ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৩১ জানুয়ারি ২০১৫

বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়

২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত অর্থ দেশে ব্যবহারের ওপর প্রশংসনীয়ভাবে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপটি সম্পাদিত হয়েছিল ২০১৩ সালে ১৩-২৩ জুনে। দৈবচয়ন সারাদেশে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল বলে এই জরিপে প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ সারাদেশের প্রতিনিধিত্বমূলক বলে গ্রহণ করা যায়। এও বলা দরকার যে, ২০১৩ পর ২০১৪-এর মধ্যে বিদেশে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের সংখ্যা ও আয়ের তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। সমকালে পৃথিবীর সকল দেশের মধ্যে বিদেশ থেকে সর্বাপেক্ষা বেশি আয়, বার্ষিক ৬৭.২৬ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার আসে ভারতে। এর পরের স্থানে রয়েছে চীন (বার্ষিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার ৫৭.৭৮ বিলিয়ন ডলার)। বাংলাদেশের স্থান ৮-এ (বার্ষিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ১৪.০৯ বিলিয়ন ডলার) যা পাকিস্তানে আসা শ্রমিক প্রেরিত আয় থেকে (বার্ষিক ১৪.০১ বিলিয়ন ডলার) প্রান্তিকভাবে বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ সালে বাংলাদেশে বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় ছিল ৮.৯৪ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার অর্থাৎ ৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশে শ্রমিক প্রেরিত আয় বেড়েছে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ। এই মাত্রায় বাড়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য গৌরবজনক অর্জন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অনবদ্য অবদান হিসেবে বিবেচ্য। তথাপিও এ কথা স্মরণযোগ্য যে, বাংলাদেশ এই সময়ে ভারতে বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়ের মাত্র শতকরা ২১ ভাগ এবং চীনে তেমনিভাবে বিদেশ থেকে চীনা শ্রমিক প্রেরিত আয়ের শতকরা ২৪ ভাগ অর্জন করে থাকে। সমকালীন প্রেক্ষিতে আশা করা যায় যে, দেশের অভ্যন্তরে মজুরি মাত্রা বাড়ার ফলে আগামী ১০ বছরে চীন ও ভারত থেকে বিদেশে প্রেরিত শ্রমিকের সংখ্যা আনুপাতিকভাবে কমে যাবে এবং বাংলাদেশের মতো দেশসমূহ থেকে বিদেশে প্রেরণীয় শ্রমিকের বাজার অধিকতর বিস্তৃত হবে। ১৯৯৫ সালে উরুগুয়ে দফার বাণিজ্য আলোচনার ফলশ্রুতি অনুযায়ী বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার পোষকতায় সেবা ক্ষেত্রে বাণিজ্য সম্পর্কিত যে সাধারণ চুক্তি বলবত হয়েছে তার আওতায় অনুরূপ বিস্তৃতি ঘটার পরিধি নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে শ্রমিক রফতানি শুরু হয়। বর্তমানে সরকারী হিসাব অনুযায়ী ৮৬ লাখ বাঙালী শ্রমিক বিদেশে কাজ করেন। এই হিসাবে যদি অবৈধ শ্রমিকের সংখ্যা আনা হয় তাহলে বলা চলে যে, সমকালে বিদেশে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকের সংখ্যা ন্যূনপক্ষে এক কোটি। সরকারী হিসাব মতে, বিদেশ থেকে এসব শ্রমিক প্রেরিত আয়ের সমকালীন বার্ষিক পরিমাণ ন্যূনপক্ষে ১৪.১৮ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার যা বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের শতকরা ২৩.২৪ ভাগ এবং সার্বিক রফতানি আয়ের প্রায় শতকরা ৪৯ ভাগ। শ্রমিক প্রেরিত আয়ের এই আনুষ্ঠানিক বা অফিসিয়াল হিসাবের বাইরে এখনও বিদেশে কর্মরত দশভাগ শ্রমিক হুন্ডির মাধ্যমে তাদের অর্জিত আয় দেশে পাঠিয়ে থাকেন বলে এই জরিপে বিদিত হয়েছে। লিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের যথাক্রমে শতকরা ২৬ ও ৩৭ ভাগ হুন্ডিতে বাংলাদেশে অর্থ প্রেরণ করেন। এসব হিসাবে নিয়ে এ কথা বলা চলে যে, এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক প্রেরিত বার্ষিক আয়ের ওপরে শতকরা ১০ ভাগ দেশে হুন্ডির মাধ্যমে আসে অর্থাৎ বাংলাদেশে শ্রমিক প্রেরিত আয় ন্যূনপক্ষে বার্ষিক ১৫.৬০ বিলিয়ন যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার। অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণে রফতানি ও বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থায়নের ২ প্রধান অনুঘটক হিসেবে বিবেচ্য। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ধরলে বলা চলে যে প্রতি ১৬ জন লোকের বিপরীতে একজন বিদেশে কর্মরত আছেন। নিতান্ত কম সংখ্যার বিবেচনায় যদি বিদেশে কর্মরত মহিলাদের (শতকরা ২.৬ ভাগ) হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয় তাহলে বলা চলে যে, দেশে ৮ কোটি পুরুষের মধ্যে এক কোটি পুরুষ অর্থাৎ প্রতি ৮ জন পুরুষের বিপরীতে একজন পুরুষ বিদেশে কর্মরত আছেন। বাস্তবতার নিরিখে এই লোকসংখ্যার হিসাব থেকে তেমনি ১৫ বছরের কম শিশুদের যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে যে, প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের বিপরীতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিক রয়েছেন একজন। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকগণ যদি এই হিসাব মতে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ শ্রমিকদের এক-চতুর্থাংশ হন তাহলে বিদেশে প্রেরণীয় অনুকূলতম শ্রমিক সংখ্যা জাতিগতভাবে আমাদের সর্বাত্মক সচেতনতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে। অধিকতর আয় অর্জনের অভিযানে এ সত্যটি সম্ভবত আমরা এ পর্যায়ে উপলব্ধি করছি না। জরিপে দেখা গেছে যে বিদেশে কর্মরত বাঙালী শ্রমিকদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠরা পুরুষ (শতকরা ৯৭.৪ ভাগ)। এদের মধ্যে শতকরা ৬৩ ভাগ ৩৫ বছরের চেয়ে কম বয়সের। এর অর্থ দেশের যুবশক্তির এক বিরাট অংশ প্রতি ৩ জন যুবকের মধ্যে ১ জনেরও বেশি বিদেশে কাজ করেন। বিদেশে কর্মরত সকল বাঙালী শ্রমিকের মধ্যে মাত্র শতকরা ২.৬ ভাগ মহিলা। এদের মধ্যে আবার শতকরা ৭০ ভাগ ৩৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী। এ প্রেক্ষিতে দেশ থেকে বহির্বিশ্বে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে প্রেরণীয় মহিলা শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ানোর সমকালীন প্রচেষ্টার সঙ্গে তাদের নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার সুযোগ দিতে সচেষ্ট থাকতে হবে। আলোচনাধীন জরিপে দেখা গেছে যে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা ৬২ জন এসএসসি পর্যায়ের নিচে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এদের মধ্যে পেশাগত যোগ্যতা আছে শতকরা মাত্র ২.৪১ ভাগের। বিদেশে কর্মরত মাত্র শতকরা ১২ ভাগ শ্রমিকদের কোন রকম কারিগরি প্রশিক্ষণ রয়েছে। এর অর্থ, কার্যকরণ সূত্রানুযায়ী বিদেশে প্রেরিতব্য শ্রমিকদের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কাঠামোকে যথা প্রয়োজন প্রযুক্ত করতে হবে। বলা বাহুল্য, সমকালে দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সঙ্গে বিদেশে প্রেরণীয় শ্রমিকদের পেশাগত যোগ্যতা সংশ্লিষ্ট করানোর কেন ফলশ্রুত যোগসূত্র এখনও স্থাপিত করা হয়নি। জরিপে এও দেখা গেছে যে, বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের বা শ্রমিকদের মধ্যে যাদের পেশাগত যোগ্যতা আছে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কানাডা, জাপান, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে কাজ করছেন। পেশাগতভাবে যোগ্যতাবিহীন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যে এবং সেজন্য এসব দেশে অন্যান্য দেশ থেকে আগত শ্রমিকদের তুলনায় এদের মাথাপিছু আয় কম। জরিপে দেখা যায়, বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত অর্থপ্রাপ্ত পরিবারের শতকরা ৪৮ ভাগ প্রধান মহিলা। দেশের সকল গৃহস্থালির শতকরা ১৬ ভাগের প্রধান মহিলা। এতে বোঝা যায় যে, পুরুষের অনুপস্থিতিতে মহিলা পরিবারের প্রধান হয়েছেন সত্য কিন্তু এর সঙ্গে এও বোঝা প্রয়োজন যে এই প্রক্রিয়ায় পরিবারের প্রধান হিসেবে মহিলারা সমাজে নিজেদের নেতৃত্ব বা প্রভাব বিস্তারণের সুযোগ শ্রমিক প্রেরিত অর্থপ্রাপ্ত পরিবারের বেলায় অধিকতর মাত্রা বা সংখ্যায় পাচ্ছেন। প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায় যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালিদের শতকরা ৭৮ ভাগের ক্ষেত্রে এরূপ অর্থই পরিবারের প্রধান আয়। জরিপে এও দেখা গেছে যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালিসমূহ আপেক্ষিকভাবে সাক্ষরতার হিসেবে, ভূমি মালিকানার নিরিখে এবং নিরাপদ পানি প্রাপ্তির বিবেচনায় দেশের অন্যান্য গৃহস্থালির তুলনায় উঁচুপর্যায়ে রয়েছেন। সারাদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা শতকরা ৯.৫৮ ভাগ অথচ বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালিদের মধ্যে ভূমিহীন হলো শতকরা ১.৬১ ভাগ। নিরাপদ পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালির সংখ্যা শতকরা ৯৯ ভাগ অথচ দেশের সকল গৃহস্থালির শতকরা ৯৭ ভাগ এই সুবিধাপ্রাপ্ত। দেখা গেছে যে, স্বাস্থ্যসম্মত বিষ্ঠা ব্যবস্থাপনা ভোগ করেন বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালির শতকরা ৮২ ভাগ; বাংলাদেশে সকল গৃহস্থালির শতকরা ৬২ ভাগের চাইতে বেশি এই সুবিধা প্রাপ্ত নন। জরিপে এও দেখা গেছে যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালিদের শতকরা ৯৬ ভাগ মোবাইল ফোন, শতকরা ৮৮ ভাগ খাট, শতকরা ৬২ ভাগ টেলিভিশন এবং শতকরা ৩৪ ভাগ রেফ্রিজারেটর এবং শতকরা প্রায় ১৪ ভাগ ইন্টারনেট সংযোগ, কম্পিউটার ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করছেন। এসব উপাত্ত এ কথা প্রমাণ করে যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালিসমূহের অপেক্ষাকৃত বর্ধিত আয় তাদের সদস্যদের জীবনের অধিকতর উৎকর্ষ অর্জনে সহায়ক হয়েছে এবং দেশে টেকসই ভোগ্যপণ্যাদির একটি তাৎপর্যপূর্ণ বাজার সৃষ্টি করেছে। ২০১৩-এ সম্পাদিত এই জরিপে দেখা গেছে যে, বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের প্রায় শতকরা ১৭ ভাগ দেশে জমি কেনায় প্রযুক্ত হয়েছে। এও বিদিত হয়েছে যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালির প্রায় শতকরা ৫৭ ভাগ সঞ্চয় করেন। সিলেট বিভাগের ক্ষেত্রে এসব গৃহস্থালির সংখ্যা শতকরা ৩৮ ভাগ আর বরিশালের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা শতকরা ৬৪ ভাগ। এ দুটি উপাত্তের সম্ভবত দুটি তাৎপর্য রয়েছে। এক, যারা জমি কেনেন তাঁরা সম্ভবত বিদেশে যাওয়ার ব্যয় মেটানোর জন্য আগে বিক্রীত জমি উদ্ধার করতে চান। অধুনা স্থাপিত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কর্মপরিধি ও তৎপরতা বাড়ানো গেলে সম্ভবত এই ধরনের অহেতুক এবং অনুৎপাদনশীল জমি হস্তান্তরের স্থলে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করা যাবে। দুই, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালির সঞ্চয় প্রবণতা উঁচুমানের। যথাযথ ও যথাসংখ্যক সঞ্চয়ের হাতিয়ার সকল পর্যায়ে প্রচলিত করা গেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠানিক পন্থা ও পথ বিস্তৃত হলে এই ধরনের সঞ্চয়কে অধিকতর মাত্রায় এবং ফলপ্রসূভাবে বিনিয়োগে রূপান্তর করা যাবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করা অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ হবে বলে মনে হয় এ জন্য যে, এ জরিপে দেখা গেছে যে, বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্ত গৃহস্থালির শতকরা ৮৪ ভাগের চাইতে বেশিসংখ্যক সঞ্চয়কারীরা ব্যাংকে তাঁদের সঞ্চয় রাখেন এবং মাত্র ২৫ ভাগ এরূপ গৃহস্থালি প্রত্যক্ষভাবে তাদের সঞ্চয় বা প্রাপ্ত অর্থ-বিনিয়োগ করেন। স্পষ্টত, এদের জন্য দেশে সঞ্চয়ের হাতিয়ারের সংখ্যা ও পরিধি এখনও বাড়েনি। এর অর্থ, সমাজের অপেক্ষাকৃত স্বল্পবিত্ত যারা বিত্তের অন্বেষণে বিদেশে যান এবং বিদেশ থেকে উপার্জিত আয় স্বদেশে প্রেরণ করেন তাদের প্রেরিত অর্থের এক বৃহৎ অংশ দেশে বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিত্তবানের অনুকূলে সঞ্চালিত হয়। এই প্রেক্ষিতে যদি যথাযথ সংশোধনীয় পদক্ষেপ আর্থিক ও বিনিয়োগ ব্যবস্থায় না নেয়া হয় তাহলে বিদেশ থেকে বিত্ত প্রাপ্তি ব্যবহারের ভিত্তিতে সমাজে ইপ্সিত স্থিতিশীলতা অর্জন করা সহজতর হবে না বলে মনে হয়। এই জরিপে বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত প্রাপ্ত অর্থের বিনিয়োগের সবচাইতে বড় অংশ (শতকরা ৭২ ভাগ) বাড়ি নির্মাণে প্রযুক্ত হয় বলে বিদিত হয়েছে। শহরাঞ্চলে ফ্ল্যাট বা এ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে প্রায় শতকরা ১৬ ভাগ প্রযুক্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্য কথায়, বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের সিংহভাগ বিনিয়োজিত হচ্ছে অনুৎপাদনশীল বা অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল বাড়ি নির্মাণে বা আবাসন ক্রয়ে। ফলে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থের অধিকতর উৎপাদনশীল বিনিয়োগ শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে হচ্ছে না বলেই বোঝা যাচ্ছে। ভারতে এই ধরনের প্রবণতা তিন দশক আগেই বিরাজিত ছিল বলে জানা যায়। সম্প্রতি ভারতে বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়ের এক বৃহৎ অংশ শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োজিত হচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন ও প্রযুক্তির অনুকূলে বিনিয়োগ কিভাবে সে দেশে সংগঠিত হচ্ছে তা জেনে এ দেশেও সেই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা সঙ্গত হবে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড ও সিকিউরিটি ও একচেঞ্জ কমিশন অন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ এ ক্ষেত্রে যথাযথ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের হাতিয়ার ও মাধ্যম এবং চলিষ্ণু মাধ্যমায়ন ব্যবস্থা উদ্ভাবন ও প্রযুক্ত করতে পারে। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিদেশে কর্মরত তিন-পঞ্চমাংশ বাঙালী শ্রমিক দশ বছরের কম সময় বিদেশে কাজ করেন। ৩-৫ বছর কাজ করেন প্রায় ১৭ ভাগ। এর অর্থ বিদেশ কর্মরত শ্রমিকদের এক বিরাট অংশ কর্মক্ষম বয়সে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সব শ্রমিক বিদেশে কোন না কোন প্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। এদের মধ্যে অনেকে দেশে ফিরে সেই প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প বা উৎপাদন শৈলীতে নিজেরাই বিনিয়োগ করতে চান। জানা গেছে যে, ব্যাংক বা আর্থিক ব্যবস্থা থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তার অনুপস্থিতিতে তারা এ পথে অগ্রসর হতে পারেন না। কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ দিকে যথা প্রয়োজন দৃষ্টি দিলে বিদেশ থেকে প্রত্যাগত শ্রমিকরা যেমনি শিল্প ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন তেমনি বিদেশ থেকে এ দেশে প্রযুক্তির ইপ্সিত স্থানান্তর ঘটবে। সবশেষ মোটা দাগে একটি কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় রফতানি আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের বৈদেশিক দেনা-পাওনার হিসেবে সম্প্রতি স্বস্তির উপকরণ যুগিয়েছে। কিন্তু এরপরও দেখা যাচ্ছে যে, এই স্বস্তির ফলশ্রুতি হিসেবে দেশে মূলধন দ্রব্যাদির তুলনায় অধিকতর ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হচ্ছে। যখন দেশে মালয়েশিয়া থেকে তরল দুধ কিংবা থাইল্যান্ড থেকে কাঁচা ফল আমদানি হয় এবং তার বিপরীতে শিল্পোদ্যোগে প্রয়োজনীয় মূলধন দ্রব্যাদি আমদানি অসহজতর থাকে তখন বলা চলে যে, দেশের বিদ্যমান বিনিয়োগ ব্যবস্থা, অর্থায়নের পরিমাণ ও পদ্ধতি ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরিচালনায় আহৃত বিদেশী মুদ্রার সুঠাম ব্যবহারের অনুকূলে সংস্কার করা প্রয়োজন। এ কাজটি যথাযথভাবে হাতে নেয়া এবং সম্পূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ও বিনিয়োগ বোর্ডকে সুনির্ধারিত ও সময় বদ্ধ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য এগিয়ে যেতে হবে।
×