আমাদের উপরোক্ত সুশীল বিবেকগণ এ কথাটি বলেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অযথা এবং নোংরা আক্রমণ বন্ধ করুন? না তারা করেননি। বরং জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তাতে কখনও আইনী প্রক্রিয়ায়, কখনও আন্তর্জাতিক লবিকরণে তারা সহযোগিতা দিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের কবে কোন্্ আন্দোলনে জামায়াত সমর্থন দিয়েছিল বলে আওয়ামী লীগকে জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলানোর দায়ে দোষী করা হয়, তাহলে আজকে এ সব সুশীলবাজদের জামায়াত-বিএনপির পেট্রোলবোমা সহিংসতার সঙ্গে আঁতাতকারী বলা যাবে না? আওয়ামী লীগকে সরিয়ে তারা তো বিএনপি-জামায়াতকেই ক্ষমতায় আনতে চাইছেন, তাই না? নাকি তাঁরা নিজেরাই ক্ষমতা চান? আমরা চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি যে, শুরু হয়েছে বি-রাজনীতিকরণের প্রতিযোগিতা। এতে কে কিভাবে যুক্ত হবেন তা নিয়ে আমরা কিছুদিনের মধ্যেই নতুন নতুন তরিকা ও মুখ দেখতে পাব, সন্দেহ নেই। কেউ লিখবেন ‘রাজনীতি কম’, কেউ লিখবেন ‘গুডবাই ডেমোক্রেসি’ আর কেউ লিখবেন ‘আওয়ামী লীগকে যেতে হবে।’ আওয়ামী লীগ যদি অতীত থেকে কিছু শিখে থাকে তাহলে এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। আর যদি না থাকে তাহলে আবার দেশকে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য রেখে যাবে প্রথমে কিছুদিন কয়েকজন গণতন্ত্রকামী, সুশীল, অরাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে এবং তারপর তাদের সহযোগী বিএনপি-জামায়াত পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসীদের হাতে। দেশপ্রেমিক হওয়া যে সহজ কাজ নয়, সে কথাটির প্রমাণ আমরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর নতুনভাবে পাই। আবারও পাচ্ছি ৫ জানুয়ারি ২০১৫ সালের পর থেকে। ৯ জানুয়ারি, সোমবার ॥ ২০১৫ ॥ [email protected]
×