ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেই তেজস্ক্রিয় এসএস পাইপ বোঝাই কন্টেনার খোলা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫

সেই তেজস্ক্রিয় এসএস পাইপ বোঝাই কন্টেনার খোলা হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম থেকে বেসরকারী পর্যায়ে ভারতের উদ্দেশে রফতানি করা স্ক্র্যাপ জাহাজের এসএস (স্টেনলেস স্টিল) পাইপের চালান বোঝাই একটি কন্টেনার শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর সেটি ফেরত এসেছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের পরমাণু কমিশন কেন্দ্রে পুনর্পরীক্ষার পর তা নিশ্চিত হওয়ায় দেশী-বিদেশী ৩৬ বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞের একটি দলের তত্ত্বাবধানে বুধবার চট্টগ্রাম বন্দরের ৪ নম্বর জেটি এলাকায় কন্টেনারটি খোলা হয় এবং তেজস্ক্রিয় পদার্থ রয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়। তবে এ তেজস্ক্রিয় পদার্থ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কন্টেনার অভ্যন্তর থেকে বের করা যায়নি। আজ বৃহস্পতিবার এটি বের করে সংরক্ষণ করা হবে বলে কাস্টম সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। কাস্টম সূত্র জানায়, গত বছরের এপ্রিলে চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকার মাবিয়া স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠান স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের পুরনো লোহাসহ নানা যন্ত্রপাতির সঙ্গে এক কন্টেনার স্টেনলেস স্টিল ভারতে রফতানি করে। ভারত যাওয়ার পথে কলম্বো বন্দরে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকালে কন্টেনারে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়ে। এতে কন্টেনারটি চট্টগ্রাম বন্দরে ফেরত পাঠানো হয়। কাস্টম সূত্র জানায়, রফতানিকালে চট্টগ্রাম বন্দরে পারমাণবিক ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ শনাক্তকরণে কোন যন্ত্রপাতি ছিল না। ফলে এ চালানটি যেতে সক্ষম হয়। জানা গেছে, মাবিয়া স্টিল কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে আমদানির একটি স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটার পর এসব এসএস পাইপ সংগ্রহ করে। এ জাতীয় এসএস পাইপ দেশের বিভিন্ন স্থানে সচরাচর বিক্রি হয়ে থাকে। আবার ইউরোপ, দুবাই, ভারত, গ্রীসসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ স্ক্র্যাপ জাহাজের জেনারেটর, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ ও এসএস পাইপ আমদানি করে। ভারতে যায় বিশেষ করে স্ক্র্যাপ জাহাজের পিতল ও এসএস পাইপ। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যায় পুরনো জেনারেটর ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ। ভারতে রফতানিকৃত এ চালানটিও ছিল অনুরূপ রফতানির একটি চালান। মাবিয়া স্টিল কর্তৃপক্ষ ঐ সময়ে ৫ কন্টেনার বোঝাই স্ক্র্যাপ জাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, পুরনো লোহা ও এসএস পাইপ এবং সিংক রফতানি করে। কলম্বো বন্দরে এসএস পাইপ ও সিংক বোঝাই চালানটি উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এটিকে আটকানো হয় এবং চট্টগ্রাম বন্দরে ফেরত পাঠানো হয়। গত মে মাসে কন্টেনারটি চট্টগ্রাম বন্দরে ফেরত আসে। সংরক্ষণ করা হয় জেটিতে। বিষয়টি চট্টগ্রাম কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের নজরে আনার পর এটি নিয়ে শুরু হয় চিঠি চালাচালি। দেশে উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয় যন্ত্রাংশ অপসারণে মূলত কোন ব্যবস্থা নেই। তবে তেজস্ক্রিয় নিরূপণে রয়েছে পরমাণু ও আণবিক শক্তি কমিশন। চট্টগ্রাম পরমাণু ও আণবিক শক্তি কমিশনে এর নমূনা পরীক্ষার পর এটিতে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে বলে সত্যতা মেলে। বুধবার এটির চূড়ান্ত পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তা মেলে ২ হাজার মাইক্রোসিবার্স পার আওয়ার, যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ ধরনের তেজস্ক্রিয়তা অপসারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কোন সুবিধা নেই। ফলে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে পত্র দেয়। এ কর্তৃপক্ষের অধীনে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিশ্বের ৫০ বন্দরের। চিঠির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রীলংকার ১৫ সদস্যের বিজ্ঞানী দল গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম এসে পৌঁছে। তাদের সঙ্গে চট্টগ্রাম আণবিক শক্তি কমিশন ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের আরও ২১ জন বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত হয়ে মোট ৩৬ জনের নেতৃত্বে এ চালান নিরূপণ ও অপসারণের দল গঠিত হয়। দলটি মঙ্গলবার বন্দর এলাকায় অপসারণপূর্ব মহড়াও চালায়। বুধবার সকাল থেকে কন্টেনারটি খুলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির মাধ্যমে পরীক্ষা- নিরীক্ষা শুরু হয়। কন্টেনার থেকে সতর্কতার সঙ্গে একেকটি এসএস পাইপ ও সিংক বের করা হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অধিকাংশ পণ্য বের করার পর বলা হয় কন্টেনারটির একেবারে শেষ অংশে ছোট্ট একটি সোর্সে তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে। যা আজ বৃহস্পতিবার বের করা হবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের আণবিক শক্তি কমিশনের ডিরেক্টর মাসুদ কামাল। বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় ডিরেক্টর মাসুদ কামাল সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, এ তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধ্বংস করা যায় না। কিন্তু সতর্কতার সঙ্গে সংরক্ষণ করে রাখতে হয়। সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাংলাদেশের রয়েছে। রফতানিকালে শনাক্ত না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি মত দেন যে, ঐ সময়ে তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা কার্যক্রম যথাযথভাবে না হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। বর্তমানে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম চালু করায় ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটার আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, এ ধরনের তেজস্ক্রিয়তা থেকে গামারশ্মি ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে, যা বিপজ্জনক। তবে এ ধরনের বিপদের আশঙ্কা আর নেই। তার ভাষায়, ‘ইট ইজ সেফ।’ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার ও মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা আহমেদুর রেজা চৌধুরী জানান, তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন এ পদার্থ অপসারণ কাজটি প্রকল্পের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা ঘটলেও দেশী বিশেষজ্ঞ দিয়েই সমাধান করা যায়। উল্লেখ্য, সীতাকু-ের কদম রসূল এলাকার মাবিয়া স্টিলের মালিক জাহাঙ্গীর এ স্টিল পণ্যের রফতানিকারক। রফতানির পূর্বে ভারতীয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের মনোনীত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রফতানির এ পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু ঐ সময় তা নিরূপিত হয়নি। ফলে এটি রফতানির ছাড়পত্র পেয়ে যায়। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের সীতাকু- এলাকার শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে প্রতিনিয়ত আমদানির পুরনো স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটা হয়ে থাকে। যা থেকে সংগৃহীত হয় লোহা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও ফার্নিচার যা রিসাইকেল করে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। এরমধ্যে তামা, পিতল, জাহাজের ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে আসছে। এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও শনাক্ত হয়নি।
×