ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপি জোটের নাশকতা মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে উত্তপ্ত সংসদ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ২১ জানুয়ারি ২০১৫

বিএনপি জোটের নাশকতা মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে উত্তপ্ত সংসদ

সংসদ রিপোর্টার ॥ অবরোধ-হরতালের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল নাশকতা-সহিংসতা এবং পৈশাচিক কায়দায় মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল জাতীয় সংসদে। ক্ষোভে ফেটে পড়া সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা দলীয় কার্যালয়ে থেকে মানুষ হত্যার নির্দেশদাতা খালেদা জিয়াকে ‘খুনী ও হৃদয়হীন নেত্রী’ উল্লেখ করে তাঁকেসহ বিএনপি-জামায়াতের সকল শীর্ষ নেতাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করে বিচারের দাবি জানান। একইসঙ্গে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও হত্যাকা-ের শিকার ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ারও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানান তাঁরা। প্রধানমন্ত্রীর পর বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদও মঙ্গলবার সংসদে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের নামে সহিংসতা-নাশকতা প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। কঠোরহস্তে সহিংসতা-অরাজকতা দমনে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর যে কোন পদক্ষেপকে সমর্থন দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি দিয়ে কোনকিছু আদায় বা অর্জন করা যায় না। কেন তারা দেশকে শ্মশান বানাতে চাইছে। এসব নাশকতা ও মানুষ হত্যা মুখ বুঝে সহ্য করা যায় না, মেনেও নেয়া হবে না। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অনির্ধারিত এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। বিরোধী দলের নেতা ছাড়াও অনির্ধারিত এই বিতর্কে অংশ নেন সরকারী দলের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট তারানা হালিম, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজি, বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি দিয়ে কোনকিছুৃ আদায় বা অর্জন করা যায় না। হরতাল-অবরোধ এখন জনমনে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতাল-অবরোধের নামে একের পর এক সহিংসতা-অরাজকতা ও নৃশংসতা ঘটেই যাচ্ছে, এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। বাসে-প্রতিষ্ঠানে আগুন দিচ্ছে, পেট্রোল বোমা মেরে ছোট ছোট শিশুদের যেভাবে পুড়িয়ে মেরেছে, তা দেখে কোন মানুষ চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি বেড়েই চলেছে। ট্রেনে ফিশপ্লেট তুলে ফেলে দুর্ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ। জনগণকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে। জনগণকে প্রতিপক্ষ হিসেবে ধরে নিয়ে এসব নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আনতে পারছে না। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীও রেহাই পাচ্ছে না। তাদের হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিশ্ব এজতেমায় ঈমানদার মুসল্লিরা আসতে পারেনি, স্বস্তিভাবে আন্দোলনকারীরা এজতেমা পালন করতে দেয়নি। সত্যিকার মুসলমান হলে অবরোধ শিথিল করা উচিত ছিল। ১৫-১৬ দিনে অর্থনৈতিকভাবে দেশ ২৫/৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, প্রায় ৫০ জনের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। ৫শ’ গাড়িতে আগুন দিয়েছে। এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে কোন খেলায় মেতে উঠেছে? এত হত্যার দায়-দায়িত্ব কার? কে নেবে? লাখ লাখ শ্রমিক-মজুর অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্প হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন নিজেরা অরাজকতা সৃষ্টি করছি? এ ধরনের মানসিকতা নিয়ে দেশের কল্যাণ করা যায় না। দেশকে শ্মশান বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? বিরোধী দলের নেতা আরও বলেন, সন্ত্রাস-সহিংসতা-অরাজকতা কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী হতে পারে না। এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। বিনা কারণে নিরীহ জনগণ সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। কীভাবে এসব বন্ধ করা যায় সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো পৃথিবীর সবদেশেই হয়। তার জন্য কেন এ অরাজকতা সৃষ্টি করতে হবে? তিনি বলেন, হরতাল-অবরোধের নামে দাবি আদায়ে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সঠিক পথ নয়। যেভাবেই হোক এসব সন্ত্রাস-নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, নৈরাজ্য-সহিংসতা বন্ধ করতে হলে প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নেবে, তাতে আমরা সমর্থন দেব। আমরা জনগণের কল্যাণ ও শান্তি চাই। এ ধরনের অরাজকতা আমরা আর দেখতে চাই। শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোরহস্তে দমনে প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিন, আমরা সহযোগিতা দেব। তিনিও পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় সন্ত্রাস-নাশকতা প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়া আন্দোলনের নামে সরাসরি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। খালেদা জিয়া একজন খুনী। খুন করার নির্দেশ দিয়ে খুনীদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি বলেন, একাত্তরে উনি ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন, উনার স্বামী তাঁকে ফিরিয়ে নিতেও ব্যর্থ হয়েছেন। আজ খালেদা জিয়া দেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইছেন। তিনি বলেন, নিজের স্বামীর জন্মবার্ষিকীতেও মাজারে যাননি। বরং নিরীহ মানুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েই যাচ্ছেন। সন্ত্রাসী-নাশকতাকারীদের ধরে জনগণ গণধোলাই দেয়া শুরু করেছে। জনগণ ক্ষেপে উঠছে। এটা আন্দোলন নয়, সন্ত্রাসী কর্মকা-। পরাজিতরা একাত্তরের বদলা নিতে চায়। খালেদা জিয়া নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন মানুষ, তিনি দেশকে ধ্বংস করতে চান। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, একাত্তরের মতো গর্জে উঠে পরাজিত শক্তিকে আরেকবার পরাজিত করুন। তিনি বলেন, বিশ্ব এজতেমার মধ্যেও হরতাল-অবরোধ ডেকেছেন। তার হরতাল-অবরোধ হয় না, লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্ব এজতেমায় যোগ দিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছে। খালেদা জিয়ার টার্গেট হলো গরিব-দুখী-শ্রমিক মানুষ। এটা কী তাঁর কোন ধরনের রাজনীতি? কোন আন্দোলনে খালেদা জিয়া সফল হয়নি। আগামীতেও হবেন না। উনি (খালেদা জিয়া) বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান, কিন্তু সফল হবেন না। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া দেশ ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। লাশ ফেলানোই বিএনপির ইতিহাস। সরকার থেকেও মানুষ মেরেেেছ, এখনও নিষ্ঠুরভাবে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। বিএনপি গণতান্ত্রিক দল নয়, একটি ফ্যাসিস্ট, জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসীদের দল। জিয়ার হাতও রক্তে রঞ্জিত, কালিমালিপ্ত। কোন বিচার ছাড়াই জিয়া শত শত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছেন। ডিনার খেতে খেতে ফাঁসির অনুমতি দিয়েছে জিয়া। তাঁর হাতে গড়া দল জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসী হবেই। এই ফ্যাসিস্ট-গণবিরোধী-জঙ্গীবাদী দানব বিএনপি-জামায়াতরা থাকবে না, শান্তিপ্রিয় জনগণ ও গণতন্ত্র থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপি-জামায়াতের নাশকতার বিরুদ্ধে দেশের মানুষ আজ জেগে উঠেছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করেছে। খালেদা জিয়া একজন পরাজিত সৈনিক। তাঁর সৈনিকরা পালিয়ে গেছে উনি এখন একা। জনসমর্থন ও নিজ দলের নেতাকর্মীসহ সবকিছু হারিয়ে হতাশ খালেদা জিয়া ভাড়া করা গু-া-টোকাইদের ভাড়া করে মানুষ হত্যার মিশনে নেমেছেন। যত রাগ এখন জনগণের বিরুদ্ধে, সেই রাগে মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন। দেশের কোথাও অবরোধ হচ্ছে না, অবরোধ হচ্ছে শুধু খালেদা জিয়ার ঘরে। শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে খালেদা জিয়া বারবার হেরে গেছেন, এবারও হেরেছেন, আগামী নির্বাচনেও পরাজিত হবেন। ২০১৯ সালে নির্বাচন হবে, একদিন আগেও নয়। পরাজিত সৈনিকের সঙ্গে কেন সংলাপ হবে? সরকারী দলের শেখ ফজলুল করিম সেলিম বিএনপিকে মিথ্যাচারের দল হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, জনগণের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। জঙ্গী-সন্ত্রাসী-স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে খালেদা জিয়া আবারও হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছেন। ৫০ নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। মানুষ হত্যাকারীর সঙ্গে কীসের সংলাপ? নির্বাচনের ট্রেন উনি ফেল করেছেন। উনার ভুলের খেসারত কেন জনগণ দেবে? এখন আর বসে থাকা যাবে না। অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বাইরে রাখলে আরও মানুষের সর্বনাশ হবে। তিনি বিএনপি-জামায়াতকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধেরও দাবি জানান। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা অবিলম্বে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩০টি হত্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, আমরা পেছাবও না, পরাজিতও হব না- বিজয় আবার আমাদের হবে। খালেদা জিয়া দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধাতে চান। আবদুল মতিন খসরু বলেন, ক্ষমতায় যাওয়ার নেশায় উম্মত্ত খালেদা জিয়া দেশের ১৬ কোটি মানুষের গায়ে আগুন দিচ্ছেন। ৩০ জন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছেন খালেদা জিয়া। সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩০টি হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। নইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ব্যর্থ হবেন। জামাই আদরে রাখবেন না, হুকুমদাতা বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের গ্রেফতার করুন। খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচন নয়, বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের মূল এজেন্ডাই হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান কীভাবে মামলা থেকে রেহাই পাবে এবং একাত্তরের ঘাতকরা মুক্তি পাবে। একাত্তরের ঘাতক জামায়াত বিএনপির পেটে ঢুকে গেছে, বিএনপি এখন জামায়াতের কথায় উঠবস করছে। বিএনপি রাজনৈতিক দল নয়, সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে। আইএস এবং লাদেনের পেতাত্মা বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কোন সংলাপ নয়, বরং নির্মূল করতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রতিটি ঘটনার জন্য খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াতের সকল শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বলেন, খালেদা জিয়া মানুষ নামের কলঙ্ক, নিজেকে মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়ার কোন অধিকার তাঁর নেই। ২৮ জন মানুষকে উনি পুড়িয়ে মেরেছেন। ২০ দলে যেসব ইসলামিক চিন্তাবিদ আছেন, তাদের উচিত এখনই বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা। নইলে কেয়ামতেও তাঁরা স্থান পাবেন না। তিনি প্রয়োজনে সেনাবাহিনী নামিয়ে জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের নির্মূল এবং জঙ্গীনেত্রী খুনী খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে মানসিক চিকিৎসা প্রদানের দাবি জানান। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজি বলেন, এটা আন্দোলন নয়, রীতিমত হত্যাযজ্ঞ চলছে। জনগণ কোনভাবেই তা গ্রহণ করছে না। রাজপথে না থেকে গুপ্তঘাতকের মতো মানুষ হত্যা কখনও রাজনীতি হতে পারে না। এটা রাজনীতি নয়, কসাইগিরি চলছে।
×