ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে বারো পেশাদার বোমাবাজ গ্রেফতার

মতিঝিলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বোমাবাজ নিহত

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২০ জানুয়ারি ২০১৫

মতিঝিলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বোমাবাজ নিহত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা দেশব্যাপী চলমান অবরোধে কিছু ভাড়াটে সন্ত্রাসীও নাশকতা চালাচ্ছে। ঢাকায় চলমান অভিযানে পেশাদার শীর্ষ ১২ বোমাবাজ গ্রেফতারের পর এমন তথ্য মিলেছে। গ্রেফতারকৃতদের অর্থের যোগান দিত অবরোধ আহ্বানকারী দলের কতিপয় শীর্ষ নেতা। তাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। চলমান অভিযানে সোমবার ভোরে মতিঝিলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ডজনখানেক মামলার আসামি অজ্ঞাত এক পেশাদার বোমাবাজ নিহত হয়েছে। শনাক্ত হওয়া বোমাবাজ ও সরবরাহকারী হিসেবে আরও ৬ জনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গত ৫ জানুয়ারি বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকে সমাবেশ করার অনুমতি না দেয়ায় ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধের ডাক দেয় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। অবরোধের বাইরে ছিল না বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসমাবেশ বিশ্ব এজতেমাও। অবরোধে দেশের লাখ লাখ মানুষ এজতেমায় যোগ দিতে পারেননি। এজতেমার যাত্রীদের অবরোধের কারণে বাধ্য হয়ে বাতিল করতে হয়েছে হাজার হাজার যানবাহনের আগাম বুকিং। অবরোধে নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যায়নি। তারা গ্রেফতার এড়িয়ে ভাড়াটে বোমাবাজদের দিয়ে সারাদেশে চোরাগোপ্তা হামলা পরিচালনা করেছে। চলমান নাশকতায় অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বিচারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, নারী, শিশু, ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষ, পথচারী, রোগী, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষসহ অন্তত কয়েক হাজার মানুষ। অনেককেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। দগ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন শতাধিক মানুষ। ভাংচুর শেষে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কমপক্ষে দুই শতাধিক যানবাহন। অবরোধে ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। নাশকতাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলমান অভিযানে রাজধানী থেকে ১২ বোমাবাজ গ্রেফতার হয়েছে। এরা হচ্ছে, ইকবাল হোসেন রানা (৩২)। পিতা জয়নাল আবেদীন। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানাধীন বিক্রমপুর গ্রামে। ঢাকার শাহবাগের তোপখানা রোডের ৩৭ নম্বর বাড়িতে বাস করত। মমিনুল ইসলাম মনির ওরফে বোমা মনির (৩২)। পিতা মৃত আব্দুল খালেক ক্বারী। বাড়ি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানাধীন ৯ নম্বর লতা চাপলি ইউনিয়নে। সে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন খোদনাইল চৌধুরীপাড়ায় থাকত। আলাউদ্দিন চৌধুরী ওরফে বোমা বাবু (৩০)। পিতা নুরুন্নবী চৌধুরী। বাড়ি নোয়াখালী জেলার মাইজী থানাধীন ধন্যপুর গ্রামে। ঢাকার খিলগাঁও থানাধীন পূর্বগোড়ানের ১৯৮/১ নম্বর বাড়িতে বসবাস করত। কায়সার আহম্মেদ সোহেল ওরফে বোমা সোহেল (৩০)। পিতা দেলোয়ার হোসেন। বাড়ি ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থানাধীন আগ্রাবাদ এলাকায়। আব্দুল মালেক ওরফে বোমা মানিক (৩১)। পিতা ইদ্রিস মিয়া। বাড়ি নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানাধীন বদরপুর গ্রামে। ঢাকার কামরাঙ্গীচরে আল্লাহরদান এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাত। রফিকুল ইসলাম রিপন ওরফে বোমা রিপন (৩৫)। পিতা নুরুল ইসলাম। বাড়ি নরসিংদী জেলার বেলানগর থানাধীন বেলাবো ঘাটিয়ালপাড়ায়। রুবেল (২৩)। পিতা মৃত আয়নুল হক। বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানাধীন নীললক্ষ্মী গ্রামে। আব্দুর রহমান ওরফে রহমান ওরফে বোমা রহমান (৩৮)। পিতা মৃত আব্দুল কাদের। বাড়ি বংশাল থানাধীন চুড়িওয়ালগলির ১১৭ নম্বর বংশাল রোডে। হারুনুর রশীদ (২০)। পিতা আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া। বাড়ি ফেনী জেলা সদরের বিরলী এলাকায়। ঢাকার মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের ১২৩/এ নম্বর বাড়িতে থাকত। ফারহান রহমান (১৮)। পিতা আসাদুর রহমান। বাড়ি ঢাকার চকবাজার থানাধীন নওয়াব দেউরীর ১৯ নম্বরে। উজ্জ্বল হোসেন (২৬)। পিতা মৃত মহন মিয়া। বাড়ি ঢাকার বংশালের পুরাতন মোগলটুলীর ৩৯/১ নম্বরে। সোহেল ওরফে চাঁন সোহেল ওরফে মিলন (২৮)। পিতা সোহরাব হোসেন। বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানাধীন জিটকা গ্রামে। ঢাকার বংশালের হাজী আব্দুল সরকার লেনের মাহমুদ পাগলার বাড়িতে থাকত। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতরা ৫শ’ টাকা থেকে শুরু করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার চুক্তিও করত। বাস ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বাসে পেট্রোল বোমা মেরে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতার জন্য বিভিন্ন রেটে টাকা দেয়া হত। গ্রেফতারকৃতরা পেশাদার বোমাবাজ। তারা বোমা তৈরি ও সরবরাহও করত। তাদের বোমা তৈরির অর্ডার দিত দেশব্যাপী চলমান অবরোধ কর্মসূচী আহ্বানকারী বিশ দলীয় জোটের কতিপয় নেতা। গ্রেফতারকৃতরা বেশ কয়েকজন নেতার নামও প্রকাশ করেছে। প্রকাশ করা নেতাদের মধ্যে স্থানীয় নেতার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রীয় কতিপয় নেতার নির্দেশে কাজটি পরিচালনা করত। তাদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এদিকে রাজধানীতে চলমান অভিযানে সোমবার রাত তিনটার দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এক বোমাবাজ গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশের অভিযানকালে বোমাবাজরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও গুলি চালায়। পুলিশও গুলি চালায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে গুলিবিদ্ধ এক বোমাবাজসহ একটি পিস্তল, দুই রাউন্ড তাজা বুলেট ও ৫টি হাতবোমা উদ্ধার করে। রাত চারটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরুল কায়েস (৩০) বোমাবাজের মৃত্যু হয়। পিতা আনোয়ার হোসেন। বাড়ি নড়াইল জেলার ডুমুরতলা থানাধীন দূর্গাতলা গ্রামে। যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ মুশুদ্দি এলাকার ভাড়ায় থাকতেন। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক। তিনি এলএলবি পরীক্ষা দিয়েছেন। ডিবির পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জনকণ্ঠকে জানান, তার বিরুদ্ধে নড়াইল থানায় আটটিসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে। নিহত বোমাবাজ মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনায় ১৪ পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত পুলিশ কনস্টেবল শামীমকে বিদেশ পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর থেকেই ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালাতে বোমা, বোমা তৈরির বিস্ফোরক, তৈরিকৃত বোমার মজুদ চলছিল। ঢাকায় চলমান অভিযানে ২০১০ সালের ২৩ মে কদমতলী থানাধীন ধনিয়া এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, তৈরিকৃত আধুনিক বোমা, ৯টি অত্যাধুনিক শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড, আত্মঘাতী হামলা চালানোর সরঞ্জামাদিসহ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার হয়। ২০১০ সালের ৩০ জুলাই রাজধানীর শাহআলী থানাধীন উত্তর বিশিলের ৭০/ক নম্বর বাড়ি থেকে তিন ধরনের ৪০ কেজি বিস্ফোরক, ১টি এসএমজি (স্মল মেশিনগান), ১টি বিদেশী স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, ১টি তাজা হ্যান্ডগ্রেনেড, বোমার ২৫টি ডেটোনেটর, তিন ব্যাগ বোমার স্পিøন্টার, ১৮ রাউন্ড এসএমজি ও নাইন এমএম পিস্তলের গুলি, গ্রেনেডের ৩৬টি খোলস, শতাধিক ইলেকট্রিক ও কাঁটাযুক্ত ঘড়ি ও বোমা তৈরির ফর্মুলাসহ প্রচুর জিহাদী বই উদ্ধার হয়। একই বছর ২৭ অক্টোবর মিরপুর-১ নম্বর কালওয়ালপুরের ১/জি, ২/১০ নম্বর ৫ তলা বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও জিহাদী বইসহ রাজশাহী-১ আসনের সাবেক সাংসদ ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, খুলনা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুল আলম, বেসরকারী নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কন্ট্রোলার জামায়াতে ইসলামীর মিরপুর পশ্চিম শাখার আমির মাহফুজুর রহমানসহ ২০ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। ২০১১ সালের ১৪ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মীর হাজীরবাগের ৩৬৪ নম্বর বিএনপি নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটুর বাড়ি থেকে দুই দফায় প্রায় ৮৭টি বোমা উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয় বাড়ির কেয়ারটেকার বেলায়েত হোসেন। তিনি বোমাগুলো রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছিল বলে আদালতে জবানবন্দী দেন। স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, জামায়াত-শিবির ও বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ক্যাডারদের আস্তানা ছিল বাড়িটি। বোমার তৈরি ও মজুদের কাজটি তদারকি করতেন লিটু ও তার এক ছেলে। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগ বাগবাড়ি এলাকার বরিশাল জেলার হিজলা থানা বিএনপি নেতা আব্দুল খালেকের ৫ তলা বাড়ির ছাদে বোমার তৈরির সময় বিস্ফোরণে বাড়ির মালিকসহ বোমাবাজ রাসেল (২৫) ও আরাফাত (২৪) আহত হয়। বাড়ি থেকে ১ কেজি গানপাউডারসহ প্রায় ২ কেজি বিস্ফোরক, বোমা তৈরির কৌটা, কাঁচ, পাথরসহ অন্যান্য কাঁচামাল উদ্ধার হয়। সূত্র বলছে, গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়ে আবার বোমা তৈরি, মজুদ ও সরবরাহসহ নাশকতা চালাচ্ছে।
×