ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাজ এগুচ্ছে দ্রুতগতিতে;###;গুরুত্বপূর্ণ ৭টি সার্ভের ৫টির কাজ শেষ;###;পল্লবী টু সোনারগাঁও প্রথম ধাপ চালু হবে ২১৯ সালে

৩৮ মিনিটে উত্তরা টু মতিঝিল ॥ স্বপ্নের মেট্রোরেল

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৫ জানুয়ারি ২০১৫

৩৮ মিনিটে উত্তরা টু মতিঝিল ॥ স্বপ্নের মেট্রোরেল

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দ্রুত এবং পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলছে রাজধানীবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরা থেকে মাত্র ৩৮ মিনিটেই যাওয়া যাবে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে। এটি ভাবলেই ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের মনে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম হয়। নগরবাসীকে যানজট থেকে মুক্তি দিতে বাস্তবে রূপ দানের কাজ এগিয়েছে মেট্রোরেলের। চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে শেষ হবে ডিটেইল ডিজাইন তৈরির কাজ। গত ডিসেম্বরের মধ্যে বেসিক ডিজাইনের কাজ শেষ করার লক্ষ্য ছিল। গত নবেম্বর মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ৩৯৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, এর মধ্যে সরকারী তহবিলের ১০৫ কোটি ১৪ লাখ এবং বাকি টাকা জাইকার তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে মাটি পরীক্ষাসহ চারটি সার্ভের কাজ চলছে জোরেশোরেই। ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে তিনটি সার্ভের কাজ। অন্যদিকে আইনকানুনের বিষয়টিও এগিয়েছে অনেকদূর। চলতি বছরের মধ্যেই স্টেশনসহ বিভিন ভৌত কাজের দরপত্র আহ্বান করা হবে বলে জানা গেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। সংস্থাটির সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, স্বল্পব্যয়ে দ্রুত ও উন্নত গণপরিবহন সেবা চালুর লক্ষ্যে বাংলাদেশে এই প্রথম মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। এটি বাস্তায়িত হলে ঢাকা মহানগরীতে কার্যকরী ও দক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু, সর্বসাধারণের জন্য দ্রুতগতির গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। জাতীয় গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে মেট্রোরেলসহ বড় প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এতে দেখা গেছে, প্রাথমিক কার্যক্রম যেভাবে এগিয়েছে তা উল্লেখ্যযোগ্য বলা যায়। মেট্রোরেল প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জনায়, ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এই মেট্রোরেলের পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। গড় গতিবেগ থাকবে প্রতি ঘণ্টায় ৩২ কিলোমিটার। ডিপোর জন্য ২২ হেক্টর জমি পাওয়া গেছে রাজউক থেকে। অন্যান্য ক্ষেত্রের অগ্রগতি হচ্ছেÑ ২০১৩ সালের ৩০ জুন ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) জয়েন্ট স্টেক কোম্পানিজ এ্যান্ড ফার্মসে নিবন্ধিত হয়েছে এবং ২০১৪ সালের ১৬ নবেম্বর এর প্রথম বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হয়। জেনারেল কনসালটেন্ট (জিসি), এনকেডিএম এ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মেয়াদ ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত। এ কাজের মোট চুক্তি মূল্য হচ্ছে ৯২৮ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। মেট্রোরেল বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ৭টি সার্ভে পরিচালনা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে ৫টি শেষ হয়েছে, ২টি চলমান রয়েছে। ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট (আইডিসি) হিসেবে জাপানের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট লিমিটেডের সঙ্গে গত বছরের ৭ জুলাই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। এক্ষেত্রে চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ কোম্পানিটি কাজ শুরু করেছে। দায়িত্ব পালন করবে ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। রিসেটেলমেন্ট এ্যাসিসটেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিসিডিবির সঙ্গে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর চুক্তি হয়েছে। এক্ষত্রে চুক্তি মূল্য ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জনবল নিয়োগের কাজও এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের আওতায় প্রেষণযোগ্য ২৬টি পদের বিপরীতে ইতোমধেই ১৬ জন কর্মকর্তা যোগদান করেছেন। এছাড়া সরাসরি নিয়োগযোগ্য সাতটি সহকারী ম্যানেজার পদের বিপরীতে চারজন প্রকৌশলী কর্মকর্তা, একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং সরাসরি নিয়োগযোগ্য ১৩টি কম্পিউটার অপারেটর পদের বিপরীতে ৮ জন ইতোমধ্যেই যোগদান করেছেন। এছাড়া প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দ্রুত করতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। পরিকল্পনা হচ্ছে ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাজ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান, চুক্তি স্বাক্ষর এবং ২০১৭ সালের মে মাসের মধ্যে কাজ সমাপ্তকরণ। সিভিল এ্যান্ড বিল্ডিং ওয়ার্ক চলতি বছরের অক্টোবরে টেন্ডার ও চুক্তি স্বাক্ষর এবং ২০১৯ সালের মধ্যে কাজ শেষ। সিভিল ওয়ার্ক স্টেশন তৈরি (উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত) চলতি বছরের মে মাসে প্রস্তাব আহ্বান, সেপ্টেম্বর থেকে নবেম্বরের মধ্যে দরপত্র আহ্বান, আগামী বছরের অক্টোবরে চুক্তি স্বাক্ষর এবং ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে। সিভিল ওয়ার্ক স্টেশন (ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত) চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নবেম্বরের মধ্যে দরপত্র আহ্বান, আগামী বছরের অক্টোবরে চুক্তি স্বাক্ষর এবং ২০২০ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। ই এ্যান্ড এম সিস্টেমের দরপত্র চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দরপত্র আহ্বান, আগামী বছরের অক্টোবরে চুক্তি এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে শেষ করা হবে। রোলিং স্টোক এ্যান্ড রোলিং স্টোকের জন্য ডিপোর্ট ইক্যুপমেন্ট বিষয়ে চলতি বছরে জুলাইয়ে দরপত্র আহ্বান, আগামী বছর জুনে চুক্তি এবং ২০১৯ সালের মার্চে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, এর আগে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয় সংসদে ‘মেট্রোরেল আইন-২০১৪’ বিল উত্থাপন করা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদের চতুর্থ অধিবেশনের শেষ কার্য দিবসে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি উত্থাপন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিলটি অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। তারও আগে ১০ নবেম্বর মন্ত্রিসভা বিলটি অনুমোদন দিয়েছিল। গত বছরের ২৮ এপ্রিল এ আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেয়। ইতোমধেই এ প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছে। এখন চলছে কারিগরি কাজ। ইতোমধ্যেই মেট্রোরেলসহ চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জাইকার সঙ্গে অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। এর আওতায় প্রথমপর্যায়ে প্রায় ৬ হাজার ২৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঋণ এবং ৭২ কোটি টাকার অনুদান প্রদান দেবে সংস্থাটি। সহজ শর্তে দেয়া জাইকার এই ঋণের সুদ হচ্ছে শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এছাড়া ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, রাজধানীর যানজট নিরসনে প্রায় ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য হিসাবে জাইকা ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাকি পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দেবে সরকার। পরিবর্তিত রুট অনুযায়ী, মেট্রোরেল উত্তরা থেকে পল্লবী, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, প্রেসক্লাব ও মতিঝিল (বাংলাদেশ ব্যাংক) পর্যন্ত যাবে। পথে স্টেশন থাকবে মোট ১৬টি। তিনটি পর্যায়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ২০১৯ সালের মধ্যে পল্লবী থেকে সোনারগাঁও ১১ কিলোমিটার চালু করা হবে। এর পরের বছরে হোটেল সোনারগাঁও হতে মতিঝিল এবং ২০২১ সাল নাগাদ উত্তরা হতে পল্লবী অংশে ট্রেন চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
×