ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালী কখনও অন্যায় অশুভর কাছে মাথা নত করে না

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাঙালী কখনও অন্যায় অশুভর কাছে মাথা নত করে না

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলতে পারি...। ভাই হারানো, বিয়োগব্যথা ভুলেনি বাঙালী। বিস্মৃত হয়নি অমর একুশের চেতনা থেকে। প্রিয়জন হারানোর শোক আর মায়ের ভাষার শক্তি যেন কোন দিনও ক্ষয় হওয়ার নয়। ফুলের পাপড়ির মতো বিকশিত হচ্ছে বাঙালীর ভাষা সাহিত্য। এই বিকাশের ধারায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতিবারের মতো এবারও ভাষাসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে শুরু হলো লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলনমেলা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রবিবার প্রাণের মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় একুশের শিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্যায় অশুভর কাছে কখনও মাথা নত করে না বাঙালী। সকল অন্ধকার অপশক্তিকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আলোর পথের এ যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বই। বই জ্ঞানের ভা-ার। শিক্ষিত উন্নত জাতি গঠনে পাঠাভ্যাস বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রফেসর এ্যামেরিটাস আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন সংস্কৃতি সচিব ড. রণজিৎ কুমার বিশ্বাস। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেয়া চারজন বিদেশী অতিথিও ছিলেন মঞ্চে। জার্মানীর সাহিত্যিক হান্স হার্ডার, ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য, বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন এবং ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য গবেষক ও ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার অনুষ্ঠানে বাংলায় বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ১৯৫২ সালে বাঙালী বুকের রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব অর্জন করেছে। সেই ভাষাসংগ্রামের স্মৃতি ধারণ করে আছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেলায় কবি লেখক ও সাহিত্যিকরা নিজেদের নতুন নতুন রচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। পাঠকও পছন্দের বই সংগ্রহ করার চমৎকার সুযোগ পান। এবারের মেলার পরিসর অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশের মেলা এখন ঐতিহাসিক সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে, যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একই স্থানে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তানী বাহিনী। মেলায় আসার স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখন প্রায় প্রতিদিনই মেলায় আসতাম। নিজের মতো করে ঘুরে বেড়াতাম। বই কিনতাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হতো। কিন্তু সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পর সে সুযোগ সংঙ্কুচিত হয়ে গেছে। যারা বইমেলায় প্রতিদিন আসেন, বই কেনেন, ঘুরে বেড়ান তাদের দেখে কিছুটা হিংসাই হয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তাদের মতো স্বাধীনভাবে মেলায় ঘুরে বেড়াতে পারি না। বইয়ের প্রতি নিজের অনুরাগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন, সময় বের করে বই পড়ি। বই মনের খোরাক। বই না পড়ে কেউ কিভাবে থাকতে পারে তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেন। বই জীবনকে গড়ে তোলার সুযোগ করে দেয়। দেশ-বিদেশকে জানার সুযোগ করে দেয়। বিদেশী অতিথিদের কথা ॥ অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা যোগ করে বিদেশী অতিথিদের উপস্থিতি। বিভিন্ন দেশের নাগরিক হলেও সকলেই বাংলায় চমৎকার আলোচনা করেন। উপস্থিত সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাদের বক্তব্য শুনেন। জার্মানীর সাহিত্যিক হান্স হার্ডার বলেন, বইয়ের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে। সম্ভাবনা অনেক। বই মানুষকে বদলাতে পারে। ফরাসি লেখক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য বলেন, বাংলা ভাষার মাধুর্য অতুলনীয়। বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলা ভাষার মর্যাদা আরও বেড়েছে। এখন এ দেশেও প্রচুর বাংলা পুস্তক অনুবাদ হচ্ছে। বেলজিয়ামের সাহিত্যিক ফাদার দ্যতিয়েন বলেন, বাঙালীর বায়ান্নর আবেদন আমাদের প্রাণে দাগ কেটেছে। একাত্তর সালে প্রথম শুনেছি মধুর নামÑ মুজিব। রবীন্দ্রসঙ্গীত ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা গানটির কয়েক চরণ শুনিয়ে উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করেন তিনি। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য গবেষক ও ভাষাবিদ ড. পবিত্র সরকার একুশের মেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান ॥ এদিন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। কবিতায় এ বছরে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন শিহাব সরকার, কথাসাহিত্যে জাকির তালুকদার, প্রবন্ধে শান্তনু কায়সার, গবেষণায় ভূঁইয়া ইকবাল , মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এবং শিশুসাহিত্যে খালেক বিন জয়েনউদ্দীন। বিজয়ীদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকার পাশাপাশি সনদপত্র ও স্মারক প্রদান করা হয়। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখন প্রধানমন্ত্রী। বইপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী এ সময় বেশকিছু বই পছন্দ করে কেনেন। এরপর সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে গোটা আয়োজন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল বাঙালী। রফিক শফিক বরকত জব্বারের তাজা রক্ত গড়েছিল নতুন ইতিহাস। তাঁদের রক্তে নতুন প্রাণ পায় আমরি বাংলা ভাষা। ভাই হারানোর এ ব্যথা আর রাষ্ট্রভাষা বাংলার গৌরব ধারণ করেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। শুরুটা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
×