ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমার বিশ্বকাপ

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আমার বিশ্বকাপ

মাঠে বসে আমি কোন দিন বিশ্বকাপের খেলা দেখিনি। না ফুটবল, না ক্রিকেট! রাজনীতির রিপোর্টের মানুষ আমি। জীবনে যত এসাইনমেন্ট করেছি তার সিংহভাগ রাজনীতি ও যুদ্ধসংক্রান্ত। কিন্তু খেলার মাঠের যুদ্ধ নিয়ে কখনও রিপোর্ট করা হয়নি। খেলা পছন্দ করি এবং তা মূলত ফুটবল ও ক্রিকেট। খেলার সময়গুলোতে নেশায় বুদ হয়ে থাকি। বিশেষ করে সে খেলায় যদি আমার বাংলাদেশ থাকে। ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন বিশ্বসভার সদস্য। টেস্ট মর্যাদাসম্পন্ন দেশ। সর্বশেষ বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও টি২০ বিশ্বকাপের সফল আয়োজক দেশ ছিল বাংলাদেশ। আমি দেশে না থাকাতে সে খেলাগুলো মাঠে বসে দেখতে পারিনি। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে। এই প্রথম মাঠে বসে বিশ্বকাপের খেলা দেখব। দ্বৈত নাগরিকত্বের সূত্রে অস্ট্রেলিয়ারও নাগরিক আমি। বিশ্বকাপ উপলক্ষে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম এখন অস্ট্রেলিয়ায়! বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার খেলা আছে! বলতে দ্বিধা নেই সেদিনও আমার সমর্থন থাকবে বাংলাদেশ দলের পক্ষে। নিশ্চিত বলতে পারি আমার মতো সব বাংলাদেশী অরিজিন অস্ট্রেলিয়ান সেদিন মাঠে অথবা টিভির সামনে বসে জয়ধ্বনি করবেন টাইগারদের! প্রতিটি চার-ছক্কার সঙ্গে জয়বাংলা ধ্বনিসহ দুলবে লালসবুজ পতাকা! এক কথায় পুরো বিষয়টি নিয়ে ভীষণ একসাইটেড আমি এবং আমরা। সিডনিতে বাংলাদেশের কোন খেলা নেই! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম খেলা ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্যানবেরায়। প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী শহর ক্যানবেরা। সিডনি থেকে ২৮৮ কিলোমিটার দূর! বিমানে যেতে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে ট্রেনে অথবা গাড়িতে। ক্যানবেরায় প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা কম। অতএব ক্যানবেরায় খেলা দেখতে যাঁরা যাবেন তাঁদের সিংহভাগ সিডনি ও নিউ সাউথ ওয়েলস, আশপাশের ভিক্টোরিয়া-কুইন্সল্যান্ড রাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশী। এ নিয়ে এর মাঝে এক হুলস্থুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে! অনলাইনে টিকেট ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়ে গেছে বাংলাদেশ গ্যালারির সব টিকেট! অতএব বাধ্য হয়ে অনেকে আফগানিস্তান গ্যালারি এবং ক্যাটাগরি ওয়ান অথবা ক্যাটাগরি টু-র টিকেট কিনেছেন! ৯, ১১ ফেব্রুয়ারিতে সিডনির গা গরমের ম্যাচ দুটিতে টিকেটের মূল্য বাবদ কোন খরচাপাতি নেই। কিন্তু অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে সংগ্রহ করতে হয়েছে টিকেট! আমার মতো আলসেমি যাঁরা করেছেন তাঁরা এক্ষেত্রেও ঠকেছেন! অতপর যাঁরা টিকেট বেশি নিয়েছিলেন তাঁদের কাছে টিকেট ভিক্ষা করতে হয়েছে। খেলা দেখতে যাব কিন্তু বাংলাদেশের জার্সি, পতাকা থাকবে না তা কী হয়! অতএব শুরুতে এসব সংগ্রহে মন দেই। বন্ধু-বান্ধবরা দেশ থেকে এটা-সেটা উপহার পাঠাতে চান। তাঁদের তালিকা করে জার্সি চাইতে শুরু করি আমার আবার ছোটখাটো একটা দল আছে অস্ট্রেলিয়ায়! মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি একদল প্রিয় প্রজন্ম। বাংলাদেশ থেকে পড়াশুনা করতে এসেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। অথবা পড়াশুনা করে থিতু হয়ে গেছেন। জার্সি তাঁদেরও দিতে চাই। জার্সি চাইতেই তা বানের লাহান আসতেও থাকে; শুধু আমার বন্ধু ইয়াসিন কবির জয় এরই মধ্যে ১০০ জার্সি পাঠিয়েছেন! সঙ্গে নানান সাইজের লাল সবুজ জাতীয় পতাকা। হাতে দোলানোর জন্য ছোট ছোট পতাকা! কপালে বাঁধার জন্য পতাকা খচিত ব্যান্ড! আরেক সুহৃদ ডাঃ শরফুদ্দিন আহমদ চল্লিশটি জার্সি কিনে রেখেছেন! পাঠানোর লোক খুঁজছেন। জার্সি বিলি করতে গিয়ে আরেক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়! আগত সব জার্সিই বাংলাদেশের এল সাইজের! মোটাসোটা সুহৃদদের জন্য এক্সেল, ডাবল এক্সেল সাইজের জার্সি চেয়েছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে নাকি জার্সির সর্বোচ্চ সাইজ এল! অতএব কী আর করা! সুহৃদদের জার্সি, ব্যান্ড, পতাকা দিতে পেরে যে কী খুশি লেগেছে, তা বলে বোঝাবার নয়। জার্সি পাঠিয়েছি ব্রিসবেনে। জার্সি পাঠাবো এডিলেডে। এই প্রবাসে আমরা আমাদের আনন্দ পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করতে চাই। এতেই আমাদের আনন্দ, এতেই আমাদের সুখ। কারণ দুনিয়ার যেখানেই থাকি না কেন আমরা যে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরি, জয়বাংলার লোক। যত দূরে যাই আমরা তত বড় হয় আমাদের জন্মভূমি। মিডিয়ার লোক হওয়াতে আমার আরেক আনন্দ বাংলাদেশের অনেক সাংবাদিক আসবেন এই বিশ্বকাপ কভার করতে। অনেকে এর মাঝে চলেও এসেছেন। অনেকে আসার পথে। বাংলাদেশের এত মিডিয়া! সব মিডিয়ার অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো ব্যয়বহুল দেশে রিপোর্টার পাঠানোর সামর্থ্য নেই। কিন্তু ভিসা পেয়ে যাওয়াতে অনেকে যোগাযোগ করছেন। জানতে চাইছেন সিডনি থেকে মেলবোর্ন-ব্রিজবেন-এডিলেড কত দূর! বাসে-ট্রেনে যাওয়া যাবে কিনা! অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি বাংলাদেশের চেয়ে ৬৫ গুণ বড়! আমার এই ভাইদের যেহেতু ধারণা পুরোপুরি নেই তাই তাদের মজা করে বলি, বাসে-ট্রেনে যেতে পারবেন কিন্তু ১২-১৪ ঘণ্টার জার্নিতে পথে পথে যত খাওয়া-দাওয়া করবেন তাতে বিমানভাড়ার চেয়ে বেশি চলে যাবে। এখানে হোটেল ভাড়াও চড়া। জীবনযাপনের ব্যয় এখানে আমেরিকার চেয়ে বেশি। কাজেই যাঁরা আসবেন একটু সঙ্গতি নিয়ে আসবেন। আমার কাছে যাঁরা আসবেন তাঁদের সিডনিতে এবং অন্যান্য শহরে নিজের ও বন্ধুবান্ধবের উদ্যোগে থাকা খাওয়ায় সহায়তা দিতে আমি চেষ্টা করব। এ সব আমরা করি। কিন্তু যেখানে মিডিয়ার নামে এবং ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসে আর্থিক সঙ্গতির ঘোষণা দিয়ে আসছেন, এসব সহযোগিতা কেন নেবেন? উল্লেখ্য, সিডনিতে প্রধান দৈনিক মাত্র তিনটি! টিভি চ্যানেল ছয়টি। এর বেশি পত্রিকা অথবা চ্যানেল চালানোর বাজার নেই। বাংলাদেশেও বাজার নেই কিন্তু জোর করে শত শত পত্রিকা-চ্যানেল চালানো হচ্ছে! অস্ট্রেলিয়ায় এসব জোর করে কেউ চালায় না অথবা সে সুযোগও নেই। বাস্তব এ কথাগুলো লিখাতে কেউ মন খারাপ করবেন না। আবার বলছি আমার কাছে যাঁরা এসে পৌঁছতে পারবেন তাঁদের জন্য আমি সব করব। একাত্তর টিভির শামসুল আরেফিন, তানভির মাইনুদ্দিন এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম দুই মিডিয়া প্রতিনিধি। সিডনি এসেই তাঁরা হতাশ উচ্চারণে বলেন, এখানে যে বিশ্বকাপ হচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই বাংলাদেশে এ ধরনের আয়োজন উপলক্ষে কত সাজগোজ হয়! আসলেই এখানে বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। এরা দেশটাকে সারাবছর ধরে ছবির মতোন সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। উৎসব ভেন্যু এলাকায় শুধু কিছু ব্যানার-ফেস্টুন টানায়। আর বাংলাদেশ উৎসব উপলক্ষে বাজেট করে খরচ করে। উৎসবের পর ভেঙ্গে ফেলে অথবা নোংরা করে ফেলে! আবার বাজেট করে! এই ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ভেন্যুতে ভেন্যুতে এখন থেকেই উড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা! বিদেশে এটা যে আমাদের কত আনন্দের অনুভূতি তা বলে বোঝাবার নয়। জয়তু ক্রিকেট, টাইগারদের বাংলাদেশের জয় হোক। লেখক : সাংবাদিক
×