ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমিনুর রহমান

কবি ফজল শাহাবুদ্দীন বাংলা কবিতার রাজপুত্র

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কবি ফজল শাহাবুদ্দীন বাংলা কবিতার রাজপুত্র

আজকাল প্রায় প্রতিদিন দুপুরে ২টা আড়াইটার দিকে হঠাৎ করেই যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাই। অসুস্থ হওয়ার আগের ছ’মাস প্রায় প্রতিদিন ঐ সময়টায় ফজল ভাই আমার অফিসে আসতেন। আমি তাকিয়ে থাকি কাঁচের দেয়ালের ওপারে সত্যি যদি তাঁকে দেখা যায়। রুমে ঢোকার আগে কাঁচের দেয়ালের ওপার থেকে একটা হাসি দিতেন। কী চমৎকার এক হাসি। ভোলার নয়। এ হলো আমার ফজল ভাইয়ের সঙ্গে শেষের দিনগুলোর স্মৃতি। প্রায় প্রতিদিন আসার কারণ আর কিছু নয়, কবিকণ্ঠ পত্রিকা বের করা হবে তার উদ্যোগ। কি করে একটা আন্তর্জাতিক কবিতা পাঠ বা সেমিনার করা যায় তার উদ্যোগ। প্রায় প্রতিদিনই বসা হয়, কাজ এগোয় না। একদিন বললাম ফজল ভাই, আজ আর গল্প করা নয়, কবিকণ্ঠের জন্য আপনার লেখা লিখে ফেলুন। ফজল ভাই বললেন, লেখা রাখার বাক্স কই। দুটো বাক্স আনা হলো। নিজ হাতে বাক্সের ওপর লিখলেন ‘কবিকণ্ঠ’। লাল কালিতে লিখে ফেললেন সম্পাদকীয় এক পৃষ্ঠার যা এখনও সেভাবেই বাক্সে গচ্ছিত আছে। কিন্তু আমার প্রিয় ফজল ভাই কই! দাঁড়িয়ে তো নেই। আমাদের সকলকে নিঃস্ব করে দিয়ে চুপ করে চলে গেলেন। পঞ্চাশের দশক বাংলা কবিতার একটি উল্লেখযোগ্য দশক। রবীন্দ্র-উত্তরকালে তিরিশের পর পঞ্চাশ দশকই কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। পঞ্চাশের কবিরা কবিতায় নিজস্ব শরীর স্থাপন করতে পেরেছেন। বাংলাদেশে কবিতা আন্দোলন এবং কবিতা চর্চার পুরোধা পঞ্চাশের কবিরা। তাদের একনিষ্ঠতার কারণে বাংলাদেশের কবিতা একান্তই আমাদের কবিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিশে যায়নি পশ্চিমবঙ্গের কবিতার সঙ্গে। এই ভুবন উন্মোচনকারী কবিদের পথ দেখিয়েছেন চল্লিশের দশকের কবি ফররুখ আহমদ। মূলত তাঁকে সামনে রেখে আমাদের কবিরা চড়াই-উৎরাই পার হয়েছেন, তৈরি করেছেন নিজ নিজ কাব্যভাবনা, কাব্যভাষা এবং প্রকাশভঙ্গি। পঞ্চাশের এই কবিদের অন্যতম কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। কবির কবিতায় আছে- ‘আমি ফজল শাহাবুদ্দীন/জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশের অন্য নাম, কবি/এবং তারুণ্যে লেলিহান। তার কবিতায় রমণীর শরীর ছন্দময় হয়ে উঠেছে, হতে পারে কিন্তু আমি এটাকে ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার মূল সুর বলে ধরে নিতে মোটেই প্রস্তুত নই। আমি বলব তাঁর কবিতা নির্বাক নিমজ্জিত ভুবনের আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ যা শুধু নিজেকে পোড়ায় না, পোড়ায় জাগতিক সকল ক্রিয়াকে। ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা সবসময় স্থির হয়ে থাকেনি। পরিবর্তন এসেছে। তিন চারটি বাঁকের স্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা সহজেই ধরতে পারি। যেমন ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা এবং ‘আকাক্সিক্ষত অসুন্দর’ এরপর প্রথম পরিবর্তন, ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’ এরপর দ্বিতীয় পরিবর্তন, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’র পর তৃতীয় পরিবর্তন এবং সর্বশেষ পরিবর্তন ‘সান্নিধ্যের আর্তনাদ’-এ। তবে সামগ্রিকভাবে ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা একটি আরেকটি থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং আশ্চর্যজনক গাঁথুনি লক্ষ্য করা যায়। বোদলেয়ার, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, ফররুখ এই চার কবির যূথবদ্ধ প্রকাশ কি কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। না, প্রথম দিকে তাই মনে হচ্ছিল ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা, কিংবা ‘আকাক্সিক্ষত অসুন্দর’-এ। কিন্তু তারপর কবি সকল সীমা উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায়। ফজল শাহাবুদ্দীন কবিতা লিখছেন প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। অগ্রজ কবিদের কাব্যভাবনার অনুরণন তাঁর তরুণ মনকে কিছুটা প্রভাবিত করেছে। তবে আকাক্সিক্ষত অসুন্দরের পরে প্রভাব কেটে গেছে। রমণী, একাকিত্ব আর প্রকৃতি ‘তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’র মূল উপজীব্য। নিভৃতে স্বপ্ন বুনেছেন, ডুবে গেছেন তৃষ্ণার বৃষ্টিতে। ‘আকাক্সিক্ষত অসুন্দর’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোও প্রথম কাব্য গ্রন্থের রেশ ধরেই এগিয়েছে একই পথে পরিণতির দিকে। তবে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে মানসিক যন্ত্রণার স্ফুরণ ঘটেছে ‘সিঁড়ির নিচের ওই অন্ধকার অস্পষ্ট খুপরিতে/ছেঁড়া স্যান্ডেলের মতো অকেজো বিপন্ন হয়ে/টিকটিকি আর আরশোলার গন্ধে ভরা অবরুদ্ধ/পৃথিবীতে দেখি বিধ্বস্ত স্বপ্নের মতো সেও পড়ে আছে’ (আমার কলম) অথবা ‘কোন কিছুই আর আমাকে এখন অস্থির করে না/আমি এক মৃত শরীরের মতো পড়ে আছি/অনন্তকালের দিন রাত্রি আশা আকাক্সক্ষা, উত্থান-পতন লোভ হিংসা কাম-আর ভালবাসার/ছিন্নভিন্ন দরোজায়/আমাকে কেউ আর স্পর্শ করে না/আমার সকল অনুভবের মৃত্যু হয়েছে’/(আমার মৃত্যু হয়েছে)-কবিতা দুটো পড়ে মনে হবে কবি জীবনকে উপলব্ধি করেছেন বোদলেয়ারীয় দর্শনে। ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’ ফজল শাহাবুদ্দীনের আরেকটি অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। তিনি রমণী, রমণীর শরীর কবিতার চৈতন্যে এমন এক আধ্যাত্মিক অবয়ব দান করেছেন যা বাংলা কাব্যে নতুন নির্মাণ। সাধারণত কোন এক ‘তুমি’-কে নিয়ে লিখিত হয় কবিতা। কথোপকথনের ধরনও তাই। কিন্তু ফজল শাহাবুদ্দীন ‘তুই’ এবং ‘আপনি’ সম্বোধনে বেশকিছু কবিতা লিখেছেন। প্রথমে পড়তে গেলে কেমন যেন লাগে কিন্তু নতুন ভুবন উন্মোচনে কবিতাগুলো সত্যিই পথিকৃৎ। ‘আপনি এলে আমি আবার কবি হয়ে যাই/ আমি বদলে যাই/ আমার বিস্তীর্ণ বিবর্ণ মরু“তৃষ্ণায় জরাজীর্ণ/ প্রসারিত বনাঞ্চল জুড়ে/ আবার বৃষ্টি নামে/’ (আমি বদলে যাই) অথবা-‘আপনি একটা আস্ত হারামজাদী সে কথা আপনি জানেন এবং আরও জানেন/ আমি আপনাকে ভালোবাসি/-‘প্রেমের কবিতার গতানুগতিক পথ থেকে বেরিয়ে গিয়ে রচনা করেছেন আশ্চর্য উপলব্ধির চমৎকার কবিতাগুচ্ছ। প্রেমকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘যদি ভালবাসতে চাও অন্ধ হও/ যদি ভালবাসতে চাও বধির হও/ যদি ভালবাসতে চাও-/মাতাল হও অস্থির হও উন্মাদ হও জলতে থাকো চিরকাল/’ (যদি ভালবাসতে চাও)। কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, আমাদের প্রিয় ফজল ভাই সারা জীবন কবি ছাড়া আর কিছু হতে চাননি। আজ তাঁর জন্মদিনে তাকে যেন আমরা ভুলে না যাই।
×