ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

(২৮ জানুয়ারির পর) বাংলাদেশ আন্দোলন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ করেছিলেন এটা ঠিক; তবে মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, ভোটের হিসাবে (১৯৭০) ২৫ ভাগ বাঙালী এর বিরুদ্ধে ছিল। এই ২৫ ভাগের অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় গরিষ্ঠ বাঙালী মুসলমানদের হত্যা, মুসলমান নারীদের ধর্ষণে মেতে উঠেছিল। ইসলামের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এত অল্প সময়ে এত বিশাল হত্যাযজ্ঞ বাঙালী মুসলমানরাই করেছিল [না, আমি পাকিস্তানী বাহিনীর কথা ভুলিনি, কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের একাংশ তাদের সহযোগিতা না করলে এত বড় হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হতো না]। এবং তা করা হয়েছিল ধর্মের নামে। বাঙালী যখন জিতে এলো তখন এই মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৫৪নং আদেশে পাকিস্তানের সব কিছু অটুট রাখা হয়েছেÑ‘... ধষষ ষধংি যিরপয বিৎব রহ ভড়ৎপব ড়হ ঃযব ২৫ঃয ফধু ড়ভ গধৎপয ১৯৭১...ঝযধষষ পড়হঃরহঁব ঃড় নব রহ ভড়ৎপব...’ এর সূত্র ধরেই পাকিস্তানী প্রশাসন ব্যবস্থা অটুট রাখা হয় এবং পাকিস্তানের মতোই আমলাতন্ত্রে আস্থা অটুট রাখা হয়। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি নির্ধারণে যে কমিটি করা হয় (১২ সদস্য) তার প্রধান করা হয় পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসের সদস্য জনাব এ রহিমকে। সদস্যদের মধ্যে সাতজন ছিলেন আমলা। ৪ জন রাজনীতিবিদের মধ্যে তিনজন ছিলেন জনপ্রতিনিধি; কিন্তু তাদের কাউকে সভাপতি করা হয়নি। আমাদের মানসিকতা যে খুব পরিবর্তন হয়নি তার প্রমাণ, এখনও জনপ্রতিনিধিদের ওপর আমলাদের স্থানÑ যা পাকিস্তানী মানসিকতা। এ মানসিকতা থেকে খালেদা জিয়া দূরে থাক, শেখ হাসিনাও মুক্ত হতে পারেননি। তবে জনপ্রতিনিধিরা এতই মেরুদ-হীন যে, তারা কখনও এর প্রতিবাদ করেননি। এই দাসসুলভ মনোভাবও পাকিস্তানী মানসিকতার প্রতিফলন। তৎকালীন নেতৃত্ব ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুদ্ধ করলেও, কখনও মাদ্রাসা শিক্ষা অবলেপন বা সংস্কারের কথা বলেননি; সবচেয়ে আগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেছেন, ইসলামী সংস্থায় যোগদানের জন্য আকুল হয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করলেও ধর্মরাষ্ট্রের উপাদানসমূহ সম্পূর্ণভাবে রহিত করেননি। কিন্তু সুযোগ তখনই ছিল। উল্লেখ্য, মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, কোন কথিত মৌলানা, মুফতি, পীর [সামান্য কয়েকজন করে থাকলে তা ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে।] এবং ইসলামী দেশসমূহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেনি। বঙ্গবন্ধু সাহসী মানুষ হিসেবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেই উপাদানসমূহকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট না করায় তা গোকুলে বেড়েছে। স্বাধীন দেশে ঐ পাকিস্তানী পরিপ্রেক্ষিত অটুট রাখা ও মানবিকতা দেখিয়ে পাকিস্তান ফেরত সৈন্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ করে দেয়া ছিল মস্ত ভুল। পরবর্তীকালে এই পাকিস্তানী ফেরতরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং তাদের সমর্থন করে মুক্তিযুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা, আওয়ামী লীগের একাংশ ও বেসামরিক আমলারা। আজকে যত অজুহাতই দেখানো হোক, ২৪ ঘণ্টা ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে ছিল; সেনাবাহিনীর কেউ, এমনকি পদক পাওয়া ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ সৈনিকরাও ৩২ নম্বরে আসেনি। বরং পরবর্তী ৩০ বছর ঐ পাকিস্তানী সেনারা ধাপে ধাপে সেক্যুলার রাষ্ট্রকে ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এজন্য দায়ী এবং তা পরিষ্কারভাবে বলা উচিত লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান, লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়া। এদের অভিযুক্ত করা যায় বাংলাদেশের মৌলিক আদর্শ বিনষ্ট করার জন্য। পাকিস্তানকে যেমন সৈনিকরা ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত করে তা ধ্বংস করে দিয়েছে বা দিচ্ছে, বাংলাদেশের তৎকালীন সৈনিকরাও গত ৩০ বছর একই কাজ করেছে। সে মানসিকতা বলবত এই অর্থে যে, সিভিলিয়ান কর্তৃত্ব বিনষ্ট করে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন এবং এর মাধ্যমে যাবতীয় অর্থ আত্মসাত বা নিয়ন্ত্রণ বা গ্রহণ। এটি এখন শুধু অটুট নয়, আরও তীব্র। ঠিকাদারী ব্যবসা থেকে ট্যাক্সি ব্যবসা সব তাদেরই দিতে হয়েছে এ সরকারকে। এমনকি জিয়াউর রহমান নামে বিমানবাহিনী প্রধানের (জানি না বিমানের সংখ্যা দু’ডজন হবে কিনা) ডিকটাট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছে মেট্রোরেলের গতিপথ পরিবর্তনে। যে কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। এটিও পাকিস্তানী মানসিকতা। ফিদেল ক্যাস্ট্রো সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পাকিস্তান ফেরত সেনা ও আমলাদের বাদ দিতে। ক্যাস্ট্রো তাই করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্যাস্ট্রোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাননি। পাকিস্তান তার পরাজিত সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে ফেরত নেয়নি। বাংলাদেশ হওয়ার পর পর বাংলাদেশের বিরোধীদের সম্পূর্ণভাবে বিচার না করার কারণে, পাকিস্তানী মানসিকতার বিকাশ শুধু নয়, পৃথিবীজুড়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। আজকের তালেবান, আল কায়েদা প্রভৃতি এক হিসেবে জামায়াতে ইসলামীরই উত্তরসূরি। জামায়াতের অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রধান দায় বিএনপি ও জাতীয় পার্টির। খুন করলে পুরস্কৃত করা হবেÑ পাকিস্তানের এই নীতি বাংলাদেশে প্রথম চালু করেন জিয়াউর রহমান, তারপর এরশাদ সেই ধারা এগিয়ে নিয়ে যান। এই নীতি পরিপুষ্ট করেন বেগম খালেদা জিয়া। এর সঙ্গে দায়ী আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী জেনারেশনের একাংশ। ৯ এ দেশে সব সময়ই সঙ্কটকাল চলছে। তার মধ্যেও দেশটি অগ্রসর হচ্ছে। এটি সাধারণ মানুষের কৃতিত্ব। তবে, রাজনীতি বিবেচনা করলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের তিন আমলেই দেশ সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একেবারে নিঃস্ববিধ্বস্ত দেশের একটি ভিত্তি গড়েছিলেন মাত্র তিন বছরে যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। শেখ হাসিনার তিন আমলে দেশের প্রবৃদ্ধি যেভাবে বেড়েছে সামরিক এবং খালেদা জিয়ার আমলে তা হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের নিয়ত জনবিরোধী কর্মকা- সত্ত্বেও তা থামেনি। সামরিক শাসন দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থায়িত্ব এনেছে এবং বিএনপি-জামায়াত শাসন আওয়ামী লীগ থেকে উন্নতÑ তা একটি অসত্য প্রচার বা ধারণা। প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগের ‘অপকর্ম’ তুলে ধরা হচ্ছে; তারপরও এ অগ্রগতি কিভাবে হচ্ছে? তাহলে ঐসব আমলে অপকর্মের সংখ্যা বেশি? তাহলে, ঐ আমল বা শাসন আমরা চাইব কেন? এর উত্তর কেউ দেবেন বলে মনে হয় না। অধিকাংশ মিডিয়া [মিডিয়ার কথা আসছে এ কারণে যে, ‘শিক্ষিত’ সমাজের মন তারা অনেকটা প্রভাবিত করে] বড় সংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা মানস গত তিন দশকে এভাবে রূপান্তর করেছে বা আমাদের ধমনীতে ঐ পাকিস্তানের বীজ রোপণ করেছে, যা এখনও বিদ্যমান। সুশীলসুজনরা যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন করে এবং বিএনপি যে তা করে না সে জন্য তারা বিব্রতও। এ বিষয়ে তাদের ধরতাই বুলি- বিএনপি কখনও বলেনি যে, তারা যুদ্ধাপরাধ সমর্থন করে। তারা আন্তর্জাতিক মানের স্বচ্ছ বিচার চায়। জামায়াতের খ্রীস্টান লবিস্ট টবি ক্যাডম্যানের ভাষ্যও এ রকম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাদের অস্তিত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। সেটি তারা হতে দিতে পারে না। সে জন্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তার পরে আওয়ামী লীগের অবস্থান তাদের মেনে নেয়া দুরূহ। একটা ইস্যু তো দরকার। কিছু হোন্ডাপার্টিও দেখলাম এ নিয়ে মাঠ সরগরম করে ঘোষণা করছে তারা তৃতীয় শক্তি হিসেবে জনগণকে নিয়ে আবির্ভূত হতে চায়। এই হোন্ডাপার্টির নেতারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আজ পর্যন্ত কোন নির্বাচন জিততে পারেননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের কাম্য। কারণ, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের প্রতিনিধিরা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেই নিয়ন্ত্রিত সরকার বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনই নিরপেক্ষ থাকেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ঐভাবে জিততে পারেনি। প্রশ্ন করতে পারেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জিতল কী ভাবে? জেতার মূল কারণ খালেদা-নিজামী-তারেক এবং ইয়াজউদ্দিন, মইউদ্দিন, ফখরুদ্দীনের শাসনকালে মানুষ এমন নিস্পিষ্ট হয়েছিল যে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছিল। মনের ইচ্ছায় দিয়েছে- তা নয়। সুশীল সমাজ সরাসরি তখন বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার সাহস পায়নি; যদিও সমবেদনাটি ছিল তাদের পক্ষেই। এখন ২০ দল ও সুশীলদের ধারণা, যে কোন প্রকারে আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলকে নামাতে হবে। তাতে যদি দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা হয় তাও সই এবং সে জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হবে। উদাহরণ দিই। জামায়াত যে সুনির্দিষ্টভাবে দাঙ্গা, হত্যা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে তার জন্য হরতাল দেয়াকে মুখ্য বিবেচনা করা হচ্ছে। যারা দিচ্ছে তাদের কিন্তু প্রবলভাবে অপরাধী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না। বরং জামায়াত-বিএনপির সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নিলে সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধাপরাধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিতর্কের পর বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতার নামে ২০ দলকে ‘ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক ধরনের নির্বাচনী প্রচার চালানো হচ্ছে। খালেদা জিয়ার স্ট্র্যাটেজি খুব সরল। যেভাবে হোক ক্ষমতায় যেতে হবে। ক্ষমতায় না গেলে গত ৩০ দশকে যে পাকিস্তানী আদর্শের ভিত্তি তারা স্থাপন করেছে তা বিনষ্ট হবে। এবং এখনই ক্ষমতায় না এলে এই পার্টি বা প্ল্যাটফর্ম রাখা কঠিন হবে। এটা এখন নিছক নির্বাচনে পালা বদলের ইস্যু নয়, এটা অস্তিত্ব রক্ষার ইস্যু। ক্ষমতায় গেলে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা তাদের ভাষায় চিহ্নিত ‘মুরতাদ’ ‘ভারতীয়’ ‘হিন্দু’দের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। একেবারে খোমেনি কায়দায়। ১৯৭১ সালে এই স্ট্র্যাটেজি ছিল বাঙালী পাকিস্তানীদের। সেই নিশ্চিহ্নকরণে আমাদের অনেককেই শামিল হতে হবে। সেই ১৫ সম্পাদকের অনেক-কেও। এরপর ১৪ দলের আদর্শকে কীভাবে বিলুপ্ত করা যায় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আমরা যারা এখনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মতাদর্শগতভাবে চাই ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রী ও উদার একটি সমাজ ও রাষ্ট্র, তাদের জন্য এই লড়াইটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০ দল ও সুশীলদের জয় আমাদের মতাদর্শকে দীর্ঘদিনের জন্য দমিত করে রাখবে। আমাদের অস্তিত্বও হবে বিপন্ন। (চলবে)
×