ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এগিয়েছে শিল্প ও সেবা খাত ;###; অগ্রগতির ধারা ইংল্যান্ড ও জাপানের মতো ;###; হাতের প্রকল্প শেষ করলেই প্রবৃদ্ধি গড়াবে ৭ শতাংশে ;###; বাংলাদেশ অগ্রগতির সিঁড়িতে উঠেছে ॥ বিশ্বব্যাংক

বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির ভিত ॥ কৃষি থেকে শিল্পে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির ভিত ॥ কৃষি থেকে শিল্পে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ এক সময় কৃষিই ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল নিয়ামক। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রায় ৮০ ভাগ শ্রমিক। কিন্তু সেই চিত্র এখন আর নেই। ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দেশের অথর্নীতির ধরন। কৃষি থেকে শিল্পের পথে হাঁটছে অর্থনীতি। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে শেষে ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপিতে এ অবদান কমে দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। বাংলাদেশ ধীরগতিতে দৃঢ় ও স্থিতিশীল কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে রূপান্তর হচ্ছে। এ অবস্থাকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতির সিঁড়িতে উঠেছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বলছে, কৃষি তার আগের অবস্থানেই রয়েছে, কিন্তু এগিয়ে গেছে অন্য দুই খাত (শিল্প ও সেবা)। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লীড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, যে সমস্ত দেশ (পশ্চিমা দেশ) অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করেছে সব অর্থনীতির একই ধরনের কাঠামো ছিল। প্রথম দিকে অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর, তারপর শিল্পের দিকে যাত্রা করেছে। বিশেষ করে শিল্পের অগ্রগতির শুরুটা আবার বস্ত্র খাতের উন্নতি দিয়ে হয়। যেমন ইংল্যান্ডে হয়েছিল। বাংলাদেশও সেই পথেই যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির ধরনটা জাপানের মতোই। কেননা বাংলাদেশের শ্রম ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ বলে তেমন কিছুই নেই। জাপানও শ্রম দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে রফতানির মাধ্যমে অগ্রগতি অর্জন করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, বাংলাদেশ এখন অগ্রগতির সিঁড়িতে উঠেছে। কিন্তু এ সময় যতটা দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনা ছিল তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানা পিছুটানের কারণে। তবে এখন শিল্পের ক্ষেত্রে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে তা কাজে লাগাতে অবকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। এজন্য বিশেষ কিছু করার দরকার নেই। যেগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছে সেগুলো শেষ করতে পারলেই আপাতত হয়। যেমন বন্দরের পুরোপুরি ব্যবহার, ঢাকা-চিটাগাং চারলেনের কাজ শেষ করার এবং যে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেগুলো দ্রুত শেষ করলেই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ধীরগতিতে কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল প্রায় ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছর সময়কালে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ২০১২-১৩ অর্থবছরে এসে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান দাঁড়িয়েছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যার কারণে অর্থনীতিতে তিনটি বৃহৎ খাতের মধ্যে কৃষির অবদান এখন তৃতীয়। জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান কয়েক বছর ধরে স্থিতিশীল রয়েছে। অপরপক্ষে শিল্প খাত এ সময়কালে ক্রমবর্ধনশীল অবদান রেখেছে এবং প্রবৃদ্ধি ছিল ভাল। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল ২৯ শতাংশ। সেখান থেকে তিন শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩২ শতাংশ, যেটি বর্তমানে আরও বেড়েছে। এ বিষয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করতে অবশ্যই শিল্পের দিকে ঝুঁকতে হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, কৃষিকে অবহেলা করা হয়েছে। কৃষি তার অবস্থানেই ছিল। কিন্তু শিল্প এগিয়ে গেছে দ্রুত, যা কৃষির পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কৃষির বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল চলমান ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়, যাতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জিইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত চার বছরে কৃষি খাতে গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হলো তিন দশমিক নয় শতাংশ। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ। অন্যদিকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল অনেক উৎসাহ ব্যঞ্জক। এ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আট দশমিক নয় শতাংশ, যা গত চার বছরের গড় প্রবৃদ্ধি আট দশমিক এক শতাংশ থেকেও বেশি। কিন্তু সেবা খাতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ছিল ছয় শতাংশ, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরে কিছুটা কমে হয়েছে পাঁচ দশমিক সাত শতাংশ। তারপরও সেটি ছিল কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির চেয়েও বেশি। ড. আলম আরও বলেন, বর্তমান সময়ে দেশের অর্থনীতি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সমৃদ্ধ, বিস্তৃত, স্থিতিশীল ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্ত। অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে অগ্রসরমান, যা অতীতের যে কোনো বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে অনেক বেশি গতিময়। বাংলাদেশ ধীরগতিতে দৃঢ় ও স্থিতিশীল কৃষি প্রধান অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে, যা মধ্য আয়ের অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত হওয়ার অন্যতম পথ। সূত্র জানায়, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি থেকে শিল্পের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের কৌশলের ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি এর উৎপাদন কাঠামোয় খুব কমই পরিবর্তন অবলোকন করেছে এবং ধারাবাহিকভাবে কৃষির মতো কম উৎপাদনশীল এবং অনানুষ্ঠানিক সেবা খাতের ওপর নির্ভরতা এখানও রয়েছে। ফলে তা উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হলে পরিকল্পনা শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বিনিয়োগের হার জিডিপির বর্তমানে ২৫ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এই বিনিয়োগ মূলত অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ ( বিদ্যুত ও যোগাযোগ) এবং মানব সম্পদ উন্নয়নে নিয়োজিত করতে হবে। ফলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতির সব খাতে উচ্চ উৎপাদনশীলতা যাতে অবদান রাখতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেয়া হবে। শ্রমঘন, রফতানিমুখী শিল্প খাত এবং সংগঠিত সেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এসবের পাশাপাশি গ্রামীণ অকৃষি এবং শহুরে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হবে। শিল্পের পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের পরিকল্পনার কথায় রয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষি না শিল্প এখানে এটি বড় প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদেরও শিল্পের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া ছাড়া উপায় নেই। পাশাপাশি কৃষি উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে।
×