ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘যেদিন পরীক্ষা সেদিন হরতাল’- খোদ বিএনপিতেই অস্বস্তি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

‘যেদিন পরীক্ষা সেদিন হরতাল’- খোদ বিএনপিতেই অস্বস্তি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিএনপি জোট। ‘যেদিন পরীক্ষা সেদিনই হরতাল’ এই কৌশল নিয়েছে তারা। হাইকমান্ডের এ ধরনের সিদ্ধান্তে অস্বস্তিতে পড়েছে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। লাখ লাখ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীর মনে বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মনে বিএনপির ‘বোমাবাজ’, ‘জঙ্গী’ এবং ‘মানুষ পুড়িয়ে মারার’ একটি স্পষ্ট ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। হরতাল দিয়ে পরীক্ষা বন্ধ ও পেট্রোলবোমা মেরে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করায় তারা বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী দল বলেই মনে করছে। প্রজন্ম ধ্বংস করার এই প্রক্রিয়া বিএনপির রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলেই তারা মনে করছে। নানামুখী সমালোচনার পরও পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিএনপি অনড় অবস্থানে। রাজপথে আন্দোলন সফল করতে নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ না থাকায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পরীক্ষাকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন খালেদা জিয়া। বার বার হরতাল দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা ঠেকিয়ে দেয়ায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের আত্মীয়স্বজন বিএনপি ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা খালেদা জিয়াকে হরতাল-নৈরাজ্য বন্ধ করে শান্তির পথে ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। রাজপথে দাঁড়িয়ে কোমলমতি ছাত্ররা সেøাগান দিচ্ছে- ‘এসএসসি পরীক্ষা বন্ধ কেন, খালেদা জিয়া জবাব চাই’, ‘খালেদা জিয়া আমাদের পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারবেন না’, ‘খালেদা জিয়া বাঁচতে চাই, শান্তি চাই’, ‘খালেদা জিয়া আমাদের কী দোষ জবাব দিন’, ‘আমরা স্বাভাবিক পরিবেশে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ চাই’, ‘পরীক্ষার সময় আর হরতাল দেখতে চাই না’। আর রাজপথে ছোট ছোট শিশু-কিশোরদের এ কর্মসূচী শুধু যে বিএনপি ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হচ্ছে তা নয়, রাজনীতি সম্পর্কেও নতুন প্রজন্মের কাছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। হাইকমান্ডের এ ধরনের সিদ্ধান্তে স্পষ্টতই বিরক্ত প্রকাশ করছেন মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। জেলা ও থানা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, হাইকমান্ডের এ ধরনের কর্মসূচীতে তারা শুধু বিরক্তই নয়, আতঙ্কিত। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সন্তান নয়, আমাদের সন্তানরাও এএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আমার সন্তানের ভবিষ্যত ধ্বংস হোক এটি কখনই চাই না। রমনা থানা বিএনপির এক নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান ইতিবাচক রাজনীতির মাধ্যমে একটি প্রজন্ম তৈরি করেছিলেন। এদের কারণেই আজ বিএনপি এতবড় দল। এবার ‘পরীক্ষা ঠেকানো‘ এবং ‘পেট্রোলবোমার’ রাজনীতিতে এই প্রজন্ম ধ্বংসের দারপ্রান্তে। শিশু-কিশোররা যেভাবে এর প্রতিবাদ জানাচ্ছে তাতে এই প্রজন্মের কাউকেই আর বিএনপির সমর্থক হিসেবে দেখা যাবে কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এমনকি আমার পরিবারের স্কুল পড়ুয়া শিশুটিকেও ভবিষ্যতে বিএনপির সমর্থক হিসেবে পাওয়া যাবে কিনা নিশ্চিত করে বলা যায় না। খিলগাঁও থানা বিএনপির এক নেতা বলেন, আমি বিএনপির রাজনীতি করি কিন্তু কখনই সন্ত্রাস বা সহিংসতা সমর্থন করি না। এবার অবস্থা এমন হয়েছে যে, আত্মীয়স্বজনও আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। কোন অপরাধ না করেও পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এমন রাজনীতি আমরা কখনই চাই না। ঢাকা জেলা বিএনপির এক সম্পাদক বলেন, দলীয় ফোরামে কথা বলার সুযোগ নেই। কোথা থেকে পরীক্ষা ঠেকানোর কর্মসূচী আসে জানি না। পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ পোড়ানের নির্দেশ কারা দিচ্ছেন তাও আমার জানা নেই। অথচ এর দায় আমাকেও বহন করতে হচ্ছে। এটি চলতে পারে না। বিএনপি জোটের ডাকা টানা অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যেই ২ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৩ হাজার ১১৬টি কেন্দ্রে ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৬ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। আর বিএনপিও আগে থেকে জানিয়ে দেয় তারা পরীক্ষা চলাকালে অবরোধের মধ্যে হরতাল দেবে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ও পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপিকে পরীক্ষার দিন হরতাল না দিতে অনুরোধ জানাতে থাকে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ অনুরোধের তোয়াক্কা না করে প্রথম দফায় ২ ফেব্রুয়ারি সকাল ৬টা থেকে দেশব্যাপী টানা ৭২ ঘণ্টা এবং পরে দ্বিতীয় দফায় ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আরও ৩৬ ঘণ্টা হরতাল পালনের ডাক দেন। এতে বিএনপির বিরুদ্ধে নানামুখী সমালোচনা শুরু হলে দলের পক্ষ থেকে পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানানো হয়। এসএসসির প্রথম পরীক্ষা না হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে হরতাল-অবরোধ ও নাশকতা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীসহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পাশাপাশি অবিলম্বে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করে নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষাসহ শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি দাবি জানায় ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। অপরদিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রায় প্রতিদিনই খালেদা জিয়ার প্রতি কাকুতি-মিনতি জানিয়ে পরীক্ষার সময় হরতাল বন্ধের দাবি জানান। পরীক্ষা শেষে হরতাল দিলে আপত্তি থাকবে না বলেও তিনি বলতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও পরীক্ষার সময় হরতাল না দিতে খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানাতে থাকেন। কিন্তু কোন আহ্বানই খালেদা জিয়াকে অনড় অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। তাই আজ রবিবার থেকে আবারও টানা ৭২ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছেন খালেদা জিয়া। পরবর্তীতে এসএসসি পরীক্ষা বন্ধে আরও হরতাল দেয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানা গেছে। শুক্র ও শনিবার হরতাল না থাকায় সারাদেশে এসএসসির দুটি পরীক্ষা শান্তিপূর্ণভাবে হওয়ার পর জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু আজ থেকে আবার বিএনপি জোটের টানা হরতাল শুরু হওয়ায় নতুন করে আশঙ্কা বেড়ে গেছে। কোন কোন মহল থেকে বলা হচ্ছে, এসএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো যাতে না হয় সে জন্য ৭২ ঘণ্টা হরতাল শেষে আবারও হরতাল ডাকবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তিনি চাচ্ছেন এসএসসি পরীক্ষা ঠেকিয়ে দিতে পারলে এ ব্যার্থতার দায়ভার সরকারকে বহন করতে হবে। আর এতে করে সরকার বেকায়দায় পড়বে। সেই সঙ্গে বিএনপি যে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়নি তাও প্রমাণ করা সম্ভব হবে। অবরোধের মধ্যে হরতাল ডেকে এসএসসি পরীক্ষা বানচালের চেষ্টা করায় দেশে-বিদেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবে ঠিক এ সময়ে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর দেশে এসে ছেলের বউ শর্মিলা রহমান এবং দুই নাতনি জাফিয়া রহমান ও জাছিয়া রহমান কয়েক দিন গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে অবস্থান করলেও পরীক্ষা থাকায় তাদের মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া। এ খবর শোনার পর সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। কেউ কেউ বলতে থাকেন, দেশের ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ করে তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিলেও নিজের দুই নাতনিকে খালেদা জিয়া ঠিকই পরীক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাহলে কি দেশের জনগণের ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষার জন্য তাঁর কোন দরদ নেই? তাহলে তিনি কেন জনগণের জন্য আন্দোলন করছেন বলে জানাচ্ছেন? সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমানের স্ত্রী ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ওবায়েদ হরতাল-অবরোধ দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা বানচালের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন ‘আন্ডার মেট্রিক’ খালেদা জিয়া এসএসসি পরীক্ষা সম্পর্কে কী বুঝবেন? তবে তিনি ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর কবরের মাটি না শুকাতেই দুই নাতনিকে পরীক্ষার জন্য মালয়েশিয়া পাঠিয়েছেন। অথচ ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করছেন। এতে বোঝা যায় খালেদা জিয়া নিজের পরিবারের ব্যাপারে শতভাগ হিসাবি হলেও দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করছেন। তাঁর এ মনোভাবের মাধ্যমে প্রমাণ হলো তিনি জনগণের জন্য রাজনীতি করেন না। তিনি ক্ষমতার লোভে অনেক কিছুই করতে পারেন। তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্ষতি করে সাধারণ মানুষের মন পাওয়া যায় না। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের সামনে ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মানববন্ধন চলাকালে সম্প্রতি গুলশান মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ এম মোস্তফা জামান বলেন, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের মেরুদ-কে ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা চলছে। হরতাল-অবরোধ ডেকে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা দিতে দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমরা ঘরে বসে থাকতে পারি না। তাই বিবেকের তাড়নায় রাজপথে নেমেছি। আমরা সহিংসতা চাই না। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই শিক্ষাকে রাজনীতির উর্ধে রাখা হোক। আর দেশের রাজনৈতিক বিষয় রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করা হোক, পরীক্ষা বন্ধ করে নয়। পরীক্ষা দিতে গিয়ে যেন কোন মায়ের কোল খালি না হয় আমরা খালেদা জিয়ার কাছে সে দাবি জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এখন আন্দোলনের সাফল্যতাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তাই এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও হরতাল দেয়া হচ্ছে।
×