ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেএম এনায়েত হোসেন

অভিমত ॥ নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস...

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অভিমত ॥ নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস...

ইংরেজী সাহিত্যের প্রাচীনতম মহাকাব্যের নাম বেউলফ। এ কাব্যের তৃতীয় এবং শেষাংশে এক দানব কর্তৃক আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানোর কাহিনী বিবৃত হয়েছে। ঘটনার বিবরণ সংক্ষেপে এরূপ: প্রাচীনকালে আধুনিক সুইডেনের অন্তর্ভুক্ত গীটল্যান্ড নামে এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের রাজা সত্তরোর্ধ মহাবীর বেউলফ, যার নামে মহাকাব্যটির নামকরণ করা হয়েছে। তিনি যখন টগবগে যুবক তখন বর্তমানের ডেনমার্ক দেশটির রাজা ছিলেন হ্রদগার। তাঁর রাজ্যটি আক্রান্ত হয়েছিল প্রবল পরাক্রান্ত দুর্ধর্ষ এক দানব দ্বারা, যার নাম ছিল গ্রেনডেল। তার অত্যাচারে অসংখ্য মানুষের জীবনহানি ঘটছিল এবং রাজ্যের মূল্যবান সম্পত্তি বিনষ্ট হচ্ছিল। তাকে প্রতিরোধ করতে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে হতাশার এক নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছিল দেশটি। এ খবর জানতে পেরে দূরবর্তী দেশের বেউলফ পৌঁছালেন ডেনমার্কে। জীবনবাজি রেখে পরাজিত করলেন গ্রেনডেলকে। সন্তান হত্যার প্রতিশোধে এবার মরিয়া হয়ে উঠল তার মা। বেউলফকে আবারও নামতে হলো জীবন বাজি রাখা যুদ্ধে। পরাস্ত এবং নিহত হলো গ্রেন্ডেলের মা। অতঃপর বেউলফ ফিরে এলেন নিজ দেশে মহাবীরের খ্যাতি আর প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে। এক সময় নিজ দেশের রাজা হলেন বেউলফ। সম্মান, সুখ্যাতি আর বীরের মহিমায় দেশ শাসন করলেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে। এমনি অবস্থায় তাঁর নিজ রাজ্যের ওপর নেমে এল এক প্রাণবিনাশী ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। আবির্ভূত হলো যমদূতসম এক ড্রাগনÑ ফায়ার ড্রাগন। মারণাস্ত্র হিসেবে সে নিঃশ্বাস এবং মুখ দিয়ে ছুঁড়ে মারে প্রকা- আকৃতির সব অগ্নিগোলা। পুড়ে ছারখার হয় মানুষ, সম্পদ আর জনপদ। তার ধনাগার থেকে মণিমুক্তা আর রতœখচিত একটি কাপ নাগরিকদের কেউ একজন নিয়ে আসায় তার প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হয়। দুর্দান্ত শক্তিশালী সে দানবের মোকাবেলায় ক্ষণকালও তিষ্ঠাতে পারে না বীরদের সেরা বীরপুরুষও। সমগ্র রাজ্য ভারি হয়ে ওঠে পোড়া মানুষের অসহায় আর্ত হাহাকারে। নিক্ষেপিত আগুনের লেলিহান শিখা ভীত, সন্ত্রস্ত, অসহায় আর কম্পমান করে তোলে গোটা জনপদকেই। এমনি দুর্যোগে নিজের জীবনহানির প্রবল আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সত্তরোর্ধ রাজা বেউলফ সিদ্ধান্ত নেন এই অগ্নি-দানবকে মোকাবেলার। লক্ষ্য, তাঁর জনগণের মুক্তি। প্রচ- যুদ্ধে ফায়ার ড্রাগন নিহত হলো বটে কিন্তু রাজাও মারাত্মক জখমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। রাজ্য শাসনের ভার দিয়ে গেলেন একমাত্র বিশ্বস্ত তরুণ সহযোগী উইগ্লাফের উপর। আজকের বাংলাদেশ যেন সেই প্রাচীনকালের গীটল্যান্ড রাজ্যের এক জীবন্ত প্রতিবিম্ব। এখানে আজ অগ্নিগোলায় নিরীহ মানুষ পুড়ছে, যানবাহন পুড়ছে, পুড়ছে মানবতা। একনাগাড়ে প্রায় এক মাস ধরে চলছে মনুষ্যসৃষ্ট আগুনের পৈশাচিক তা-বলীলা। ইতোমধ্যে মারা গেছেন অনেকেই। অসংখ্য মানুষ পোড়া শরীরের তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালগুলোর বেডে, মেঝেয়। কবে শেষ হবে এ নারকীয় উল্লাস তা বোধের অগম্য। এর সূত্রপাত হয়েছে বিএনপির তথাকথিত অবরোধ আন্দোলনের সূচনা থেকে। বাংলাদেশের দুটি বড় দল। একটি আওয়ামী লীগÑ বর্তমানে ক্ষমতায়, অপরটি বিএনপিÑ ক্ষমতার বাইরে। তাদের মধ্যে বৈরিতা আছে, থাকবে, জন্মসূত্রের ঐতিহাসিক কারণেই। সেজন্য সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে কয়লা বানানো হবে কেন? কেন তথাকথিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যূপকাষ্ঠে বলি হবে নিরীহ জনসাধারণ? এটা কোন দেশী গণতন্ত্র? আব্রাহাম লিংকনের মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব যখন মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়ধৎঃু, নু ঃযব ঢ়ধৎঃু, ভড়ৎ ঃযব ঢ়ধৎঃু হয়ে ওঠে সেই গণতন্ত্রের আমরা নিকুচি করি! আমরা চাই না সেই গণতন্ত্র !! একটু পেছন ফিরে ঘটনার শুরুটা সংক্ষেপে দেখা যাক। বিএনপি বিরামহীন বলে আসছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবৈধ। কেননা তা তাদের চাওয়া মাফিক কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে হয়নি। অতএব, কেয়ার টেকার অথবা সেই জাতীয় একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতা থেকে নেমে যেতে হবে। এ দাবি একবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত, বালখিল্যতাপ্রসূত এবং ধোপে টেকার নিতান্তই অযোগ্য। দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁর রায়ে কেয়ার টেকার সরকারের কার্যকারিতারহিত করে বলেছেন, তবে পার্লামেন্ট চাইলে আরও দুই টার্ম তা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। পার্লামেন্ট চায়নি এবং পার্লামেন্টকে দিয়ে তা চাওয়ানোর জন্য তখনকার একজনও বিএনপি সদস্যের ক্ষীণকণ্ঠ সেদিনের পার্লামেন্টে উচ্চারিত হতে শোনেনি দেশবাসী। এমনকি তারা সেখানে উপস্থিত থেকে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ওয়াক আউট করলেন না কিংবা সংসদে আপত্তি জ্ঞাপক কোন বক্তব্যও রেকর্ড করালেন না। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের রায় না মেনে কোন আইনী উপায় ছিল কি? বিএনপির এবং কতিপয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে আর একটি কথা হরহামেশাই উচ্চকিত কণ্ঠে বলা হয়ে থাকে। আর তা হলো ৫ জানুয়ারির নির্বচন প্রসঙ্গে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এটি সংবিধানের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। তা হয়ে গেছে। তা হলে এখন তিনি কেন বিএনপির কাক্সিক্ষত নিয়ম ভাঙ্গার নির্বাচনটি দিচ্ছেন না? এখানে বলতেই হয় যে, কারও কথার অংশ বিশেষ গ্রহণ এবং অংশ বিশেষ বর্জনের মধ্যে সত্য অস্বীকারের একটি ভ-ামি পরিলক্ষিত হতে বাধ্য। ২০১৩ সাল জুড়ে বিএনপি নির্বাচনী আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী জ্বালাও পোড়াও এর যে মহোৎসবে মেতেছিল এবং সে নির্বাচনকে ভ-ুল করার জন্য যে মানুষ মারার মহাযজ্ঞে নেমেছিল তা থেকে বিরত থেকে সবার অংশ গ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচনের প্রস্তাবনা রেখেছিলেন শেখ হাসিনা এবং তার প্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্বাচনী সমস্যার সমাধানের কথা বলেছিলেন। বিএনপি কি সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে জ্বালাও পোড়াও থেকে বিরত থেকেছিল? উল্টো তারা সে নির্বাচনকে কেবল বর্জনই নয়, বরং শক্তি প্রয়োগে তা প্রতিহত করার ডাক দিয়ে মানুষসহ গবাদি পশু হত্যা করে, শত শত যানবাহন, অসংখ্য স্কুল ঘর পুড়িয়ে, রাস্তার পাশের লাখ লাখ টাকার গাছ কেটে ফেলে নৃশংসতা আর সহিংসতার মহোৎসবে মেতে উঠেছিল। তারা যদি সেদিনের প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে নির্বাচনটি হতে সহযোগিতা করতেন তা হলে তাদের পরবর্তীতে চাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনটি যৌক্তিকতা পেতে পারত। তা না করে শক্তি প্রয়োগে বেআইনী দাবি আদায়ের নামে যে নারকীয় তা-ব ঘটাল তারপরে কি আর প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের বক্তব্যের গ্রহণীয়তার কিছু অবশিষ্ট থাকে? তারা আর একটি কথাকে প্রায় ধুয়ায় পর্যবসিত করেছেন। আর তা হলো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩ জন সদস্যই বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং বিদেশীরা কেউই এই নির্বাচনকে গ্রহণ করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় নির্বাচিত হলে কেউ পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারেন না এমন বিধান আমাদের শাসনতন্ত্রের কোথাও অছে কিনা তা আমাদের জ্ঞানের অগম্য। আর বিদেশীদের সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়টিও আমাদের সংবিধানের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমাদের মনে হয় না। বিদেশীরা আমাদের প্রভু বা মুরব্বি এই ঔপনিবেশক আমলের মানসিকতা অতি অবশ্যই নিন্দার্হ বটে। যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা একটি জাতিকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, বিদেশীরা আমাদের উন্নয়ন-সহযোগী, কেবল তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার তাগিদেই। এর অতিরিক্ত কিছুই নয়। এ সত্যটির গায়ে আবর্জনার লেবাস পরিয়ে গদগদ হওয়ার মধ্যে হীনম্মন্যতা এবং নিজেদের মানহানি ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না। অবরোধকালীন নিষ্ঠুর নির্মম সহিংসতার প্রেক্ষিতে একদল তথাকথিত নিরপেক্ষ বাচনজীবী ইনিয়ে বিনিয়ে বলছেন, দু’দলেরই সংলাপে বসা খুবই জরুরী এবং এ ক্ষেত্রে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বক্তব্যের সুরে মনে হবে সরকারের সেভাবে এগিয়ে না আসার কারণেই এমনিভাবে মানুষ পোড়ানো হচ্ছে যার দায় সরকারের উপরই বর্তায়। ভাবটা এমন যেন সরকারের উপর এই কাজটি করা সাংবিধানিকভাবে একান্তই বাধ্যকর এবং তা করতে সরকার অহেতুক গড়িমসি করে অযথাই কালক্ষেপণ করছে। কিন্তু তারা বিএনপির নিরীহ সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারার এবং দেশের সম্পদ বিনষ্ট করার কাজটির কোন আইনগত কিংবা নৈতিক ভিত্তি আদৌ আছে কি-না সে প্রশ্নটি বাকচাতুর্যের মাধ্যমে এড়িয়ে যান। নেহাৎ কোন নাছোড়বান্দা সাংবাদিক যুক্তির জালে আটকে ফেললে এটাকে ‘কো-লেটারাল ড্যামেজ’ বলে পার পাওয়ার অপচেষ্টা করেন। ঘোষিত যুদ্ধ ছাড়া কো-লেটারাল ড্যামেজের বিষয়টি যে নিতান্তই অবান্তর সে কথা কে কাকে বোঝাবে? তারা বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে আওয়ামী লীগকে ওয়াক ওভার দিয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থা থেকে ছিটকে পড়ার বিষয়টি আদৌ আমলে আনতে ভুলে যান এবং সরকারকে বার বার সংলাপে বসার তাগাদায় জাবর কাটতে থাকেন। আসলে এসব বাচনজীবী তথাকথিত নিরপেক্ষতার ভান করে একচোখা হরিণের মতো অন্যায়, অনৈতিকতা আর অযৌক্তিকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকতে অধিকতর স্বস্তি বোধ করেন। তারা গাছেরটাও কষ্ট করে পেড়ে খেতে চান না, আবার তলারটাও কুড়িয়ে খাবার কষ্ট করতে চান না। কেবল বাচন ব্যবসায় থেকে কোন অদৃশ্য ঝড়ের অপেক্ষায় সময় গুনতে থাকেন। দেশের চলমান নারকীয় পরিস্থিতিতে সরকারের উপর একটি দায় অত্যন্ত ভারি হয়ে চেপে বসেছে। আর তা হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দানের যথোচিত ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। এটি করার শপথ নিয়েই তারা ক্ষমতায় বসেছেন যেমন শপথ নিয়ে বসেছিলেন প্রাচীনকালের রাজা বেউলফও। সে ক্ষমতার প্রয়োগ আরও প্রলম্বিত হলে দেশ এবং মানুষ যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে সে দায় সরকার কোন ভাবেই এড়াতে পারবেন না। অতএব, সাধু সাবধান! লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
×