ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ২৮ জানুয়ারি ২০১৫

দুই নেত্রীর আলোচনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

(২৭ জানুয়ারির পর) ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যরা যদি রাস্তায় নেমে আসতেন তাহলে কি ফারুক-ডালিমরা বেঁচে থাকতেন? তাঁরা নামেননি, কেন নামেননি তার ইঙ্গিত করেছি। সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যাঁরা বঙ্গবন্ধু বলতে ছিলেন পাগল এবং বঙ্গবন্ধুর নামে সে সুবিধা নিয়েছিলেন তাঁরাও নামেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যা হয়ত তাদের বিমূঢ় করেছিল; কিন্তু তারপরও তো নামার সুযোগ ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রথম ছাত্র ইউনিয়নই করেছিল যাদের কিছু পত্রিকায় আজ নাম ধরে গালাগালি করে বলা হয় আওয়ামী লীগকে তারা ধ্বংস করেছে। সাবেক বামপন্থীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলকে শক্তিশালী করেছে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের আমলে যখন ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণমুখী রাষ্ট্রকে ক্রমেই পাকিস্তানী আদলে রূপান্তরিত করা হয় তখন আমাদের একাংশই তাতে সায় দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা কি সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে গিয়ে জিয়া ও এরশাদকে মহিমান্বিত করেননি? সুতরাং প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশের আদর্শ কি এতই ঠুনকো ছিল? না, ঠুনকো ছিল না। ঠুনকো হলে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা মানুষজন জিততে পারতেন না। এক লাখ শহীদ হলেই হাল ছেড়ে দিতেন। তা তো ছাড়েননি। মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে, পাকিস্তানী আদর্শ ভায়োলেন্স ও অর্থের সাহায্যে প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তাদের সাহায্যার্থে ২০ বছরের মধ্যে বিত্তশালী একটি শ্রেণী সৃষ্টি করা হয়েছে যারা আবার রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং ভাবনার জগতে আধিপত্য সৃষ্টি করেছে। এ কৌশল অসফল হয়েছে বলা যাবে না; কেননা নতুন জেনারেশনের একটি বড় অংশ বিভ্রান্তির রাজনীতি গ্রহণ করেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ এখন অতীতের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বড় দল আওয়ামী লীগ কখনও দূরদর্শী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, ভাবনার জগতে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করেনি বরং আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যস্ত থেকেছে। পাকিস্তানী আমল থেকে এখন ধর্মের জোর বেশি। ধর্মীয় পক্ষের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের জীবনচর্চার সঙ্গে ইসলামী জীবনচর্চার কোন মিল নেই; কিন্তু তাদেরই ইসলামের রক্ষক মনে করা হচ্ছে। যারা এদের সমর্থক তাদের সন্তান-সন্ততির কেউ মাদ্রাসায় পড়েনি, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে তারা পরিপুষ্ট করেছে হাতিয়ার হিসেবে এবং সাধারণকে অধস্তন রাখার জন্য। এর মধ্যে শ্রেণীগত একটি ব্যাপারও আছে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ, ভোগী ও সুবিধাভোগী জীবনযাপনের অন্তিমে মাদ্রাসা-মসজিদ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন; কিন্তু মেয়েদের বা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে উৎসাহী হন না। কারণ তাহলে তাদের উত্তরসূরিরা সাধারণের প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। রাজনৈতিক যুদ্ধের কৌশল হিসেবে বিএনপি-জামায়াত বা পাকিপন্থীরা আওয়ামী লীগ বা বামদের অধার্মিক হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রাসী সব পন্থা গ্রহণ করেছে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ বা মধ্যপন্থী বা উদার বা মৃদুবাম এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বলেনি, আমার মুসলমানত্ব প্রমাণের দরকার নেই। যারা আমাদের অধার্মিক বলে তারাই অমুসলমান। কিন্তু মধ্যপন্থা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করে সমঝোতা ও নিজেদের মুসলমানত্ব প্রমাণে ব্যস্ত থেকেছে। এটি রাজনৈতিক ভুল যার মাসুল মুক্তিযুদ্ধ চেতনাপন্থীদের গুনতে হচ্ছে। এই দ্বন্দ্বে নতুন এক গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। তারা কিন্তু বিএনপি-জামায়াত আমলেই শক্তিশালী হয়েছে। এরা নিজেদের নিরপেক্ষ বা সুশীল সমাজ বলে জাহির করে। এরা পাকিস্তানপন্থী তা বলার সুযোগ নেই। কারণ নিয়ত তারা এমন সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক রাষ্ট্রের কথা বলেন যা নিয়ন্ত্রণ করবেন রাজনীতিবিদরা নন, তারা। মিডিয়া তাদের পছন্দ করে। তাদের ইচ্ছা, রাজনীতিবিদ যদি ক্ষমতায় থাকেনই তাহলে তিনি যেন আওয়ামীপন্থী না হন। অধিকাংশ সংবাদপত্র ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার গত কয়েক বছরের প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। একটি উদাহরণ আমি অনেকবার দিয়েছি, এখনও দিচ্ছি, তাহলে এই সুশীল মিডিয়ার ভূমিকাটি পরিস্ফুট হবে। বিশ্বজিৎ হত্যাকা-ের ভয়াবহ দৃশ্যটি বার বার দেখানো হয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। এখনও দেখান হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু কেউ কখনও প্রশ্ন করেননি, এতজন সাংবাদিক সেখানে ছিলেন, দলবদ্ধভাবে তারা তাড়া করলে ওই ক’জন হত্যাকারী পালানোর পথ পেত না এবং সাধারণ মানুষ তখন এদের গণপিটুনিতেই লম্বা করে ফেলত। কিন্তু বিশ্বজিৎকে রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে যে বিচার করা হলো সে বিষয়টিও উপেক্ষিত হলো। কারণ সেটি আমলে আনলে বলতে হয়, এ আমলে আইনের শাসন বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, পূর্ববর্তী আমলে ছিল যা অনুপস্থিত। এরপর হেফাজতীরা যখন সমাবেশ করছে তখন টিভির রিপোর্টাররা সমানে বয়ান করেছেন তাদের ‘তৌহিদী জনতা’, ‘ধর্মপ্রাণ’, ‘মুসল্লি’ ইত্যাদি হিসেবে। এরা যখন কোরান পোড়াল এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাল সে দৃশ্য ওই একদিন বা দু’দিন দেখানো হয়েছে, বার বার নয়, কারণ তাহলে প্রমাণিত হবে এরা ধর্মপ্রাণ নয়, এরা ধর্ম ব্যবহারকারী এবং এর ফলে বিভ্রান্ত রাজনীতির মুখোশ উন্মোচিত হবে। বরং গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কয় হাজার মারা গেছে সে বিতর্ক উপস্থাপন করে এবং বিএনপি-জামায়াত যে এই নাটকটি পরিবেশন করেছে তা নিপুণভাবে আড়াল করা হলো। মাহমুদুর রহমান দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন অপপ্রচার চালিয়ে দেশজুড়ে দাঙ্গা সৃষ্টির পর ১৫ সম্পাদক তার পক্ষে বিবৃতি দেন যাদের অধিকাংশ সমাজে ধর্ম-নিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের ‘অবতার’ হিসেবে পরিচিত। এর ব্যাখ্যা কী হবে? এসব ভাবার সময় হয়েছে। সবশেষে, একটি উদাহরণ দিই। ২০১৩ সালে জামায়াত নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে আলীপ করা হলো। যেটি বাংলাদেশের জন্য শুধু নয়, উপমহাদেশের জন্য প্রধান সংবাদ। ১৩ তারিখে প্রকাশিত মাত্র দু’টি সংবাদপত্রÑ দৈনিক জনকণ্ঠ ও কালের কণ্ঠে তা শিরোনাম হয়েছে; অন্য কোন পত্রিকায় নয়। আমি প্রথমে যা আলোচনা করেছি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ ঘটনা। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন যে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সে রাষ্ট্র চার বছরের শেষে কেন যাত্রা করল ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সেটি আমরা খুব একটা খতিয়ে দেখিনি। আমিও যে এ বিষয়ে পড়াশোনা করে গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছেছি তা নয়, তবে সামান্য কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। (চলবে)
×