ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫

ঢাকার দিনরাত

অবরোধের মধ্যে দফায় দফায় হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। অবরোধ-হরতালের ভেতর শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় পার হলো আরও একটি সপ্তাহ। ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোর একাধিক সড়কে চলাচলকারী গণপরিবহনে পেট্রোলবোমার হামলা হয়েছে। এর আগে নৈশনাশকতা দেখেছে ঢাকাবাসী। এবার প্রত্যক্ষ করল সকালবেলার সহিংসতা। আগের লেখায় বলেছিলাম, ও-লেভেল এবং এ-লেভেল শিক্ষার্থীরা রাতের বেলা পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল হরতাল সকাল-সন্ধ্যা হওয়ায়। গত সপ্তাহে টানা হরতালের কারণে এই পরীক্ষা দুটি বাতিল করা হয়। কারণ রাতও ছিল হরতালের আওতাধীন। বিশ্বব্যাপী একই দিনে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় বলে এখন পরীক্ষার্থীদের সামনের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে স্থগিত পরীক্ষাগুলো দেবার জন্য। কৃতকার্যতা সাপেক্ষে তারা ২০১৬ সালের সেশনে উপরের ক্লাসে যোগ দিতে পারবে। তার অর্থ হলো পরীক্ষার্থীদের ছ’মাস নয়, প্রায় দেড় বছরের ক্ষতি হলো। অভিভাবকদের জন্যেও বাড়তি ব্যয়ের বোঝা। যে রাজনৈতিক দল অবরোধের ভেতর টানা হরতালের ডাক দিয়ে ওই পরীক্ষাগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল, তারা কি এ ক্ষতির দায়ভাগ নেবে? দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে দূরদৃষ্টির পরিচয় রাখতে না পারলে সেই রাজনীতির কতখানি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে? মানুষের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিট এখন যে কোন সংবেদনশীল মানুষের জন্য মনোযন্ত্রণার কারণ হয়ে উঠেছে। অবরোধের আগুনে পোড়া দেহ নিয়ে একদিনে সেখানে ভর্তি হন ২৯ জন। এটি বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের জন্য একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিদিন। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ রোগীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এটি ১০০ শয্যার হলেও ইতোমধ্যে আগুনে পোড়া রোগীর সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে হরতাল-অবরোধের আগুনে পোড়া অর্ধশতাধিক। অবরোধের আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার নৃশংসতা শুরু হয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল। হরতাল-অবরোধে দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনটির মধ্যে একটি বার্ন ইউনিটের নিজস্ব কমিটি। রোগীদের স্বজন ও চিকিৎসকদের সমন্বয়ে করা হয়েছে আরেকটি কমিটি। তৃতীয় কমিটিটি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে। ঢাকার নিজস্ব দিনলিপিতে এই ঘটনাটিও আগে কখনও সংযুক্ত হয়নি। ভাবছি ঢাকাকে আর কত নেতিবাচক অভিনবত্বের ভেতর দিয়ে যেতে হবে! বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সামন্ত লাল সেন গণমাধ্যমে বলেন, বাসাবাড়িতে কিংবা মিল-কারখানায় আগুনে পোড়া আর পেট্রোলবোমায় পোড়া এক নয়। পেট্রোলে পোড়াদের যে কী ভয়াবহ যন্ত্রণা হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। যে পোড়ে শুধু সে-ই জানে। বার্ন ইউনিটে ঘুরে আসার আহ্বান জানানোর ভেতর ভাবাবেগ থাকতে পারে, বিচক্ষণতা বা দূরদর্শিতা নেই। আগুনে পোড়া রোগীদের দেখতে যাওয়ার জন্য রোগীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার প্রয়োজনে দর্শনার্থীকে বিশেষ পোশাক পরতে হয়। তাছাড়া মানবিকতা বা সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য সশরীরে দেখতে যাওয়ার চাইতে জরুরী হলো রোগীদের সহায়তায় অংশ নেয়া। সেটা অর্থ প্রদানের মাধ্যমেও হতে পারে। যে গরিব রোগীটি পেট্রোলবোমার শিকার হওয়ার আগে ছিলেন সংসারের প্রধান উপার্জনকারী ব্যক্তি, তার সংসারে স্ত্রী-সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো বরং অধিক জরুরী। চরম আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অবরোধ আহ্বানকারী দলের নেতারাও বার্ন ইউনিটে যাচ্ছেন। বাংলাদেশেই বোধহয় এটা সম্ভব যে এক হাতে বোমার আগুনে পুড়িয়ে অন্যহাতে সেই পোড়া ক্ষতে মলম লাগানোর ‘জনসেবা’ করা। গত সপ্তাহে অভূতপূর্ব একটি ঘটনা ঘটে গেছে রাজধানীতে। আগে এমনটা ঘটেনি বললে পাশাপাশি এটাও বলতে হবে যে, ২০১৩ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বরের আগে লাগাতার দিনের পর দিন যাত্রীবাহী চলন্ত বাস ও পথচারীদের লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা ছুড়ে দগ্ধ করার অপসংস্কৃতিও চালু হয়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং এই মাসে সে নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নির্বাচন বর্জনকারী শক্তি আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার অপতৎপরতা শুরু করে। আগে সেভাবে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি যেমনটা এবার ঘটতে দেখা গেল। শুধু রাজনৈতিক কর্মীরা নন, সকল শ্রেণীপেশার মানুষ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে মানুষ পোড়ানোর অপরাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের ধিক্কার জানিয়েছে। রাজপথে আবার গর্জে উঠেছেন শিল্পী সাহিত্যিকরা। শুধু বক্তৃতার মাধ্যমে নয়, কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত পরিবেশন ও অভিনয় প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ওই নজিরবিহীন সহিংসতা নৃশংসতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করছেন। শনিবার একযোগে ঢাকার তিনটি স্থানÑ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় প্রেসক্লাব ও জাতীয় জাদুঘরের সামনে সহিংসতাবিরোধী সভা-সমাবেশ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানুষের এই সম্মিলিত প্রতিবাদ শুধু সৌন্দর্যম-িত নয়, শৈল্পিকও বটে।
×