ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

ওরা মানুষ হত্যা করছে আসুন আমরা...

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫

ওরা মানুষ হত্যা করছে  আসুন আমরা...

মনে পড়ছে প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসানের ’৭১-এর বিখ্যাত সেই ইয়াহিয়া খানের দানব মূর্তির পোস্টার ও এর অবিস্মরণীয় আহ্বান ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা জানোয়ার হত্যা করি’! এই আগুনে বোমা, আগুন, দগ্ধ নারী-পুরুষ-শিশু, ছাত্র-ছাত্রী, প্রশাসক, নিরাপত্তাকর্মী, চালক-হেলপার, বাস, ট্রাক, সিএনজি, রেলগাড়ি- এসব রাজপথে দৃশ্যমান বাস্তবতা যার নেপথ্যে ডাইনিরানীর আর তার রাক্ষসপুত্রের ‘লকলকে জিভ’ সবাই দেখতে পাচ্ছে! কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না এই দু’জনের আসল লক্ষ্যটি! পাঠক, বুঝতে চেষ্টা করুন, কেন এ দু’জন ক্ষমতায় গিয়ে, ক্ষমতায় না গিয়েও বাংলাদেশের জনগণের জীবন, সম্পদ ধ্বংসে সবসময় উন্মত্ত হয়ে থাকে? প্রশ্ন করুন নিজেদের- কেন জিয়া, খালেদা, তারেকের সবরকম পদক্ষেপ, কাজকর্ম গৃহীত হয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও এ আদর্শ বহনকারী বাঙালীদের বিরুদ্ধে অথবা এদের ধ্বংসের লক্ষ্যে? কেন তারা ’৭১-এর পাক হানাদার বাহিনীর অনুসরণে স্বাধীনতার ৪২-৪৩ বছর ধরে এবং এখনও স্বজাতিকে, স্বদেশকে আগুনে দগ্ধ করে হত্যা ও ধ্বংসের পথ বেছে নিল? তারা ২০১৩-এর তেঁতুল হুজুরের সহযোগে হেফাজতের নেতাকর্মী-মাদ্রাসাছাত্র, শিবির-বিএনপির ক্যাডারদের দিয়ে অগ্নিসাংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যে সরকার পতন হয় না তা ভালরকম উপলব্ধি করেও কেন আবারও একই রকম আগুন নিয়ে জাতির ও নিজেদের এই মরণ খেলায় মেতেছে? এর উত্তর পরিষ্কারÑ সরকার পতন নয়, বরং প্রশংসিত সরকারকে ‘সমালোচিত’ করার পথই তারা গ্রহণ করেছে। সরকারের চাইতেও তাদের বড় শত্রু হচ্ছে উন্নত বাংলাদেশ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিক্ষিত বাংলাদেশ। পাঠক, লক্ষ্য করুন, তারা কি ও কাদের তাদের হামলার প্রত্যক্ষ শিকার চালক, বাসযাত্রী হলেও পরোক্ষ শিকার হিসেবে তারা টার্গেট করেছে- কৃষক ও হাজার হাজার হেক্টর জমির সবরকম শস্য, যে খাতটি বাংলাদেশকে খাদ্যভাণ্ডারে পরিণত করেছে! শ্রমিক ও গার্মেন্টবহনকারী কাভার্ড ভ্যান, এ খাতটি বাংলাদেশকে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা যোগায়, তেমনি অন্যদিকে নারীদের শ্রমিক হিসেবে অর্থ উপার্জনকারীর মর্যাদা দিয়ে ক্ষমতাবান করেছে। এ সরকারের চেষ্টায় শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। ছাত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শত সমালোচনার মধ্যেও গরিবের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, প্রতিবছর ১ জানুয়ারি বিনামূল্যে তারা প্রায় তেরো কোটি পাঠ্যবই নিয়মিত হাতে পাচ্ছে, কোচিং-নোটবই অনেকটা হ্রাস পেয়েছে, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। শ্রেণী-ঘণ্টা বেড়েছে। পাঠদানকাজ নিয়মিত হয়েছে। ছুটির পরিমাণ কমানো হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির নানামুখী প্রচেষ্টা চলছে। শিক্ষার হার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি শিক্ষিত তরুণ-তরুণী তথ্যপ্রযুক্তি-জ্ঞাননির্ভর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে উন্নত জীবনযাপনের স্তরে প্রবেশ করছে! পাঠকÑ উচ্চশিক্ষিত, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসর তরুণ, তরুণীরা যেহেতু আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠন করছে যার নেতৃত্বে আছে সজীব ওয়াজেদ জয়Ñ সুতরাং তারা যে খালেদা, তারেক এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত প্রাচীনপন্থী জামায়াত-শিবির, হেফাজতসহ প্রায় সব ধর্মীয় দলের হামলার অন্যতম শিকার হবে, এত বলা বাহুল্য! সেজন্যই, লক্ষণীয়ভাবে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাধা-বিঘœ সৃষ্টি করতে খালেদা সন্ত্রাসীরা প্রায় সাড়ে পাঁচ শ’ প্রাইমারী স্কুল ভস্মীভূত করেছে যা তাদের শিক্ষা খাত ধ্বংসের প্রচেষ্টা মাত্র! এ কথা সবার জানাÑ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি শিক্ষা ও জ্ঞাননির্ভর দক্ষতা, এরা একে অপরের পরিপূরক। খালেদা জিয়ার পুত্তর তারেক প্রণীত বাংলাদেশ ধ্বংসের যে নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে তার প্রত্যক্ষ আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে গণপরিবহন। পাঠক, খেয়াল করুন, বাস-রেল হচ্ছে শ্রমিক-কৃষক, চালক, ছাত্র-ছাত্রী, মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। খালেদা-তারেকের অর্থভূক ভাড়াটে বোমাবাজরা তাদেরই নির্দেশে পুড়িয়ে অঙ্গার করছেÑ এই সাধারণ জনগণদের যাদের প্রাণের জন্য খালেদা বা তারেকের কোন রকম মর্মযাতনা বা ন্যূনতম অপরাধবোধ যে নেই তা তাদের নির্বিকার শোকহীনতা এবং এমন জঘন্য গণবিরোধী অমানবিক-পাশবিক অপতৎপরতা অব্যাহত রাখার ঘোষণাই প্রমাণ করে, নয় কি? এসব দুর্বৃত্তায়িত মানসিকতা, যা কোন মানসিক অসুস্থতা উদ্ভূত নয়, বরং যা ’৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অংশ-স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিরোধিতার মধ্যে সুপ্ত! এবং এটি জিয়ার অসম্পন্ন কাজÑ বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পর্বের অসম্পন্ন কাজ-অর্থনৈতিক মুক্তির প্রত্যক্ষ বিরোধিতা এতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই! এরই সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- থেকে মুক্তিদাতা জিয়া, খালেদা ও তারেকের আত্মার আত্মীয় যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার দুরভিসন্ধিও! এটি সর্বজনবিদিত সত্য যে পাকিস্তান নিজের পায়ে কুড়াল মেরে, নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রানাশ, সর্বনাশ করে! এবং সে অপর, তারই প্রতিবেশী এককালের খুবই উদার আফগানদের আফগানিস্তান, ভারত এবং তার এককালের উপনিবেশ, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশ! তাদের পক্ষে খেলবার জন্য ‘থ্রি স্টুজেস’ তারা লাভ করেছে জিয়া, খালেদা, তারেকের মধ্যে! সঙ্গে তাদের পুরনো মিত্র-দাসানুদাস জামায়াতে ইসলামী। অন্য মৌলবাদী দলের সঙ্গে তাদের মিত্রতা একেবারেই নেই, তা বলা যায় না! তবে, সাম্প্রতিক, ইউরোপের ফ্রান্সে, বেলজিয়ামে ও যুক্তরাষ্ট্রে যে জঙ্গী হামলা সংঘটিত হয়েছে, তাতে উদ্বেগজনকভাবে শ্বেতাঙ্গ তরুণ-তরুণীর জঙ্গিত্বে দীক্ষিত হবার খবর পাওয়া গেছে! মিডিয়ার সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীজুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসার পেছনে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে বছরে! অবিশ্বাস্য! যদিও জানা আছে যে, লাদেন, আল কায়েদার উত্থান ও বিস্তারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্র শুধু আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা ও সমাজতান্ত্রিক আফগান সরকারের উৎখাতের জন্য মৌলবাদের এ দৈত্য লাদেন ও তালেবান তৈরি করেছে! কেন? কারণ, আফগানিস্তানের রুক্ষ, শুষ্ক পাহাড়, মরু, সমতলের নিচে আছে অতি মূল্যবান খনিজ পদার্থ! কিন্তু না, দেশটির দুর্ধর্ষ তালেবান ও উপজাতিগুলো সেখানে সরকার ও উন্নয়ন চলার মতন কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থা প্রতিষ্ঠায় অপারগ! কেননা, অনেকটা লিবিয়ার মতোই, ইরাকের মতোই শক্ত স্বৈরশাসকের অনুপস্থিতিতে সেখানে সব সময় যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান যা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন, সেনা কারও পক্ষে প্রশমিত করা সম্ভব হয়নি! এমন অস্থিতিশীল পরিবেশে আর যাই হোক, দীর্ঘমেয়াদী খনিজ উত্তোলনের মতো বিপুল কর্মযজ্ঞ পরিচালনা একরকম অসম্ভব! তালেবানদের অতর্কিত হামলায় ইউরোপীয় ও আমেরিকান সৈন্য মারা পড়তে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন অবশেষে পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে! অবশ্য এর বেশ আগেই আমেরিকার তালেবান গঠনের নীলনক্সা বাস্তবায়নকারীদের প্রধান লাদেনকে হত্যা করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়! আশ্চর্য যে, কোন মুসলিম দেশ বা তালেবান নেতারা কেউই এর প্রতিবাদ তো করেইনি বরং নীরবতা অবলম্বন করেছিল! কথায় বলে, টাকা কথা বলে! ক্ষেত্রবিশেষে টাকা নীরবতাও তৈরি করে কিন্তু! প্রশ্ন হচ্ছে, এরা মানুষ হত্যা করছে, মানুষ কি তাহলে জানোয়ার হত্যা করবে না? শিল্পী কামরুল হাসান কথায় ও ছবিতে বলে গেছেন, ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা জানোয়ার হত্যা করি!’ সেই ’৭১-এ বাঙালী নারী-পুরুষ, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, মানুষ হত্যা বন্ধ করতে ‘জানোয়ার হত্যা’ শুরু করেছিল! একদিন সেই জানোয়াররা পরাজয় বরণ করল, মানুষ বিজয়ী হলো! পুরাণে বর্ণিত আছে, একবার স্বর্গে সুর ও অসুরদের মধ্যে লড়াই বেধেছিল, একপর্যায়ে সুর, অর্থাৎ দেবতারা পরাজিত হতে যাচ্ছিল দানবদের হাতে, এমন সময় স্বয়ং ব্রহ্মা এসে দেবতাদের পক্ষে যুদ্ধে নামেন। শেষ পর্যন্ত দেবতারা জয়ী হয়! স্বর্গকে অসুর, অর্থাৎ দানবের হাত থেকে রক্ষা করে ঈশ্বর স্বয়ং! সেসব ঈশ্বরপ্রতিম মানুষদের এ লড়াইয়ে নামতে হবেÑ পুরাণ এ নির্দেশই দিয়েছে। শেষ কথা, সন্ত্রাসী-জঙ্গী কর্মকা-কে রাজনীতি বিবেচনা করার পক্ষে যেসব সুশীল ওকালতি করছেন, তাদেরও সন্ত্রাসী-সমর্থনের কারণে সন্ত্রাসী-মিত্র হিসেবে গণ্য করা হবে এবং জনতার আদালতে তাদেরও বিচার হবে। সত্যকে, ইতিহাসকে কেউই এড়াতে পারে না, এর বড় প্রমাণ ’৯২-এ গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার শেষ পর্যন্ত আদালতে বাস্তবায়িত ও কার্যকর হয়েছে! লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×