ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাদাসিধে কথা ॥ একটুখানি শান্তি

প্রকাশিত: ০২:৫৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৫

সাদাসিধে কথা ॥ একটুখানি শান্তি

॥ এক ॥ আমি জানি না সবাই লক্ষ্য করেছিল কিনা- শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছিল যে, এখন থেকে এসএসসি আর এইচএসসির রেজাল্টের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি হবে। খবরটা জেনে আমি যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে বিষয়টা নিয়ে কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু তার মাঝে সারাদেশে অবরোধ শুরু হয়ে গেল- মানুষের কী কষ্ট। এখন কার আর মনের অবস্থা আছে পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে লেখাপড়ায়? কিন্তু যেহেতু কথা দিয়েছি প্রতি দুই সপ্তাহে একবার করে লিখব, তাই কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। কী লিখব নিজেও জানি না। গণতন্ত্র নিয়ে লেখা যেতে পারে, পত্রপত্রিকায় দেখছি সবাই আজকাল গণতন্ত্র নিয়ে লিখছে, কথা বলছে। পৃথিবীর কতগুলো দেশে গণতন্ত্র আছে দেখার জন্য ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে বেশ অবাক হলাম। ‘খাঁটি গণতন্ত্র’ নাকি আছে মাত্র পঁচিশটি দেশে। বেশিরভাগই ইউরোপের দেশ, তার মাঝে ভারতবর্ষের নাম নেই! খাঁটি গণতন্ত্রী দেশ হিসেবে আমেরিকা আর জাপানের নাম আছে বলে রক্ষা; এই দেশগুলোতে মোটামুটি মানুষের সংখ্যা বেশি, তা না হলে খাঁটি গণতন্ত্র উপভোগকারী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ থেকেও কম হতো। আমেরিকা জাপানকে নিয়ে সংখ্যাটা দশ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে! আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে অবশ্যি আমার খুবই সন্দেহÑ প্যালেস্টাইন নামক ভূখ-ের মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার দূরে থাকুক, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারকে তারা যেভাবে দলিত করে বেড়ায় তখন নিজের দেশে গণতন্ত্র উপভোগ করার বিষয়টুকুকে এক ধরনের উৎকট রসিকতা মনে হয়! বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রজেক্ট হাতে নেয়ার কারণে সেই দেশগুলোর এখন যা অবস্থা তাতে গণতন্ত্র শব্দটাকে রীতিমতো ভীতিকর বলে মনে হয়। বাইরে থেকে রফতানি করা এই গণতন্ত্রের কারণে শুধু ইরাকেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ মারা গেছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্রের কতটুকু ভেতরে আমরা যেতে পেরেছি আমি জানি না, বলা যেতে পারে বড় জোর কয়েকবার নির্বাচন করেছি। মজার কথা হলো নির্বাচনের পরে সব সময়েই যে দল হেরে গেছে তারা ঘোষণা দিয়েছে এই নির্বাচনে ‘কারচুপি’ হয়েছে এবং এই নির্বাচনের ফলাফল তারা মানে না। আরও মজার কথা হলো শেষ পর্যন্ত হেরে যাওয়া দল যদি বা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছে তারা কিন্তু কখনোই সংসদে যায় না! ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি ছাড়া সংসদে যাওয়ার কোন আগ্রহ নেই। সংসদে হাজির না থাকলে সাংসদ পদ বাতিল হয়ে যাবে বলে দল বেঁধে একদিন সংসদে হাজির হয়েছে কিন্তু তার বেশি তাদের কাউকে কিছু করতে দেখিনি। তাই আমাদের দেশে কেউ যখন গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন তখন আমার খুব জানার ইচ্ছে করে তারা কোন্্ ধরনের গণতন্ত্রের কথা বলছেন। সাংসদদের ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কি গণতন্ত্র? নাকি সাংসদ পদ টিকিয়ে রাখার জন্য একদিন সংসদে হাজির হওয়া গণতন্ত্র? এই টুকুতেই আমরা খুশি থাকব? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে খুব পছন্দ করেন। বেশি ভোট পেয়ে একজন নির্বাচিত হন, যিনি হেরে যান তিনিও কম ভোট পান না। তাই নির্বাচিত সাংসদরা যখন একেবারেই সংসদে যান না তারা কিন্তু এই দেশের মানুষের সঙ্গে রীতিমতো বেইমানি করেন। আমাদের দেশে নির্বাচন ভোট গণতন্ত্র এ সব বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা হয়; কিন্তু নির্বাচিত হয়ে একদিনও সংসদে না গিয়ে পুরো গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দেয়া হয়- সেটা নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনা হয় না। কাজেই যখন সবাই গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তখন আমার জানার কৌতূহল হয় এটা কী শুধু নির্বাচন করে সরকার গঠন করার প্রক্রিয়া নাকি তার চাইতে বেশি কিছু। যদি এটা শুধু সরকার গঠন করা হয় তখন হঠাৎ করে এই পুরো ব্যাপারটাতে আমি উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। যারা সরকার গঠন করেন তাঁরা কিন্তু দেশ চালানোর ‘দায়িত্ব’ গ্রহণ করেন না, ‘ক্ষমতা’ গ্রহণ করেন! আমার মনে হয় শব্দটা যে ‘দায়িত্ব’ মোটেও ‘ক্ষমতা’ নয়, সেটা সবাইকে ভাল করে বুঝিয়ে দেয়া দরকার। যদি ধরে নেই আমাদের দেশে নির্বাচনই হচ্ছে গণতন্ত্র, এর থেকে বেশি আশা করা আহাম্মুকি তাহলেও আমার একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এই নির্বাচনে অংশ নেবে কারা? আমি এক চক্ষু হরিণের মতো, এই দেশের সবকিছুকে আমি একবার হলেও মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার দিয়ে পাঠিয়ে দেখি। বাংলাদেশটা তো এমন নয় যে, এটা গাছে ধরেছিল একদিন পেকে টু করে নিচে পড়েছে আর আমরা তুলে এনেছি। ভয়ঙ্কর একটা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল; সেই যুদ্ধে এই দেশের একটি পরিবারও ছিল না যাদের কোন না কোন আপনজন হারিয়ে যায়নি। এই যুদ্ধে আমরা টিকে গিয়েছিলাম, কারণ একাত্তরে আমরা এক সঙ্গে ছিলাম, আমরা স্বাধীন একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কেউ কল্পনাও করতে পারবে না আমরা কত বড় সৌভাগ্যবান জাতি যে মাত্র নয় মাসে আমরা আমাদের স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে এই পৃথিবীতে কত জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কত জাতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম রিফিউজি ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে, আমরা কি কখনও চিন্তা করে দেখেছি? আমাদের এ দেশটির জন্য এককভাবে অবদান রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান। আমাদের মতো সবাই যারা একাত্তরকে নিজের চোখে দেখেছে তারা সবাই জানে সেই উত্তাল সময়ে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু আসলে সমার্থক ছিলেন। তিনি হঠাৎ করে উঠে আসেননি। এই দেশে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন, কষ্ট করেছেন। আমি সুযোগ পেলেই সবাইকে বলি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা একবার পড়ে দেখতে। দেশের জন্য রাজনীতি করতে হলে একজনকে কত বড় আত্মত্যাগ করতে হয়, সেটি এই বইটি পড়লে বোঝা যায়। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। বাংলাদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশকে অস্বীকার করে যেমন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়া যায় না, ঠিক সেরকম বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করেও এই দেশের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে গণতন্ত্রের জন্য জান কোরবান করে দেয়া যায় না। খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে শুধু অস্বীকার করেনি, তাঁকে অসম্মান করার জন্য এমন আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছে যেটি আমার পক্ষে কাগজেও লেখা সম্ভব নয়। যে কোন রাজনৈতিক দলই ছোট-বড় ভুল করে থাকে, কাজেই বিএনপিও যে ভুল করবে না তা নয়। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্যকে মেনে নিয়ে কিংবা তার পক্ষে সাফাই গেয়ে তারা সম্ভবত রাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুলটি করে বসেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি এই দেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছিল; বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে তারা সম্ভবত তাদের কফিনে এখন পাকাপাকিভাবে পেরেক ঠুকে দিয়েছে। এই দলটি এখন কী এই দেশের মানুষের কাছে কোন সমবেদনা খুঁজে পাবে? ॥ দুই ॥ আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ চলছে। হরতাল বলতে কী বোঝায় আমরা সেটা মোটামুটি জানি। অবরোধ শব্দটির অর্থ আমরা বুঝতে পারি কিন্তু এই দেশের বেলায় অবরোধ বলতে কী বোঝায়- সেটা আমি জানি না। শুধু আমি না, আমার ধারণা কেউই জানে না। যারা অবরোধের ডাক দিয়েছে তারাও জানে না। হরতালের আগের রাতে গাড়ি পোড়ানোয় কিছু মানুষ মারার রেওয়াজ আছে। অবরোধের সময় কখন গাড়ি পোড়ানো হবে? হরতাল ডাকতে হয়, যারা হরতালকে সমর্থন করেন তারা ঘর থেকে তখন বের হবেন না, দোকানপাট খুলবেন না। কিন্তু হরতালের মতো অবরোধ ‘ডাকা’ যায় না, অবরোধ ‘করতে’ হয়। এখানে কে অবরোধ করবে ব্যাপারটি পরিষ্কার নয়। বিএনপি দেশবাসীকে অবরোধ করতে বলছে কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত দেশবাসী গায়ে পড়ে এই দেশের রেলগাড়ি, স্টিমার, লঞ্চ অবরোধ করার জন্য এগিয়ে যাবে না। কখনও যায় না। অবরোধের কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হবে। তারা নিজেরা সেই কাজটি কেমন করছে? এখন পর্যন্ত বারো থেকে তেরোজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক শত মানুষ। অসংখ্য গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। ট্রেনলাইনের ফিশপ্লেট খুলে ট্রেনকে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমার খুবই অবাক লাগে যে, একটি রাজনৈতিক দল ভেবেচিন্তে খুবই ঠা-া মাথায় এ কাজগুলো করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে? খবরে দেখেছি বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে এই কষ্ট সহ্য করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। দেশের মানুষকে পথে নেমে আসতে বলা হয়েছে, জানানো হয়েছে সরকারকে উৎখাত না করা পর্যন্ত এ অবরোধ চলতে থাকবে। সত্যি কী এভাবে একটা সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব? চরম অরাজক একটা অবস্থা তৈরি করার পর দেশে সামরিক বাহিনী নেমে গিয়ে সবকিছু ওলটপালট করে দেয়া ছাড়া আর কী সম্ভব হতে পারে- আমি ভেবে পাই না! ॥ তিন ॥ আমি চুরানব্বই সালে দেশে ফিরে এসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলাম। যোগ দেয়ার কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে ছাত্রদলের ছেলেরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানা অনুষ্ঠান নানা প্রতিযোগিতা, রাজাকারদের দুষ্কর্ম নিয়ে বক্তৃতা বিতর্ক। ছাত্রশিবির ক্ষেপে গিয়ে ছাত্রদলের একজনের পায়ের রগ কেটে দিল। একজনের পিঠে চাকু মেরে দিল- আমি নিজে সেই তদন্ত করেছি। এখন সেই রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সেই রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে, আমি এই রাজনৈতিক দলের ভেতরের কাউকে চিনি না কিন্তু তারপরও আমি বলতে পারি এই রাজনৈতিক দলের সদস্যরা নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধী দলের সহযোগী দল পরিচয়ে বিন্দুমাত্র গৌরব অনুভব করেন না। আমি সব সময়েই স্বপ্ন দেখি এই দেশের সরকারী দল আর বিরোধী দল দুটিই হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। দুটি দলই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নেবে। যতদিন সেটি না হচ্ছে ততদিন গণতন্ত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখার কোন সুযোগ নেই। ॥ চার ॥ জানুয়ারির ৫ তারিখ এই দেশে সবকিছু নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা ছিল। আমি তখন ঢাকায়, খবরে নানা ধরনের প্রস্তুতির খবর দেখছি। বালু ও ইটবোঝাই ট্রাক, পুলিশ, মিটিং-মিছিলের প্রস্তুতি, দেশের মানুষকে পথে নেমে আসার আহ্বান। বাসে আগুন। ঝটিকা মিছিল। আমি যেখানে থাকি তার ঠিক পাশে একটা বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। শ্রমিকরা কাজ করছিল, সকাল থেকে সেখানে তারা কিছু একটা করছে, ঠক ঠক শব্দে কান ঝালাপালা! কানের কাছে এই বিকট শব্দে আমার বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি বিরক্তি অনুভব করছিলাম না। আমি জানি এই শ্রমিক সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যাবেলা তার পারিশ্রমিক নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, তার স্ত্রীসন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবে। আমার বিরক্ত হওয়ার অধিকার নেই! আমার খুব ইচ্ছে করছিল সেই শ্রমিকটিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, পুরো দেশের এ অবস্থায় তার মনের ভাবনাটি কী? আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি কিন্তু আমি নিশ্চতভাবে জানি সে কী উত্তর দেবে। শ্রমিকটি বলবে- আপনাদের দোহাই লাগে আমাদের শান্তিতে থাকতে দিন। কিভাবে দেবেন আমার জানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। এই মুহূর্তে এ দেশের মানুষের মনের কথা সম্ভবত একটাই- আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। কিভাবে সেই শান্তি আসবে আমরা জানি না কিন্তু এ দেশের মানুষ হিসেবে এটুকু চাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। ১৪.০১.১৫
×