ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খালেদার ॥ অবরোধ হরতাল ॥ ১৫ দিনে প্রাণ গেল ১৮ যাত্রী ও ১২ চালক-শ্রমিকের

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২২ জানুয়ারি ২০১৫

খালেদার ॥ অবরোধ হরতাল ॥ ১৫ দিনে প্রাণ গেল ১৮ যাত্রী ও ১২ চালক-শ্রমিকের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যাত্রী ও গণপরিবহন জিম্মি করে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৫ মাসে নিহত হয়েছে ৩২৪। আহত হয়েছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৫। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতা, পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মরেছে ২২২ যাত্রী, ৭৩ চালক ও পরিবহন শ্রমিক। এ সময় ২৬ হাজার ৩৭৪টি যানবাহন ভাংচুর, ১ হাজার ১৬২ যানবাহনে আংশিক অগ্নিসংযোগ ও ৭৮১ যানবাহন সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। এছাড়া ফিশপ্লেট খুলে ও লাইন উপড়ে রেলে ২১দফা নাশকতা চালানো হয়। নৌপথে নাশকতা চালানো হয় তিনটি। এসব ঘটনায় প্রায় ১৩ হাজার ২২৩ যাত্রী পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচীর কারণে পরিবহন খাতে দিনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার বেশি। বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সাম্প্রতিক নাশকতায় আহত হয়ে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৪২৫ যাত্রী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত তথাকথিত হরতাল-অবরোধের রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮ যাত্রী, ১১ চালক ও শ্রমিকের মৃত্যু হয়। একই সময় সারা দেশে ৫৭২ যানবাহনে আংশিক অগ্নিসংযোগসহ ৬৫ যানবাহন সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে ৩ হাজার ২৩১ যানবাহন। সরকারী পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ৫০ বাসে অগ্নিসংযোগ ও ৩১৭ বাস ভাংচুর করা হয়েছে। এ সময় ৪ দফা রেলে নাশকতা চালানো হয়। এসব ঘটনায় আহত হয়ে ৫৫ হাজার ২১৭ যাত্রী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচীর সহিংস থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে রাজপথ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যানবাহন। নির্মমভাবে নিহত হচ্ছে নিরীহ যাত্রী। ভস্মীভূত হচ্ছে শত শত কোটি টাকার যানবাহন। পেট্রোলবোমার আগুনে অঙ্গার হচ্ছে যাত্রী, চালক, পরিবহন শ্রমিক। তথাকথিত প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে ভাংচুর করা হচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি। ফলে গণপরিবহন সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। আবার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীতে গণপরিবহন সঙ্কটের কারণে অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ‘গণপরিবহনে রাজনৈতিক সহিংসতা নিরসন কর্মসূচী’র আওতায় দেশের দশটি জাতীয় ও পাঁচটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদন মনিটর করে গণপরিবহনে রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ক এক প্রতিবেদন-২০১৫ তৈরি করা হয়েছে। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন মহাসড়কে বিজিবি ও পুলিশ পাহারায় যাত্রী ও পণ্যবাহী বাস/ট্রাক চলাচলের চেষ্টা চলছে। তবে তা খুবই সীমিত। কোটি টাকা দামের অভিজাত বাসগুলো রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না সহিংসতার কারণে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের অস্ত্র হিসেবে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে গণপরিবহন ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। জনগণের ব্যবহারের রাস্তাও রাজনৈতিক কর্মসূচীর আওতার বাইরে থাকছে না। এটা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি বলে আমরা মনে করি। নেতৃবৃন্দ বলেন, সব সময় সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সরকার বিরোধীদের কর্মসূচী ঠেকাতে গণপরিবহনকে ব্যবহার করে আসছে। এক্ষেত্রে তারা যাত্রী ও শ্রমিকদের জীবন ও স্বার্থের কথা ভাবছেন না। একটা স্বাধীন ও সভ্য দেশের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক। সারা দেশের সড়ক পরিবহনে যে ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাণ প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৬০ কোটি টাকা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাজধানীর সঙ্গে দেশের সকল জেলায় সড়ক যোগাযোগ এখনও সচল নয়। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ যেন ডেডলক হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, শুধু ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধে সড়ক পরিবহনে ২৮-৩১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। রাজধানীতে স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখে এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, দেশ সচল আছে। আজ সারাদেশে প্রতিটি নাগরিকের মনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজনৈতিক কর্মসূচী ও আন্দোলনের ধরন পাল্টানোর আহ্বান জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি, মানুষের জীবন কেড়ে নেয়ার জন্য নয়। তাই ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত, নিহত, পঙ্গুত্ব বরণকারী সকল যাত্রীর চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। সংগঠনের চেয়ারম্যান শরীফ রফিক উজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন সংগঠনের মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রাজীব মীর, অধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমান, তেজগাঁও কলেজের অধ্যাপক আশিক খান নতুন, ব্র্যাকের গবেষক প্রিসিলা রাজ, সমিতির সহসভাপতি ডাঃ এএম শামিমুজ্জামান, যুগ্ম মহাসচিব এম মনিরুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রুমি, কেন্দ্রীয় সদস্য ইয়াসমিন আক্তার সীমা, মাহমুদ হোসেন, ইমাম হোসেন উপস্থিত ছিলেন। নেতৃবৃন্দ বলেন, চলতি বছরের পাঁচ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচীর কারণে আবারও সহিংসতা শুরু হয়। ওদিন রাতেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করলে সরকার সমর্থিত পরিবহন মালিকরা অবরোধ উপেক্ষা করে রাস্তায় গাড়ি চালানোর নির্দেশ দেয়। কিন্তু নাশকতার ভয়ে পরিবহন চালকরা রাস্তায় নামতে সাহস পাচ্ছেন না। তার পরও পেটের দায়ে রাস্তায় গাড়ি নামাতে বাধ্য হচ্ছেন চালক-শ্রমিকরা। জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে যাত্রী, চালক, পরিবহন শ্রমিককে নির্মমভাবে জীবন দিতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যালসহ দেশের সকল মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের ভয়ঙ্কর চিত্র দেখে বিবেকবান মানুষ ভারাক্রান্ত না হয়ে পারে না। এসব সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিকদের শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়তা ও আংশিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও সাধারণ যাত্রীরা সরকার বা কোন সংস্থা থেকে কোন প্রকার চিকিৎসা বা আর্থিক সহায়তা পায়নি।
×