ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ইবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০২:৫৪, ২৩ জানুয়ারি ২০১৫

ইবোলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম

প্রায় ১২ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ যাওয়ার পথে টম ক্লানসির নির্বাহী আদেশ (ঊীবপঁঃরাব ঙৎফবৎ) শীর্ষক এক গুপ্তচৌর্যিক উপন্যাসে পৃথিবীর সবচাইতে মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে ইবোলার কথা জানতে পারি। সেই উপন্যাসে ইবোলায় আক্রান্ত এক রোগী থেকে এই রোগের প্রকৃতি ও প্রতিষেধক উদ্ভাবন এবং এ রোগ উৎসারিত ভাইরাস বা বিষ মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অপচেষ্টার কল্পিত কাহিনী বলা হয়েছে। তখন এ আশঙ্কাকে আমল দেইনি, বিশ্বাস করিনি, করতে হলো ২০১৪-তে এসে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে ইবোলা আক্রান্ত একজন বা দু’জন রোগী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ সরকার সর্বাত্মক সাবধানতা ও তৎপরতার সঙ্গে দেশে এর বিস্তারণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সময়ে আফ্রিকার লাইবেরিয়া, গিনি ও সিওরালিয়নে মহামারী রূপে ইবোলা দেখা দেয়। এই সংক্রমণ ক্রমান্বয়ে নাইজিরিয়া, স্পেন ও জার্মানিতে প্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই সময় একজন বা দু’জন ইবোলায় সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বমোট ১৭,৮৩৪ ব্যক্তি ইবোলায় আক্রান্ত হন। এঁদের মধ্যে ৮,৩৮৬ জন মারা যান। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা যে, আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ রোগে আক্রান্ত ও মারা যাওয়া অবিদিত লোকসংখ্যা হিসাবে নিলে ২০১৪-১৫ সালে ইবোলায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া প্রকৃত লোকসংখ্যা হবে অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত জানা গেছে যে, ইবোলা ভাইরাস বা বিষের ৫টি শ্রেণী আছে : (১) বান্দীবিগাইয়ু ভাইরাস, (২) সুদান ভাইরাস, (৩) তাই ফরেস্ট ভাইরাস, (৪) জায়ার ইবোলা ভাইরাস ও (৫) রেস্টন ভাইরাস। এদের মধ্যে জায়ার ইবোলা ভাইরাস সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় যে ইবোলার মহামারী এসেছিল তা জায়ার ভাইরাস উৎসারিত। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের রেকর্ড অনুযায়ী ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ সুদানের নজারাতে প্রথম ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই ব্যাধিতে ওই সময় ২৮৪ জন সংক্রমিত হন এবং এর মধ্যে ১৫১ জন মারা যান। নজারাতে শনাক্তকৃত ইবোলা ছিল সুদান ভাইরাস বা বিষ উৎসারিত। একই বছরের আগস্টে তখনকার উত্তর জায়ারে বা এখনকার গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ইবোলার সংক্রমণ ঘটে। এই সংক্রমণে ৩১৮ জন আক্রান্ত হন। তাঁর মধ্যে মারা যান ২৮০ জন। এই সংক্রমণে ভাইরাস বা বিষ হিসেবে যা কাজ করেছে তা জায়ার ইবোলা ভাইরাস নামে শনাক্ত হয়েছে। জায়ারের ইবোলা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তখনকার প্রেসিডেন্ট মবোতু সে দেশের রাজধানী কিনসাসাসহ আক্রান্ত অঞ্চলকে রোগ-অন্তরণ বা কোয়ারিনটাইনে নিয়ে তার সঙ্গে সংযোগকারী সকল সড়ক, নদীপথ ও বিমানবন্দর সেই এলাকায় সামরিক শাসন জারি করে বন্ধ করে দেন। একই সময়ে স্কুল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংস্থাসমূহও বন্ধ করে দেয়া হয়। কোন এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে বসবাসরত সকল জনগণকে গায়ের জোরে সামরিক শাসনের আওতায় এনে রোগবিশেষের প্রাদুর্ভাব দমন করার এই ধরনের হাস্যকর অপচেষ্টা কেবল আফ্রিকার সেই দেশই হাতে নেয়া সম্ভব হয়েছিল। তখন ইবোলার কোন প্রতিষেধক বা নিরাময়ী ওষুধ উদ্ভাবিত ছিল না। এখনও এর সাধারণ্যে ব্যবহার্য কোন নিরাময়ী ওষুধ শনাক্ত বা উদ্ভাবিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভাইরাসবিদ বিজ্ঞানী ন্যান্সি সুলিভান ও গেরি নেভেল প্রায় এক যুগ কাজ করে ইবোলার প্রতিরোধমূলক টিকা উদ্ভাবন করেছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু এই টিকা এখনও সাধারণ্যে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন প্রত্যায়িত করেনি। ১৯৯৫ সালে আবার জায়ারে বা এখনকার গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে এই ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই ব্যাধিতে তখন এই দেশে আক্রান্ত হন ৩১৫ জন। এদের মধ্যে মারা যান ২৫৪ জন। ২০০০ সালে উগান্ডাতে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন ৪২৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ২২৪ জন মারা যান। ২০০৩ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ইবোলার সংক্রমণে ১৪৩ জন আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে ১২৪ জন মারা যান। ২০০৭ সালে উগান্ডাতে বান্দীবিগাইয়ু প্রকৃতির ইবোলার প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ প্রাদুর্ভাবে ১৪৯ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ১৩৭ জন মারা যান বলে বিদিত হয়। ২০১২ সালে উগান্ডাতে আবার ইবোলার সীমিত প্রাদুর্ভাবে ৩১ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ২১ জন মারা যান। এক্ষেত্রে সুদানইবোলার ভাইরাস রোগের কারণ হিসেবে শনাক্ত হয়। একই বছরে বান্দীবিগাইয়ু ইবোলায় গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ৫৭ জন আক্রান্ত হন এবং ২৯ জন প্রাণ হারান এবং তারপরে এইবার অর্থাৎ ২০১৪-১৫তে পশ্চিম আফ্রিকায় এই মহামারীতে ৮,৩৩৬ লোকের মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) ইবোলা ভাইরাসকে জীব নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে চতুর্থ বা সবচাইতে মারাত্মক ব্যাধির পর্যায়ে শ্রেণীভুক্ত করেছে। একই কেন্দ্র ইবোলা ভাইরাসকে জৈব সন্ত্রাসের শ্রেণীতে প্রথম শ্রেণীর সন্ত্রাসী ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত করেছে। বলা হয়েছে যে, এই ভাইরাসকে জৈব যুদ্ধের মারণাস্ত্রে রূপান্তর করা যায়। ২০১৪-এর ৮ আগস্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইবোলা সংক্রমণকে গণস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা হিসেবে বিশেষায়িত করেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইবোলার সংক্রমণকে আধুনিক যুগের গণস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সবচাইতে মারাত্মক জরুরী অবস্থার দ্যোতক বা মহাবিপদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কুসংস্কার ও বন-জঙ্গলে আবৃত আধুনিক যোগাযোগের সুবিধাবঞ্চিত আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই রোগের অবিদিত অভিঘাত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বিদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের ইবোলা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ইবোলার প্রাদুর্ভাব প্রথম ঘটে বলে জানা গেছে। একই এলাকাকে এইচআইভিÑ এইডসের উৎপত্তিস্থল হিসেবেও সন্দেহ করা হয়েছে। এই রোগে ২০১৪ সালে আক্রান্ত জনগণের মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ গিনি, লাইবেরিয়া ও সিওরালিয়নের অধিবাসী বলে জানা গেছে। ইবোলা ভাইরাস বা বিষ মানুষ ও বানরের মাঝে ইবোলা রোগের সৃষ্টি করে বলে জানা গেছে। প্রকৃতির মধ্যে বাদুড় এই রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের ফলখেকো বাদুড়ে জায়ার ও রেস্টন প্রকৃতির ইবোলার প্রতিরোধ ক্ষমতা বিদ্যমান বলে জানা গেছে। এর অর্থ বাংলাদেশ ও এশিয়ায় ইবোলা ভাইরাসের নিলয় বিদ্যমান থাকতে পারে। এই রোগ সংক্রমণের ২-২১ দিনের ভেতর জ্বর, গলাব্যথা, পেশীব্যথা, মাথা ধরা শুরু হয়। তার পরে আসে অবিরাম বমি, ডায়রিয়া বা উদারাময়, চর্মক্ষত বা ফুসকুড়ি। এর পরে যকৃৎ ও মূত্রাশয় দুর্বল হতে থাকে এবং শরীরের ভেতর ও বাইরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ফলে রক্তচাপ কমে যায় এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। এই রোগে আক্রান্ত জনগণের মধ্যে গড়ে শতকরা ৫০ জনের মৃত্যু ঘটে। এই রোগের সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত মানুষ বা পশুর শরীর থেকে নির্গত তরল পদার্থ যেমন বুকের দুধ, রক্ত, লালা, বীর্যের সঙ্গে সুস্থ ব্যক্তি বা পশুর সংস্পর্শে । আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত থালা-বাসন ব্যবহারের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়িয়ে যায়। বায়ু মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ইবোলা রোগ ভাল হওয়ার পরেও কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে নির্গত রস বা তরল পদার্থ অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে। চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের জানা মতে, এখনও ইবোলার কোন প্রতিরোধ বা প্রতিষেধকমূলক ওষুধ উদ্ভাবিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ও প্রিভেল্সন-সিডিসি) এর প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জার্মানি ও ডেনমার্কে এই লক্ষ্যে নিরন্তর গবেষণা চলছে। কার্যকর প্রতিরোধক ও প্রতিষেধকের অবর্তমানে এই রোগে সংক্রমিত না হওয়ার লক্ষ্যে চিকিৎসক ও গবেষকরা সংক্রমিত এলাকায় (১), সময়ান্তরে হাত ধোয়া, (২) রোগীকে নিরন্তর বা কোয়ারানটাইন করা, (৩) প্রতিরক্ষণমূলক পরিধেয় ব্যবহার করা, (৪) সুচ ও সিরিঞ্জ নিরাপদে বিনষ্ট করা, (৫) বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং (৬) রোগে মারা যাওয়া ব্যক্তির শব নিরাপদে মাটি চাপা দেয়ার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। বলাবাহুল্য এরূপ পদক্ষেপ নেয়ার ফলেও ইবোলাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এতদসত্ত্বেও পশ্চিম আফ্রিকায় এ রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সেবার জন্যে গত বছর চিকিৎসক, সেবিকা ও স্বাস্থ্য প্রশাসকরা মানবসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
×