ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আইন করে এসব ধ্বংসাত্মক কর্মসূচী নিষিদ্ধ করার দাবি ;###;ভরদুপুরে রাস্তায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়েছিলেন সারাদেশের প্রতিবাদী সাড়ে ৩ কোটি ব্যবসায়ী

হরতাল-অবরোধ রুখতে রাজপথে ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

হরতাল-অবরোধ রুখতে রাজপথে ব্যবসায়ীরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা হাতে সারাদেশের ব্যবসায়ীরা ১৫ মিনিটের জন্য নেমে এলেন রাজপথে। গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।‘ এতেই কেঁপে উঠল বাংলাদেশ। হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার ও এই কর্মসূচী আইন করে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার দাবিতে এভাবে দেশের সাড়ে ৩ কোটি ব্যবসায়ী প্রতিবাদ জানালেন। দেশের মানুষ তো বটেই বিশ্ববাসীও জানল বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারে ব্যবসায়ী সমাজ রুখে দাঁড়িয়েছে। যে দল হরতাল-অবরোধ আহ্বান করবে তাদের আর সহযোগিতা করবে না ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। কারণ হরতাল-অবরোধের কারণে গত ৩৩ দিনে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। রবিবার রাজধানীসহ সারাদেশে দুপুর ১২টা থেকে সোয়া বারোটা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধবিরোধী কর্মসূচী পালন করা হয়। সবার উপরে দেশ। দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও এই সেøাগানে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী প্রত্যাহারের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় মতিঝিল এফবিসিসিআই ভবনের সামনে। শাপলা চত্বর থেকে অনুষ্ঠান ছড়িয়ে পড়ে দৈনিক বাংলা পর্যন্ত। এছাড়া টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা এই কর্মসূচী পালন করেছে। এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতায় দেশের ৭৫টি চেম্বার এবং ৪ শতাধিক এ্যাসোসিয়েশন এফবিসিসিআইয়ের আহ্বানে এই কর্মসূচী সফল করেছে। কর্মসূচীতে অংশ নিতে বেলা ১১টার পর থেকে ব্যবসায়ীরা যার যার সংগঠনের ব্যানার নিয়ে মতিঝিলের দিকে আসতে থাকেন। এ সময় তাদের হাতে দেখা যায় ছোট ছোট জাতীয় পতাকা। আর ব্যানারে লেখা দেখা যায়Ñ সবার উপরে দেশ, দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও, জানমালের নিরাপত্তা চাই, ব্যবসার পরিবেশ চাই’সহ বিভিন্ন সেøাগান। এদিকে, গত ৫ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধের মধ্যেই দফায় দফায় হরতালে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির একটি চিত্র কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাময়িক হিসাবে গত ৩৩ দিনে ৭৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে পরিবহন খাতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, পোশাক খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা, উৎপাদন খাতে ৪ হাজার কোটি টাকা, পর্যটন খাতে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষি ও পোল্ট্রি খাতে ৯ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, হিমায়িত পণ্য খাতে ২৫০ কোটি টাকা, আবাসন খাতে ৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার কোন পরিমাপ করা যায় না। এ অবস্থা চলতে থাকলে অবিলম্বে আইন করে হরতাল-অবরোধ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের এই নেতা। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, এ রকম সময়ে এই রাজনৈতিক সহিসংতা দেশের স্বার্থে অর্থনীতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘাত ও নেতিবাচক কর্মসূচী, বিশেষ করে হরতাল-অবরোধ পরিহার করা জরুরী হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে আসছেন, যার বেশিরভাগেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে বেসরকারী খাতে। কিন্তু টানা হরতাল-অবরোধে দেশে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা চলমান থাকলে নতুন কর্মসংস্থান দূরের কথা আগেরগুলোই ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। আমাদের দেশে যে সম্ভাবনা আছে তাতে প্রবৃদ্ধিকে ৮ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক টালমাটালে তা ৬ শতাংশে স্থিতিশীল হয়ে আছে। এফবিসিসিআইয়ের দাবিগুলোর মধ্যে হরতাল-অবরোধ চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পুনর্গঠনের যে সুযোগ দিয়েছে তা সব ব্যবসায়ীকে দেয়া এবং সহিংসতা ও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধের দাবিও রয়েছে। মতিঝিলের এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন সংগঠনের সাবেক সভাপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুণ, সালমান এফ রহমান, মীর নাসির হোসেন, আনিসুল হক, একে আজাদ, ঢাকা চেম্বারের সভাপতি হোসেন খালেদ, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম, এমসিসিআইর সাবেক সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ, মোঃ জসীমউদ্দিন, ব্যবসায়ী নেতা আবদুল মাতলুব আহমদ। সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি মনোয়ারা হাকিম আলী, সহসভাপতি মোঃ হেলালউদ্দিন প্রমুখ। এছাড়া এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্যদের সদস্য এবং ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠনগুলোর নেতারা এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। একই সময়ে হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা হাতে রাজপথে মানববন্ধন করেন তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের এ কর্মসূচীতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কাওরান বাজারের আড়তদার, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ অংশ নেন। পোশাক খাতের নেতাদের হুঁশিয়ারি ॥ এফবিসিসিআইয়ের এই কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মোঃ আতিকুল ইসলাম চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট শীঘ্রর নিরসন না হলে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন। তিনি বলেছেন, আমরা এমন রাজনীতি চাই না যে রাজনীতি দেশে সহিংসতার সৃষ্টি হয়। চলমান এই সঙ্কট শীঘ্রই স্বাভাবিক না হলে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন। তিনি বলেন, আজকে আমাদের রাস্তায় থাকার কথা ছিল না। কিন্তু দেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন সঙ্কট সমাধান ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সঙ্কটের সমাধান হবে। নাশকতার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা রাজপথে ॥ চট্টগ্রাম থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, দেশে হরতাল-অবরোধের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে রবিবার চট্টগ্রামে রাস্তায় নেমে আসে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। বেলা ১২টা থেকে ১৫ মিনিটের জন্য তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে চলমান নৈরাজ্যের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। ‘সবার উপরে দেশ, দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও’ এ স্লোগানে তাঁরা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানান। চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আহ্বানে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায় চেম্বার ভবনের সামনের সড়কে জড়ো হন ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ট্রেড বডির নেতা ও প্রতিনিধিরা। তাঁদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন বিভিন্ন পর্যায়ের শান্তিপ্রিয় মানুষ। চেম্বারের আহ্বানে কর্মসূচীতে অংশ নেন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ্যাসোসিয়েশন, বারভিডা, সিএ্যান্ডএফ এজেন্টস এ্যাসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার, শিপিং এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশন, খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি, ফ্রেইট ফরোয়াডার্স এ্যাসোসিয়েশন এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ ॥ পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যা বন্ধের দাবিতে রবিবার চট্টগ্রামে রাস্তায় নেমে আসে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদও। সংগঠনের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করা হয় পদযাত্রা ও সমাবেশের। এতে বক্তারা বলেন, যেভাবে নাশকতা চলছে তাকে কোনভাবেই আন্দোলন বলা যায় না। দেশের জনগণ এ ধরনের সহিংসতার রাজনীতি চায় না। চট্টগ্রাম বন্দর কর্মচারী পরিষদ ॥ চট্টগ্রাম বন্দর কর্মচারী পরিষদের (সিবিএ) ব্যানারে রবিবার বিকেল ৩টা হতে ৪টা পর্যন্ত কাস্টম হাউস চত্বর, বিএসসি ভবন ও নিমতলা মোড় পর্যন্ত মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন এম এনামূল হক চৌধুরী, এমএ মান্নান, মোঃ আবদুল মন্নান, আবুল মনছুর আহমেদ, ফখরুল ইসলাম, রফিউদ্দিন খান, সৈয়দ মেজবাউল ইসলাম, নুরুচ্ছফা ভূইয়া, মোকারম হোসেন, মোঃ লিয়াকত আলী, সাইফুর রহমান স্বপন, মোঃ সিরাজুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন আহমদ, প্রমুখ। রাজশাহীতে ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন ॥ রাজশাহী থেকে মামুন-অর-রশীদ জানান, পতাকা হাতে নাশকতার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন ব্যবসায়ীরা। দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধের নামে মানুষ হত্যা ও নাশকতার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রাজশাহীতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করে। রবিবার বেলা ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে চেম্বার ভবনের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ কর্মসূচীতে চেম্বারের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনি, পরিচালক সেকেন্দার আলী ও মুনজুর রহমান পিটারসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সিলেটে ব্যবসায়ীরা রাস্তায় ॥ সিলেট থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় ধরে চলমান হরতাল-অবরোধসহ রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রবিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। রংপুর ॥ রংপুর থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, হরতাল বোমা নৈরাজ্যের প্রতিবাদে রবিবার সারাদেশের মতো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন রংপুরের ব্যবসায়ীরাও। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আহ্বানে এবং রংপুর চেম্বারের আয়োজনে বেলা ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ের প্রধান সড়ক বন্ধ করে দিয়ে এই মানববন্ধন চলে। এতে জেলার বিভিন্ন শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা রাজপথে নেমে আসেন। বরিশালে ৪১ সংগঠনের মানববন্ধন ॥ বরিশাল থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, সবার উপরে দেশ। তাই দেশ বাঁচাও, অর্থনীতি বাঁচাও’ সেøাগানকে সামনে রেখে জানমালের নিরাপত্তার পাশাপাশি ব্যবসার পরিবেশ চেয়ে রবিবার সকালে নগরীর সদর রোডে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন দি বরিশাল চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজসহ ব্যবসায়ীদের ৪১টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
×