ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাব্বির খান

‘আইএসআই’ নীল নকশার অন্তরালে অফিস ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

‘আইএসআই’ নীল নকশার অন্তরালে অফিস ষড়যন্ত্র

কেন যেন মনে হয়, খালেদা জিয়াকে গুলশানের অফিসে আসলেই অবরোধ বা বন্দী করে রাখা হয়েছে। তবে তা সরকার কর্তৃক নয়, যা বিএনপির পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে দাবি করা হচ্ছিল। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং খাপছাড়া সব কর্মকা- দেখে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, খালেদা জিয়া একের পর এক যে আত্মঘাতী রাজনৈতিক চাল চালছেন, তা মূলত তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল থেকে সংগৃহীত নয়। ৫ জানুয়ারির বেশ আগে থেকেই পরিকল্পনামাফিক চলতে থাকে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত ‘অবরোধ’ নামক এক অপরাজনীতির। সে কারণে খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের বাথরুমে টাইলস ফিটিং করানো থেকে শুরু করে থাকার মতো উপযোগী করে তোলা হয় তাঁর অফিসটি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কারা বা কেন এই ধরনের একটি আত্মঘাতী রাজনৈতিক কর্মকা-ে উৎসাহ যোগাবে দুই দুইবারের এই প্রধানমন্ত্রীকে? একটা ব্যাপার এখানে পরিষ্কার যে, বিএনপির খালেদা শুধু রেফারির মতো বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছেন। কিন্তু মূল খেলাটি খেলছে জামায়াত-শিবির ছাড়াও অদৃশ্য একটি শক্তি। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, কার কমান্ডে এবং উৎসাহে জামায়াত সদলবলে মাঠে নেমেছে! সেই জোট সরকারের আমলে আমরা দেখেছিলাম, তারেক রহমান জামায়াতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সগর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিএনপি-জামায়াত হচ্ছে একই মায়ের গর্ভে দুই সন্তান। পরবর্তীতে বিভিন্ন কর্মকা-ে বাস্তবেও আমরা তাই দেখেছি। খালেদা জিয়া বয়সে, শোকে, দুঃখে এবং অসুস্থতায় জর্জরিত একজন বিধ্বস্ত নারী। দেশে থেকে তিনি শুধু তোতা পাখির মতো ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন আদেশ। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই এটা স্পষ্ট যে, খালেদার দেয়া বিভিন্ন ঘোষণার স্ক্রিপ্ট আসছে দেশের বাইরে থেকে অর্থাৎ বিএনপির মূল নেতৃত্ব যে এখন খালেদার হাতে নেই বরং তা যে এখন তারেকের হাতে তা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। এটা আরও পরিষ্কার হয় যখন দেখা যায় বাঘা বাঘা সিনিয়র সব নেতা ব্রিফকেস হাতে ছুটছেন লন্ডনে তারেকের দর্শনলাভ তথা তাঁর দেয়া পরামর্শগুলো ভালভাবে বুঝে নেয়ার জন্যে। বিভিন্ন সময়ে আইএসআই-এর বিভিন্ন পর্যায়ের বসদেরও লন্ডনে তারেকের সঙ্গে সাক্ষাতের খবর দেখেছি বিভিন্ন কাগজে। এদিকে তারেক রহমান বিদেশের মাটিতে বসে জঙ্গীমৌলবাদী বিভিন্ন কানেকশনগুলোও রক্ষা করে চলেছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। কখনও মধ্যপ্রাচ্যে, কখনও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আবার কখনও খোদ লন্ডনে বসেই পাকাচ্ছেন ষড়যন্ত্রের বিশাল বিশাল সব পরিকল্পনা। মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিম থেকে শুরু করে আইএসআই এবং ক্ষেত্রবিশেষে মোসাদের অবসরপ্রাপ্ত এজেন্টদের সঙ্গেও বিশেষ সখ্য গড়ে তোলার কথাও শোনা গেছে বিভিন্ন সময়ে। জোট সরকারের আমলে হোয়াইট হাউসে ইসরাইলী লবিস্টদের সহযোগিতা নেয়ার কথা তো অনেকেই জানতেন। বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সে খালেদাকে দিয়ে যে রাজনীতির ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছেন তারেক রহমান তা একাধারে যেমন অমানবিক, সেই সঙ্গে হটকারি তো বটেই! যে ছক এঁকে তারেক রহমান, মতান্তরে জামায়াত, মতান্তরে আইএসআই বাংলাদেশে এক ধরনের মিনি আফগানিস্তান বানানের ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছেন এবং সরকারকে বিপর্যস্ত করার যাবতীয় কাজ সমাধা করেছে তা সম্ভবত হালে পানি পাচ্ছে না বলে কি হঠাৎ করে কোকোর মৃত্যু হলো? খালেদা কি এ ধরনের কোন আলামত আগে থেকেই জানতেন বা ওনাকে জানানো হয়েছিল? কেউ বা কারা তাঁকে হুমকি দিয়েছিল যে, তাঁদের কথার সামান্য এদিক সেদিক হলে দুই ছেলের একটাকে হত্যা করা হতে পারে? আর একেবারে বিনা কারণে দেশের মানুষকে হলিউৎসবের মতো করে যখন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছিল, খালেদা কি কোন কারণে তখন বেঁকে বসেছিলেন আত্মগ্লানিতে? আর তখনই প্রথম লাশটি তাঁকে উপহার দেয়া হলো? আর এ কারণে তিনি যে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, এটা কি খুব অস্বাভাবিক? এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাতে দেখা না হয়, সেজন্য তারেক বা অদৃশ্য কোন মহল থেকে কি মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কথা বলা হয়েছিল? এসব প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বর্তমানে বাংলাদেশে যে তা-ব চলছে, তাঁর রূপকাহিনী। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের ধারণা, ক্ষমতার জন্য এবং নিজের চামড়া বাঁচাতে প্রয়োজন হলে তারেক রহমান তাঁর মা খালেদা জিয়াকেও হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করবে না। গত ৫ জানুয়ারি পল্টনে সভা করার নামে মূলত সে ধরনেরই একটা প্ল্যান তারেক রহমান তাঁর জঙ্গী সহোদরদের দ্বারা করাতে চেয়েছিলেন এবং খালেদাকে প্রেশার দিয়েছিলেন, যে করেই হোক তাঁকে পল্টনে যেতে হবে। কিন্তু সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা এবং তারেকের ওপর দীর্ঘদিন ধরে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চলমান রাখার কারণে সে কুচক্রান্ত ভেঙ্গে দিতে সমর্থ হয়। সেই সঙ্গে ভেস্তে যায় প্ল্যান ‘এ’। খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ৫ জানুয়ারি বিকেলে খালেদা জিয়া যখন অবরোধ না হরতাল দেবেন, সে ব্যাপারে বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এবং খানিকটা অস্পষ্টভাবে একবার হরতাল, পরক্ষণেই আবার অবরোধ, আবার হরতাল, আবার অবরোধ বলে উচ্চারণ করেছিলেন। যাইহোক, প্ল্যান ‘বি’ অনুযায়ী যখন অবরোধ শুরু হলো, তৎপরবর্তী কর্মকা- সারাদেশের মানুষ দেখেছেন, যা বর্তমানেও চলমান। অবরোধের প্রায় তিন সপ্তাহ অতিক্রম করার পরেও সরকারের কূটকৌশলের কাছে আবারও ধরাশায়ী হয়ে যখন তারেক গং দেখল যে প্ল্যান ‘বি’ও মাঠে মারা গেছে, তখন প্ল্যান ‘সি’ এলো কোকোর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে। এবার শুরু হলো মানবিকবোধের কথাবার্তা। কিন্তু খালেদাকে দেখতে যাওয়ার প্রধানমন্ত্রীর চটজলদি সিদ্ধান্ত তারেক গং হিসেবের মধ্যে হয়ত ছিল না। ২৪ তারিখ সন্ধ্যা ৭টার কিছু পর পর্যন্ত খালেদা জিয়া বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী এবং আত্মীয়স্বজনদের সাক্ষাত করেছেন এবং একাধিকবার তারেক ও কোকোর ফ্যামিলি মালয়েশিয়াতে ফোনে কথাও বলেছেন। তারপরেই গুলশান অফিসের প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে দেয়া হলো বিশালাকৃতির দুইটি তালা। কাদের ইশারায় এটা করা হলো? সেই সঙ্গে অফিসের ভেতরে অবস্থান নিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান প্রমুখ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে এলেন, কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। যেই অফিস নাকি সরকার দিনের পর দিন খালেদাকে ভেতরে রেখে অবরোধ করে রাখা হয়েছে বলে সারা দুনিয়াতে চাউর করা হলো অথচ সেই অফিসেই খোদ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ঢুকতে পারলেন না। ফটকের বাইরে দাঁড়ানো প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হলো, খালেদাকে নাকি ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। হতেই পারে, কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রীকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হবে না? খালেদাকে দিনের পর দিন গুলশান অফিসে অবরোধ করে রাখা হয়েছে বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছিল, তা যে ডাহা মিথ্যা কথা, তাঁর প্রমাণ পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, প্রধানমন্ত্রী যদি ভেতরে ঢুকতেন, তাহলে কি তিনি কিছু দেখে ফেলতেন? কিসের ভয়ে এই ঘুম পাড়ানির খেলা খেলল খালেদা বা তাঁর সহকর্মীরা? কাদের ইশারায় প্রধান ফটকে তালা ঝুলানো হলো? প্রশ্নগুলো নিশ্চয়ই অবান্তর নয়! খালেদাকে প্রথম কয়েকদিন সরকার নিরাপত্তা দিলেও পরে তা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু তারপরেও খালেদা কেন ঐ অফিসেই পড়ে ছিলেন? নাকি তাঁকে সেখান থেকে এক পা না নড়ার হুকুম জারি হয়েছিল অদৃশ্য কোন মহল থেকে? নাকি তাঁকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল? নিজের পেটে ধরা সন্তানের আকস্মিক মৃত্যুর খবরে খালেদা একেবারে মুষড়ে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন কারণে খালেদা হয়ত বিদ্রোহও করতে পারতেন অদৃশ্য সেই হুকুমদাতার বিরুদ্ধে অথবা হাসিনা তাঁকে দেখতে গেলে, তাঁর কাছেও আকার ইঙ্গিতে সাহায্যও চাইতে পারতেন খালেদা তাঁকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার জন্য। এ সবই ‘হয়ত’ জাতীয় কথাবার্তা হলেও একেবারেই যে অমূলক নয়, তা বিভিন্নভাবেই উপলব্ধি করা যায়। আর সব কিছুর আলামত টের পেয়েই কি সেই অদৃশ্য শক্তিগুলো তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিল? অথবা তাঁকে রুমে আটকে রেখে বাইরে ব্যারিস্টার মওদুদদের পাহারায় রাখা হলো, যাতে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়? দুই দুইবারের প্রধানমন্ত্রী আর যাই হোক এতটুকু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ধরনের আন্দোলনে দেশের মানুষকেই পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, যা অবশ্যই ঠিক না। কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে তিনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না কমা- করার মতো, তাই যেকোনভাবেই হোক তাঁকে বাধ্য করা হচ্ছিল তোতা পাখির মতো শুধু শেখানো বুলিগুলো আওড়ানের জন্য। আর চলমান এই তথাকথিত আন্দোলনের প্ল্যান তৈরি থেকে মনিটরিংয়ের পুরোভাগের দায়িত্বে ছিলেন তারেক রহমান, জামায়াত এবং আইএসআই। খালেদাকে যে কোনভাবেই হোক ব্ল্যাকমেইল করে বাধ্য করা হতে পারে, ভাবনাটা সঙ্গত কারণেই অমূলক নয়। আমার এই ধারণার পক্ষে প্রমাণ হয়ত ঠিক এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে না। সেজন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে জানার জন্য যে, ঠিক কোন কারণে কোকো হঠাৎ মারা গেল এবং কেন খালেদা অহেতুক বাসায় না গিয়ে অফিসেই অবস্থান করছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। সে পর্যন্ত সরকারের উচিত হবে, খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার বলয়টা আবারও কিছুটা কড়াকড়ির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। তারেক যে করেই হোক অবরোধের কারণে হারানো গৌরব কিছুটা হলেও আবার ফিরে পেতে মরিয়া হবে এবং তা যদি তাঁর মা খালেদা জিয়াকে হত্যার মাধ্যমেও হয়, তাতেও সে পিছপা হবে না। পরিস্থিতি বাইরের দিকে স্বাভাবিক মনে হলেও মূলত তা বেশ ঘূর্ণায়মান ঘোলাটে এবং ভয়ঙ্কর সব ষড়যন্ত্রে জালে ঘেরা। সবাইকেই খুব সাবধানে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আর সেই সঙ্গে করতে হবে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা। ভুলে গেলে চলবে না, সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক [email protected]
×