ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইসলাম প্রসঙ্গ ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

রসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

রসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রবর্তিত  সমাজ ব্যবস্থা

এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সারওয়ারে কায়েনাত, নূরে মুজাস্সাম সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামীন প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহ্মাদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে। তাঁর পূর্বে যত সব নবী-রসূল পৃথিবীতে এসেছেন তাঁদের কেউ এসেছেন পথহারা নিজ কওমকে সৎপথের দিশা দিতে, কেউবা এসেছেন একটা বিশেষ গোষ্ঠীর বা এলাকার অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষকে হিদায়াত দান করতে। কিন্তু প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এলেন সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য, তিনি এলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু প্রিয়নবী (সা.) কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন : (হে রসূল) আপনি বলুন : হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার জন্য সেই আল্লাহর রসূল যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, তিনি জীবিত করেন ও মৃত্যু ঘটান ( সূরা আ’রাফ : আয়াত ১৫৮)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু আরও ইরশাদ করেন : (হে রসূল), আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি। (সূরা সাবা : আয়াত ২৮)। তিনি পৃথিবীকে এমন এক সমাজব্যবস্থা দান করলেন যা অনন্য সুন্দর জীবনব্যবস্থা। যে সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে শোষণ ও নির্যাতনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়া হলো, কেউ খাবে আর কেউ খাবে নাÑ এই অসমতা ও অন্যায়সমূহ শেকড় শুদ্ধ একেবারে উৎপাটিত করবার নীতিমালা স্থিরীকৃত করে দেয়া হলো। বিত্তবানদের একচেটিয়া পুঁজি কুক্ষিগত করবার সকল পথ রুদ্ধ করবার দিশা দেয়া হলো। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আর ওদের (বিত্তবানদের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের। (সুরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)। ‘ইন্ফাক ফী সাবিল্লিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়, সাদাকা, কর্যে হাসানা, প্রভৃতির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে একটি সচ্ছল ও সমতার সমাজব্যবস্থা কায়েম করা হলো। যার ফলে এমন একপর্যায়ে মুসলিম উম্মাহ্ এসে পৌঁছুতে পেরেছিল যখন সমাজে যাকাত নেবার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যেত না বরং সমাজের সবাই সাহিবে নিসাব অর্থাৎ যাকাত দেনেওয়ালার সামর্থ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় সহজ-সরল জীবনযাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং অপচয় ও বিলাসিতাকে পরিহার করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। এই সমাজব্যবস্থা মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে দিয়ে সৌভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার সমাজ কায়েমের দিকনির্দেশনা দেয়। এই সমাজব্যবস্থায় মানুষ যে একই উৎস থেকে আবির্ভূত হয়েছে সে সত্যটিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলবার ওপর গুরুত্বারোপ করে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবকিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন : কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে আদম মাটি থেকে, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাক্ওয়া। এই তাক্ওয়া বা সংযমী জীবনের মধ্যে, এই সাবধানী জীবনের মধ্যেই এই সমাজব্যবস্থার মর্মকথা নিহিত রয়েছে। এই সমাজব্যবস্থায় ক্রীতদাস প্রথাকে উৎখাত করবার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বলবৎ করা হয় এবং ক্রীতদাসকে আযাদ করে দেয়াকে অশেষ সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষিত হয়। এক সময় যে হযরত বিলাল (রা.) ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁকে কয়েকগুণ মূল্য দিয়ে হয়রত আবূ বকর (রা.) সহ সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম তাঁকে সাইয়্যেদুনা আমাদের সরদার সম্ভাষণে অভিহিত করতেন। নারীরা তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার লাভ করল এই সমাজব্যবস্থার আওতায়। নারী পিতার সম্পত্তির ওয়ারিশ বলে গণ্য হলো, তেমনি স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্বও লাভ করল। শুধু তাই নয় প্রিয়নবী (সা.) ঘোষণা করলেন : ‘মায়ের পায়ের তলে সন্তানের জান্নাত।’ এই সমাজব্যবস্থায় মাতা-পিতার হক, সন্তানের হক, স্ত্রীর হক, পরিবারের প্রতিটি সদস্যের হক, সমাজের প্রত্যেক মানুষের হক, শ্রমিকের হক, প্রতিবেশীর হক, ছোটদের হক, বড়দের হক, মানুষের প্রতি মানুষের হক নিশ্চিত করা হলো। প্রিয়নবী (সা.) বললেন : ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তাঁর ন্যায্য পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ তিনি বললেন : ‘কেউ পেট পুরে খেলে আর তার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ সুদ প্রথা মানুষের ওপর একটা মারাত্মক নির্যাতনমূলক প্রথা চালু ছিল। প্রিয়নবী (সা.) সমস্ত প্রকারের সুদকে হারাম ঘোষণা করলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তিরই ন্যায় দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা বদ্ধপাগল বানিয়ে তোলে। এটা এজন্য যে, তারা বলে কেনাবেচাতো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ্ কেনাবেচাকে হালাল করেছেন ও সুদকে করেছেন হারাম (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৫)।’ নারী-পুরুষ নিয়েই সমাজ। সমাজে শালীনতা বজায় রাখার জন্য এবং শয়তানের প্ররোচনা হতে সমাজকে রক্ষার করার জন্য পর্দা করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে নবী! আপনি আপনার বিবিগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা আহ্যাব : আয়াত ৫৯)।’ নারীদের পর্দা করার ব্যাপারে আরও ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না (সূরা আহ্যাব : আয়াত ৩৩)।’ নর-নারী উভয়ের জন্যই সংযত দৃষ্টি এবং পর্দার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে রসূল, মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে, এটাই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে; তারা যেন সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ছাড়া সৌন্দর্য শোভা প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা ঢেকে দেয়, তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র (সতীন পুত্র), ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নে, আপন নারীগণ তাদের অধীনস্থ দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌন কামনা রহিত পুরুষ, এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞবালক ছাড়া কারো নিকট তাদের সৌন্দর্য শোভা প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে প্রদক্ষেপ না করে (সূরা নূর : আয়াত ৩০-৩১)।’ (বাকি অংশ আগামী শুক্রবার)
×