ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাশকতা বন্ধে দ্রুত নতুন কঠোর আইন করার দাবি সংসদে

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

নাশকতা বন্ধে দ্রুত নতুন কঠোর আইন করার দাবি সংসদে

সংসদ রিপোর্টার ॥ বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা-সহিংসতা বন্ধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে সামারি কোর্টের মাধ্যমে নাশকতাকারী, পেট্রোলবোমা হামলাকারী এবং তাদের হুকুমদাতাদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে দ্রুত নতুন কঠোর আইন প্রণয়নের প্রবল দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও হরতাল-অবরোধ অব্যাহত রাখায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। রবিবার জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত দীর্ঘ বক্তব্যে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি খালেদা জিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বিষধর সাপের কাছে ছোবল না দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে কোন লাভ নেই। বিষধর সাপকে হয় মারতে হবে, না হয় আটকাতে হবে। চুনোপুঁটি নয়, নাশকতা-সহিংসতার হুকুম-দাতাদের গ্রেফতার করতে হবে। পুড়িয়ে হত্যাসহ বর্বর সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের কঠোরহস্তে দমন করতে হবে। এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও খালেদা জিয়া প্রমাণ করেছেন, তার কাছে দেশ বা দেশের ভবিষ্যত কিছু না, ক্ষমতায় সবচেয়ে বড়। ক্ষমতালিপ্সু ও নরহন্তারক খালেদা জিয়ার নিষ্ঠুরতার জবাব দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবেই দেবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, ১৬ ডিসেম্বরের মতো খালেদা জিয়া ও একাত্তরের ঘাতক জামায়াতকে বিজয়ী বাঙালী জাতির কাছে আবারও আত্মসমর্পণ করতে হবে। দেশের জনগণ আর বক্তৃতা বা আলোচনা নয়, নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ও তাদের হুকুমদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ‘এ্যাকশন’ দেখতে চায়। ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে অনির্ধারিত বিতর্কে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন সরকারী দলের এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, আবদুল মান্নান, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ড. হাছান মাহমুদ, শামীম ওসমান, নুরুল ইসলাম সুজন, এ্যাডভোকেট তারানা হালিম, নুর হাজান বেগম, ওয়ার্কার্স পার্টির বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল ও জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান। বিতর্কের সূত্রপাত করে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ কোমলমতি শিক্ষার্থী ও নিরীহ মানুষের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশবাসীকে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সন্ত্রাস-সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অবরোধ-হরতাল কত দিন চলছে? আমাদের কাছে সেই হিসাব না থাকলেও জনগণের কাছে সেই হিসাব আছে। জনগণ শঙ্কামুক্ত হতে পারছে না, আবার ঘরেও থাকতে পারছে না। ইতোমধ্যে ৪২টি জীবন ঝরে গেছে, শত শত মানুষ হাসপাতালের বেডে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের কারণে এসএসসি পরীক্ষাও পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত কী হবে? পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ স্থগিত করা যেত। উনি (খালেদা জিয়া) তো ছেলে হারিয়েছেন, তার মন ব্যথিত। তবে সত্যিকারের মা হতেন তবে সন্তানহারা ব্যথা থেকে পরীক্ষার মধ্যে হরতাল-অবরোধ স্থগিত করতেন। রওশন এরশাদ বলেন, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার, কিন্তু নাশকতা-সন্ত্রাস কখনও আন্দোলনের ভাষা হতে পারে না। সবাই একসঙ্গে হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, সহিংসতা-নাশকতা বন্ধ করতে হবে। যা প্রয়োজন তাই করতে হবে। সবাই মিলেমিশে পাড়া-মহল্লায় এ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ঈদে মিলাদুন্নবী, বিশ্ব ইজতেমা থেকে শুরু করে এসএসসি পরীক্ষার মধ্যেও হরতাল-অবরোধ দিয়ে খালেদা জিয়ারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেই যাচ্ছেন। দ-িত ফেরারী আসামি কোকোর মৃত্যু পর মানবিকতা ও মাতৃ¯েœহ থেকে সবকিছু ভুলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীকে সান্ত¡না দিতে গিয়েছিলেন। গেট খোলা হলো না। গোটা পৃথিবী স্তম্ভিত হয়ে দেখলো প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যতা দেখানো হলো না। কিন্তু শেখ হাসিনাকে ফেরত যেতে হয়েছে, এই ‘ব্যাটাগিরি’ই শুধু দেখালেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, অনেকেই বলেন খালেদা জিয়া নাকি দলীয় কার্যালয় থেকে নিরাপদে ‘এক্সিট’ (বের হতে) চান। ঈদে মিলাদুন্নবী, বিশ্ব এজতেমা, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আর প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত করতে যাওয়ার এ চারটি ঘটনাতেই খালেদা জিয়ার ‘এক্সিট রুট’ হতো। কিন্তু একটিও উনি গ্রহণ করলেন না। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, খালেদা জিয়ার অবরোধ-হরতালে জনগণ নেই, আছে কিছু সন্ত্রাসী- বোমাবাজ। খালেদা জিয়া হেরে গেছেন, কিন্তু স্বীকার করছেন না। পাকিস্তানী হানাদাররা যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজিত হবেন তখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। ঠিক একই কায়দায় পরাজয় নিশ্চিত জেনেই খালেদা জিয়ারা গোটা দেশের মানুষকে জিম্মি করে পুড়িয়ে হত্যা করছেন। এ সময় স্পীকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া বলেন, এসএসসি পরীক্ষার সময় জাতি আশা করেছিল, ২০ দলীয় জোটের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা পরীক্ষার সময় হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করবে। কিন্তু তা করেনি। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছুই নয়। জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল বলেন, অক্ষমের আস্ফালন যেমন সহ্য করা যায় না, তেমনি শক্তিমানের কান্নাও সহ্য করা যায় না। খালেদা জিয়া সভ্যতা-মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার সকল রেখা অতিক্রম করেছেন। তিনি বলেন, এখন বলাবলি বা আলোচনার সুযোগ নেই। কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না? যে কোন মূল্যে পরীক্ষা নিবেন, তবে পরীক্ষা পিছালেন কেন? বিষধর সর্পের কাছে ছোবল না মারার আবেদন করে কোন লাভ নেই। খালেদা জিয়া এখন গণতান্ত্রিক নেত্রী নন, সন্ত্রাসী নেত্রী হয়ে গেছেন। দেশের আইন-কানুন আছে, অবশ্যই যে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ একটি খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, তবে ইতিহাসে লেখা থাকবেÑ হাতে বোমা নিয়ে, পিঠে বন্দুক নিয়েই ক্ষমতা দখল করা যায়। সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু বলেন, ১৫ লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থীর ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ ডাকায় গোটা জাতি স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। খালেদা জিয়ার ক্ষমতার জন্য গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে যাক, তাতে বিএনপি-জামায়াতের কিছু যায় আসে না। এখনও সময় আছে নাশকতা-সহিংসতা বন্ধ করুন, নইলে ৪২টি খুনের জন্য ৪২টি হত্যা মামলা হবে। আর প্রতিটি হত্যা মামলার প্রধান হুকুমের আসামি হবেন খালেদা জিয়া। সরকারী দলের আবদুল মান্নান বিএনপি-জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, আন্দোলনের নামে সহিংসতা-নাশকতা বিএনপি-জামায়াত জোট করে যাচ্ছে। গোটা জাতি আশা করেছিল, ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করে এসএসসি পরীক্ষার সময় কর্মসূচী স্থগিত রাখতে পারতেন খালেদা জিয়া। কিন্তু তা না করে খালেদা জিয়া অবরোধের সঙ্গে তিন দিনের হরতাল ডাকলেন! এটা কোন রাজনীতি নয়, এটা সন্ত্রাস-নৈরাজ্য। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন খালেদা জিয়া। কোন রাজনৈতিক ইস্যু ছাড়া গোটা দেশের মানুষকে জিম্মি করে, আগুন দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র দেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। এ অপশক্তিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। ড. হাছান মাহমুদ বলেন, খালেদা জিয়া ন্যক্কারজনক মানবতাবিরোধী কর্মকা- ঘটিয়েই যাচ্ছেন। বিএনপি নেত্রী বুঝতে পেরেছেন, দেশ এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে তাঁর কোনদিন আর ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হবে না। এ কারণেই দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে এসব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। সরকারী দলের শামীম ওসমান বলেন, খালেদা জিয়া শুধু দেশের মানুষ নন, আল্লাহর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনেও যিনি হরতাল দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেন, বিশ্ব এজতেমার দিয়েও অবরোধ ডাকেনÑ সেই খালেদা জিয়ার কাছে কোন আবেদন বা অনুরোধ জানিয়ে কোন লাভ নেই। দেশবাসী আর কথা নয়, এবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এ্যাকশন দেখতে চায়। নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, শুধু ৪২টি খুনই নয়, খালেদা জিয়া এখন ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে নেমেছেন। এ্যাডভোকেট তারানা হালিম বলেন, খালেদা জিয়া আগামী প্রজন্মকে হানাদারবাহিনীর মতো মেধাশূন্য করার ষড়যন্ত্র করছেন। এটা মেনে নেয়া যায় না। পেট্রোলবোমা ও নাশকতার বিরুদ্ধে দেশবাসীকে আজ একাত্তরের মতোই গর্জে উঠতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তরুণ প্রজন্ম আজ রাজনীতিবিমুখ হচ্ছেন, এর জন্য প্রধানত দায়ী খালেদা জিয়া। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকারী ও হুকুমদাতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে তিনিও নতুন আইন প্রণয়নের দাবি জানান। সংরক্ষিত আসনের নুরজাহান বেগম বলেন, খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছেন বলেই গোটা দেশের মানুষকে জ্বালিয়ে দেয়ার পণ করেছেন। জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, প্রতিদিন রক্ত ঝরছে, পেট্রোলবোমায় ঝলছে মানুষ মরছে। গোটা জাতি আজ এমন নৃশংসতার বিরুদ্ধে ধিক্কার দিচ্ছে। অবশ্যই দেশকে মৃত্যু উপত্যাকা বানানোর ষড়যন্ত্র রুখতে হবে। সহিংসতার প্রতিবাদে চিকিৎসক এমপিদের মানবন্ধন আজ ॥ চলমান জ্বালাও, পোড়াও, নৈরাজ্য ও সাহিংসতার প্রতিবাদে আজ সোমবার চিকিৎসক সংসদ সদস্যদের ডাকে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হবে। বেলা ১২টা থেকে একটা পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচীতে সকল পেশার মানুষকে অংশগ্রহণের জন্য রবিবার এক বিবৃতিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
×