ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোজাম্মেল খান

আন্দোলন জনগণের জন্য না জনগণের বিরুদ্ধে?

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আন্দোলন জনগণের জন্য না জনগণের বিরুদ্ধে?

গণতন্ত্রের সবচেয়ে বহুল উদ্ধৃত সারাংশ নেয়া হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই ঐতিহাসিক গ্যাটিসবার্গ বক্তৃতা থেকে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক সরকার হলো এমন এক ব্যবস্থা যেটা “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত এবং জনগণের জন্য পরিচালিত।” অবশ্য গণতন্ত্র কোন সময় বিপন্ন হলে কিভাবে সেটা পুনরুদ্ধার করতে হয় সে পদ্ধতি প্রেসিডেন্ট লিংকন তাঁর ওই বক্তৃতায় আমেরিকান জনগণকে বলে যাননি। বাংলাদেশের জনগণ অবশ্য দুই দুইবার এ কাজটি সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে। প্রথমবার ঘটেছে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের পতন ঘটে। এরপর একই ধরনের গণবিস্ফোরণে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সরকারের পতন ঘটে ঐ বছরের এপ্রিল মাসে। এই উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা বিনামূল্যে আসেনি। বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এ আন্দোলন। তবে উভয় ক্ষেত্রেই যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই ছিল রাজনৈতিক কর্মী, যারা দুঃখজনকভাবে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের হিংস্রতার শিকার হয়েছিলেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচন প্রক্রিয়া লাইনচ্যুত করার আন্দোলনে চালু করা হয়েছে নিরীহ মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে পুড়িয়ে মারার এ পাশবিক পদ্ধতি। নৃশংসতার নিকৃষ্টতম পদ্ধতি পেট্রোলবোমা দ্বারা যে সমস্ত নিরীহ মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে তাঁরা কোন আনন্দ ভ্রমণের জন্য বাইরে বের হননি, নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে বাইরে বেরিয়েছিলেন বা দিনেরবেলা তথাকথিত অবরোধের পর রাতেরবেলা বাসের ভেতর ঘুমানো অবস্থায় তাদের পেট্রোলবোমা মেরে হত্যা করা হয়। মনির নামে যে ছেলেটি ঢাকায় এসেছিল নতুন বছরে স্কুলের জন্য জামা কিনতে; সেই ১৪ বছর বয়সী সারা শরীর পোড়ার যন্ত্রণাদায়ক ছবির পাশে বসা তার পিতার হৃদয়বিদারক ছবি এখনও লাখ লাখ মানুষের চোখে অশ্রু এনে দেয়। একটি রাজনৈতিক দল যখন একটি রাজনৈতিক ভুল এবং বিশেষ করে সেটা যদি মারাত্মক ভুল হয় তবে তার জন্য অবশ্যই সে দলকে একটা রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে। বিএনপি জোট যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্¯’াপনের আন্দোলন করছে সেটার মূলতত্ত্ব যে তারা নিজেরাই ধ্বংস করেছিল সেটা যাঁদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল নয় তাঁরা অবশ্যই ভুলে যাননি। একটা নয়, দুইটা নয়, সংবিধানের তিন তিনটি ধারা লঙ্ঘন করে ইয়াজউদ্দিন সাহেবকে প্রধান উপদেষ্টা করার মতন বড় ছলচাতুরি আর কি হতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, সম্পূর্ণ সাংবিধানিক উপায়ে, সেটা যত অনাকাক্সিক্ষতই হোক না কেন, সংবিধান থেকে ঐ ব্যবস্থা বাদ দিয়েছে। আশার আলো দেখা দিয়েছিল যখন সে সময়ের ক্ষমতাসীন জোট একটা মধ্যপথের মাধ্যমে গত সাধারণ নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব আনে। এটা হাওয়া ভবন পরিচালিত ইয়াজউদ্দিন সরকারের সময়কার অন্ধকার পরিস্থিতির বিপরীতে ছিল একটা সুন্দর প্রস্তাব যেখানে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর বাইরে প্রধান বিরোধী দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রিত্ব দরকষাকষির মাধ্যমে আদায় করার একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা ছিল, যেটা নির্বাচনের ফলাফল কোন সম্ভাব্য নির্ধারণের বিপক্ষে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হতে পারত। এই মাসের শুরুর দিকে একজন বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী সেই ব্যবস্থার কথাই উল্লেখ করেছেন এবং একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, যার পার্টি বিকল্পধারা বাংলাদেশ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনরত, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে রেখেই সে সরকারের অধীনে সংগঠিত একটি সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে, বিএনপি প্রধান ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক টেলিফোন কলে হরতাল প্রত্যাহার করে আলোচনায় বসার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সে সম্ভাবনার কবর রচনা করেছিলেন। টেলিফোনে বিএনপি প্রধানের চরম শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণের কথা নাইবা উল্লেখ করা হলো। আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে, বিএনপি জোট শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ নয়, তাদের সর্বাগ্রে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে যেতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু, সম্ভবত, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঙ্গনে সরকারের প্রত্যাশার উপরে পারফরম্যান্স করার কারণে এবং গত এক বছরের মধ্যে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কারণে মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করা এক দুরূহ কাজ হবে। তদুপরি এ মানুষ পোড়ানোর আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে নেয়া কয়েকটা জরিপে সরকারের যে অনুমোদন রেটিং বেরিয়ে এসেছে সেটা সরকারকে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। একটা জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ মানুষ সরকারের সাফল্যকে অনুমোদন দিচ্ছে। মাত্র ৩৫ শতাংশ একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৮০০-এর অধিক যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন এবং মৃতের সংখ্যা ৪০। একজন সংবাদকর্মীর রিপোর্টের বর্ণনায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জনাকীর্ণ বার্ন ইউনিট ক্রন্দন, আর্তচিৎকার আর গগনবিদারী আহাজারি, মানুষের চামড়া এবং মাংসের পোড়া গন্ধে ভরে উঠেছে। প্রায় ৬০ জন পোড়া মানুষকে এখানে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ‘আমি আমার ভাগ্যের জন্য কাকে দায়ী করব,’Ñবার্ন ইউনিটে কয়েক শত মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন কান্নাজড়িতকণ্ঠে বলেন আবুল হোসেনের স্ত্রী। ‘তিনি আমাদের খাইয়ে বাঁচানোর জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। এখন তিনি তাঁর নিজের জীবনের জন্য যুদ্ধ করছেন। আল্লাহ তুমি এদের বিচার করো,’ Ñঅভিশাপের ভাষায় বললেন তিনি। নৃশংসতার এক শিকার যাত্রাবাড়ীর নূর আলমের ৪৮ শতাংশ শরীর পুড়ে গেছে। তার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। নূরের আত্মীয় মিন্টু মিয়া তার ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এই বলে, ‘কে এই হরতাল এবং অবরোধ আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, এর উদ্দেশ্য কি? এ সমস্ত হরতাল বা অবরোধ থেকে আমাদের মতন সাধারণ মানুষের কি উপকার হবে? জীবনধারণের জন্য আমাদের বাড়ির বাইরে যেতে হবে। আমরা শান্তিতে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের শান্তিতে বসবাস করতে দিন।’ ফরিদপুরের সেই অন্ধ মায়ের রোদনে যে কোন মানুষের বিবেক প্রকম্পিত হবে, যে মা তার একমাত্র সন্তান, ১৮ বছর বয়সী সোহাগকে হারিয়েছেন। বাসের সাহায্যকারী সোহাগকে বরিশালে জীবিত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত অবরোধে সাধারণ মানুষ কি ধরনের নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন এটা তার কিঞ্চিত ঝলক মাত্র। ‘এ ধরনের অস্থিরতা দরিদ্র মানুষদের জন্য এক মরণ ফাঁদ’, বললেন জ্যোৎস্না দাস। তারা [রাজনৈতিক দল] ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ করে আর আমরা মূল্য পরিশোধ করি ... এই হরতাল এবং অবরোধ আমাদের দুর্দশা ও দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই আনতে পারে না। এ ছিল জ্যোৎস্না দাসের ক্ষেদোক্তি। খেটে খাওয়া দিনমজুরদের এ চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট কিভাবে তাদের জীবন ধারণে আঘাত করছে সে নিদারুণ হতাশারাই প্রকাশ পেয়েছে তার ক্ষেদোক্তিতে। ‘ছেঁড়া টুকরো তাদের স্বপ্ন’, একটি সংবাদপত্রের ক্যাপশন। বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে একটি অগ্নিসংযোগের শিকার ২৪ বছর বয়সী রুবেল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার জীবনের জন্য যুদ্ধ করছে। অবশ্য বিএনপি নেত্রীসহ ঐ দলের সব নেতা এসব নৃশংসতাকে সরকারের কাজ হিসেবে অভিহিত করছেন। যে দলের নেত্রী ১৫ আগস্টে নিজের কল্পিত জন্মদিন হিসেবে পালন করেন, চরম ভারত বিদ্বেষ যে দলের অন্যতম অবলম্বন, সে দল ভারতের একটি ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতার টেলিফোন করা সম্পর্কে মিথ্যাচার করতে পারেন এবং সর্বোপরি আমেরিকান কংগ্রেসের ছয় সদস্যের স্বাক্ষর জাল করে বিবৃতি দিতে পারেন তাদের পক্ষে কোন মিথ্যাচারই অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ব্যবসাবাণিজ্য খাত। শুধু বাণিজ্য খাত নয়, সর্বোপরি সাধারণ জনগণের মনোভাব প্রতিধ্বনিত হয়েছে আমেরিকান চেম্বার সভাপতি আফতাব উল ইসলামের দেয়া এক সাক্ষাতকারে, যেখানে তিনি উপসংহার টেনেছেন এভাবে, ‘রাজনীতির ওপর থেকে মানুষের আস্থা চলে গেছে। গণতন্ত্রের কোন অর্থ নেই মানুষের কাছে। মানুষ চায় শান্তি, স্বস্তি। তাই মানুষকে গণজাগরণের জন্য মাঠে নামতে হবে। আর কোন পথ আমার জানা নেই।’ প্রকৃতপক্ষে, সর্বস্তরের মানুষ এ পরিস্থিতি কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতায় আশাহত, বিশেষ করে মানুষকে নির্বিচারে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা, তাদের দৈনন্দিন রুটি রোজগার অর্জনে বাধা দেয়া, এমনকি তাদের অতি জরুরী প্রয়োজনীয় চলাফেরায় বাধা দেয়া; যেটা কিনা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মৌলিক উপাদান। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন, যেটাকে তারা গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করেছে, সেটা জনগণের জন্য না হয়ে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার
×