ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

অস্থির সময়ের পাঁচালি

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অস্থির সময়ের পাঁচালি

উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোতে সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়ার পুরনো কৌশলের জায়গায় নতুন ব্যবস্থা হিসেবে যা চাপানো হয়েছে তার গালভরা নাম গণতন্ত্র। এর ফর্মুলা প্রণীত হয় বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রকদের ল্যাবরেটরিতে। উদ্দেশ্য পুঁজির পুঞ্জীভবনের জগত বা কেন্দ্রের পুঁজি নিরাপদ রাখা। বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মতো প্রান্তের দেশগুলো মূলত সে লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। আর পুঁজির কেন্দ্রীভবনের মূল নিয়ন্ত্রক এখন বহুজাতিক কোম্পানি ও কর্পোরেশনগুলো। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী পাঁচটি কর্পোরেশন- জেনারেল মটরস, ওয়ালমার্ট, এক্সন-মবিল, ফোর্ড এবং ডাইমলার-ক্রাইসলারের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর একশ’ বিরাশিটি দেশের জিডিপির চেয়ে বেশি। আর মাইক্রোসফট, কোকা-কোলা এবং আইবিএম কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সম্মিলিত জিডিপি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। এদের কাছে অন্য সব কিছুর মতো গণতন্ত্রও একটি পণ্য। এ পণ্য বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী প্রান্তের দেশগুলোয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। আর গণতন্ত্রের লাড্ডুর মোহে আবিষ্ট হয়ে এসব দেশ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে নানান আইন ও চুক্তিতে জড়িয়ে নিজেদের সম্পদ ওসব কোম্পানির হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেয়। বৃহৎ পুঁজিকে সার্ভিস দিতে এসব দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত সরবরাহ, আর্থিক লেনদেনের আধুনিকায়ন ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলো। মার্কিন গবেষক হাওয়ার্ড জিমের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাট ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলের সঙ্গে এরপর ধীরে ধীরে আমদানি হয় গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটপাট ও দখলদারিত্ব ভদ্রস্থ গ্রহণযোগ্যতা পায়। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এ চিত্র দেখি। উনিশ শ’ একানব্বই সালে গ্যাট চুক্তি থেকে শুরু করে অন্য প্রায় সব চুক্তি সই হয়েছে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়। সর্বনাশের মূল অনুঘটক ছিল গ্যাট চুক্তি। এতে দেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ তুলে দেয়া হয়েছিল কেন্দ্রের বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির হাতে। স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষা, শিল্প ও কৃষিনীতির পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি এখন বিক্রয়যোগ্য একেকটি পণ্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান- প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও এগুলো চড়াদামে বিক্রি হয় বলে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ থেকে প্রায় বঞ্চিত। ইংল্যান্ডের দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকা দু’হাজার আট-এ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ গণতন্ত্রের নামে এখনও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় বাস করেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঢাকঢোল পেটানো হয় এই জনগণের নামে। তাদের নামে নির্বাচন হয়। সংসদ বসে, উন্নয়নের নানান পরিসংখ্যানের প্রজেকশন হয়। অথচ প্রাকৃতিক যে সম্পদের মালিক জনগণ তা যখন বিভিন্ন চুক্তির নামে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায় অন্ধ বোবা কালা জনগণ তার কিছুই টের পায় না। জাতীয় সংসদ ঠুঁটো জগন্নাথ। আজ পর্যন্ত যত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার কোনটাই সংসদের মাধ্যমে হয়নি। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে এখন সংসদের কোন ভূমিকা নেই। এ দায়িত্ব চলে গেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্রের কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তাদের দরকার এমন শাসনব্যবস্থা যা প্রান্তের দেশগুলোর পুঁজির প্রবাহ ও উদ্বৃত্তের প্রবাহ প্রাপ্তি নিরাপদ রাখতে পারে, জনগণের অসন্তোষ বা ক্রোধ থেকে ব্যবস্থাটি রক্ষা করে চড়া মুনাফা ফেরত নিশ্চিত করতে পারে। তাই তাদের জন্য সহায়ক গণতন্ত্রকেই তারা বাংলাদেশের মতো দেশে চালান করে। আর তাই নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার গণতান্ত্রিক খেলোয়াড়দের কাড়াকাড়ি, লাফালাফি। তাদের পেছনে অবস্থান নেন ‘সুশীল সদস্যরা’। তারা ভাল করেই জানেন, বলটি কোথায় থাকে। বল পাওয়ার জন্য শাসক শ্রেণীর মূল শক্তিগুলো প্রতিযোগিতা করে প্রভুদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। সামরিক-বেসামরিক গোপন, উন্মুক্ত নানান চুক্তি আসলে প্রভুদের জন্য পাঠানো উপঢৌকন। যার কাছ থেকে যত বেশি উপঢৌকন পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে গণতন্ত্রের বলটি তার কোর্টেই যাবে। এ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের গণতন্ত্রের পেছনের সরল অঙ্ক। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাভাবিক কারণেই বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির এ ভূখ- নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। গত নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন দেশের দূতদের আনাগোনা এবং ভালমানুষী বিবৃতির পেছনে একই কারণ কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতিসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় প্রতিবেশী দেশগুলো। অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি এর কম-বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে ভারত ও চীনসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির ওপর। তাছাড়া এ অঞ্চলের কোন রাষ্ট্রেই ধর্মীয় বা ভৌগোলিক কারণেই তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। এসব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ছেদ ফেলে। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং এ অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বক্তব্য-মন্তব্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, আঞ্চলিক অগ্রগতির জন্য তারা স্থিতিশীলতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার সঙ্গে অন্য যেসব দেশের স্থিতিশীলতা সরাসরি সম্পৃক্ত তাদের চিন্তা-ভাবনারই প্রভাব পড়বে এখানকার আসন্ন রাজনৈতিক হিসাবনিকাশে। সংলাপ, অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠুনির্বাচন প্রসঙ্গে উচ্চারিত শব্দাবলী আসলেই কি কোন তাৎপর্য বহন করে? অথবা এসব শব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আদৌ কোন সম্পর্ক কি আছে? এ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্কের তুফান তোলা মানে আসল সমস্যা আড়ালে রাখার চেষ্টা। আমাদের বরং সজাগ থাকা উচিত বহুজাতিক কর্পোরেশনের গতি-বিধির ওপর। তাদের হাত অনেকখানিই প্রসারিত হয়েছে। এখন তা থেকে এদেশীয় সম্পদ তুলে নেয়ার পালা। যে সম্পদের মালিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার খেলোয়াড়রা নয়, এ দেশের মানুষ। নানান বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে কি কৌশলে ওই প্রসারিত হাত জনগণের সম্পদ তুলে নেবে- সচেতন নাগরিকদের সেদিকে সতর্ক খেয়াল রাখা জরুরী। নাইজিরিয়ার কবি কেন্্ সারো উইয়া কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেমন মানুষকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, কর্পোরেট পুঁজি তেমনি প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট ও ভূমি এবং পরিবেশ ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে মানুষ হত্যা করে।’ একে তিনি ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এবং এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা, লেখালেখি করায় তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল নাইজিরিয়ার সামরিক শাসকের হাতে। যে সরকারের পেছনে তখন অন্যতম খুঁটি ছিল ডাচ ও মার্কিন দুটো বিখ্যাত কোম্পানি। এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো নামে নাইজিরিয়ান এক লেখক তার ‘আপসাইড ডাউন’ বইয়ে বলেছেন, ‘তেল সম্পদ লুট করতে গিয়ে শেল ও শেভরন নাইজিরিয়ার অগোনি সম্প্রদায়ের ভূমি ও নদী-নালাসহ তাদের পুরো পরিবেশই ধ্বংস করে ফেলেছে।’ অথচ এদের কাছ থেকেই আমরা পরিবেশ রক্ষার সবক নেই। তৃতীয় বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকার ফান্ড আসে। পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখার জন্য পদক আসে। আগেই বলেছি, সামরিক শাসনের বদলে প্রভুরা এখন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণ বেশি পছন্দ করছে। সুতরাং গণতন্ত্র নিয়ে বহুমাত্রিক খেলাধুলা পৃথিবীর নানা দেশে চলছে। বাংলাদেশে সে খেলা এখন ভয়ঙ্কররূপ ধারণ করেছে। সুতরাং সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে সংলাপে বসার আহ্বান আর দেশীয় বিজ্ঞ টকশোওয়ালারা দু’নেত্রীকে সংলাপে বসানোর জন্য তত্ত্বের যে তুবড়ি ছোটান অথবা তত্ত্বাবধায়ক নামের ‘স্বর্গীয়’ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েনের আপাত কসরত দেখান- এসবই কথার কথা। শুধুই খেলার ছল। আসল খেলার হদিস করতে হবে জনগণকে। গণতন্ত্রের খেলার পুতুলরা তা কখনই করবে না।
×