ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরষে ফুলের হলুদ চাদর ফোঁটায় ফোঁটায় মধু যাচ্ছে বিদেশে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

সরষে ফুলের হলুদ চাদর ফোঁটায় ফোঁটায় মধু যাচ্ছে বিদেশে

জনকণ্ঠ ফিচার শীত মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সরষে আবাদ করা হয়। সরষে ক্ষেতে মৌবাক্স বসিয়ে চলে মধু আহরণ। দেশে ও বিদেশে এই মধুর ব্যাপক চাহিদা। মধু উৎপাদন ছাড়াও মৌমাছি পরাগায়নের হার দ্রুত করে সরষের ফলনও বাড়িয়ে থাকে। বিষয়টি বাণিজ্যিক দিক থেকে দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার মামুন-অর-রশিদ, টাঙ্গাইল থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ইফতেখারুল অনুপম ও ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা শেখ আব্দুল আওয়াল পাঠিয়েছেন মৌচাষ ও আহরণের ওপর প্রতিবেদন। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিস্তীর্ণ আবাদী জমিতে সরষের ফাঁকে ফাঁকে এখন চলছে মৌচাষ। অভিজ্ঞদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মৌ চাষীরা। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি সরষে মৌসুমে বরেন্দ্রের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ২০টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। গোদাগাড়ী উপজেলাসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের সরষে ক্ষেতে এখন শোভা পাচ্ছে হাজারো মৌবাক্স। এতে মধু উৎপাদনের পাশাপাশি মৌমাছির কারণে পরাগায়ন হওয়ায় সরষে ফুল উৎপাদনও বাড়ছে। কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালক হযরত আলী বলেন, সরষে ক্ষেতে মৌমাছির দল এক ফুল থেকে আরেক ফুলে গিয়ে বসায় ফুলের পরাগায়ণ ঘটে সরষের উৎপাদন বেড়ে যায়। এবার বরেন্দ্র অঞ্চলে ব্যাপকহারে মৌচাষ হওয়ায় সরষেরও ভাল ফলনের আশা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্নস্থান থেকে অনেক পাইকারি ক্রেতা বরেন্দ্র অঞ্চলের খাঁটি মধু কিনে নিয়ে যান। গত কয়েক বছর ধরে সফল মৌচাষী গোদাগাড়ীর আতাউর রহমান। উপজেলার পাহাড়পুর নামাজগ্রামের ৫০ বছর বয়সী এই মৌচাষী ১৫ বছর ধরে মধু উৎপাদন করে আসছেন। চলতি মৌসুমেও তিনি ৫৫টি মৌবাক্স নিয়ে কাদিপুর ও সাহাব্দিপুর এলাকায় মৌখামার গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় মৌচাষী মধুর নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। চাষীর উৎপাদিত মধু সংরক্ষণ করে তা বিদেশে রফতানি করা গেলে আরও লাভবান হওয়া যেত বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, নিজস্ব খামারে উৎপাদন করা মধু নিয়ে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। ‘এ সলিড মধু’। সেখান থেকেই তিনি সারাবছর মধু বিক্রি করেন। সরষে শেষে আসছে লিচুর মৌসুম। লিচু মৌসুমেও তিনি মধু উৎপাদনে উদ্যোগ নেবেন। তিনি রাজশাহী নগরীতেও একটি মৌখামার গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান। এবার বড় আকারে টাঙ্গাইলের মধুর চালান যাচ্ছে ভারতে। বৈধভাবে রফতানি হওয়ায় মধুর বাজারজাতকরণের অনিশ্চয়তাও কেটে গেছে। ভারতীয় বহুমুখী কোম্পানি ‘ডাবর’ এখন মধুর ক্রেতা। প্রথমে সুন্দরবন বেল্টে মধু কেনা শুরু। ‘ডাবর’ এর নজর এখন টাঙ্গাইলের মানসম্পন্নœ মধুর প্রতি। গতবার সীমিত আকারে রফতানি হলেও এবার রফতানি ৬শ’ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে পেশাদার মৌচাষীর ধারণা। টাঙ্গাইলের মধুপুর সুপ্রাচীনকাল থেকেই মধুর জন্য বিখ্যাত। মধুপুর বনাঞ্চলে এক সময় প্রচুর মধু পাওয়া যেত। মধু থেকেই এর নাম হয়েছে মধুপুর। বাংলাদেশ মৌচাষ কল্যাণ সমিতির সভাপতি এবং ভূঞাপুর উপজেলার তেরিল্লা গ্রামের মৌচাষী দুলাল হোসেন জানান, তার খামারে ২৪০টি মৌবাক্স রয়েছে। তিনি এবার সরষে মৌসুমে প্রায় ৬০ মণ মধু উৎপাদন করেছেন। আরও ৪০ মণ মধু উৎপাদনে মাঠে কাজ করছেন। টাঙ্গাইল জেলা ও এর আশপাশের ৩/৪টি উপজেলার তিন শতাধিক বেকার যুবক সংস্থার পরামর্শে মৌচাষ করে ভাল আয়রোজগার করছে। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ মৌসুমে টাঙ্গাইল জেলায় শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১০ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত আবাদ করা হয়েছে ১০ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২৪ হেক্টর বেশি। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় ইদানীং পাহাড়ী মৌমাছির চাক বাঁধতে দেখা যায়। উপজেলা সদরের কলেজ রোডের রাসেল মিয়ার বাগানে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের কয়েকটি ডালে মৌমাছির চাক রয়েছে। চাক ভাংতে আসা মধু সংগ্রহকারী ব্যবসায়ী মানিক, ফজলুল হক জানানÑআমরা প্রথমে নাড়া (খের) দিয়ে বেনি তৈরি করে পূর্ণিমার রাতে বেশি খাঁটি মধু পাওয়ার আশায় বেনির মুখে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে তারপর চাক থেকে নিজ হাত দিয়ে মধু সংগ্রহ করি। প্রতিটি চাক থেকে আমরা কমপক্ষে ৭ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করি। গাছের মালিককে দিয়ে যা পাই তা কেজিপ্রতি ৯ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করি। বর্তমানে এখন মৌমাছির মৌসুম। সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের মৌমাছির চাক আমরা ভেঙ্গে থাকি। পাহাড়ী মৌমাছির হুল ফোটানো বিষ খুবই যন্ত্রণাদায়ক। যে ব্যাক্তি হুল দংশনের শিকার হয়েছেন শুধু তিনিই জানেন এর জ্বালা। মৌচাষীরা জানান, সরষে ক্ষেতে মৌমাছি পরাগায়নে সহায়তা করে। এতে সরষের ফলন ও দানা ভাল হয়। প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে সরষে ফুল হতে মধু আহরণের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তা চলে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। সারাদেশে সরষে চাষীকে যদি সরষে চাষের পাশাপাশি মধু চাষের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে সকল কৃষকই অনেক লাভবান হবে। একটি জমিতে এক শ’ আটটি কাঠের ফ্রেমে প্রতি সপ্তাহে চাষীরা তিন মণের অধিক মধু সংগ্রহ করতে পারে। সরষে ছাড়াও মৌমাছি মূলত আকৃষ্ট হয় তিসি, সুন্দরী লিচু, সজিনা, ধনিয়া, কালোজিরা, তিল, সূর্যমূখী ফুল হতেও মধু সংগ্রহ করে। সরষে চাষের সঙ্গে মৌচাষ করে কৃষকরা একদিকে যেমন নিজের ভাগ্যের উন্নয়ন করতে পারে। অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সহযোগিতা করতে পারে।
×