ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তিনি এসেছিলেন বলেই...

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

তিনি এসেছিলেন বলেই...

এটা একটা বড় প্রশ্ন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যদি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াত। এভাবে হয়ত অনেকেই আমরা ভাবি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেশে না ফিরে আসলে গোটা বিশ্ব বাংলাদেশকে এভাবে স্বীকৃতি দিত না। কেমন ছিল সে দিন, অর্থাৎ ১০ জানুয়ারির দিনটা। ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে একটি গান গেয়েছিলেন। এইচএমভি গানটির একটি রেকর্ড বের করেছিল। গানটির কথাগুলোÑ বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ ঘরে ঘরে এত খুশি তাই। কী ভাল তোমাকে বাসি আমরা, বলো কী করে বোঝাই। এদেশকে বলো তুমি বলো কেন এত ভালবাসলে, সাত কোটি মানুষের হৃদয়ের এত কাছে কেন আসলে, এমন আপন আজ বাংলায়... তুমি ছাড়া কেউ আর নাই বলো, কী করে বোঝাই। সারাটি জীবন তুমি নিজে শুধু জেলে জেলে থাকলে আর তবু স্বপ্নের সুখী এক বাংলার ছবি শুধু আঁকলে তোমার নিজের সুখ-সম্ভার কিছু আর দেখলে না তাই বলো কী করে বোঝাই। জুলফিকার আলী ভুট্টো অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে আসেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর পরিবার। লন্ডন সময় তখন ভোর ৮:৩০, ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ সাল। টাইম ম্যাগাজিন ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে লিখেছে- লন্ডনে বঙ্গবন্ধু উঠেছেন ক্লারিজ হোটেলে। প্রেসিডেন্ট মর্যাদায় একটি সুইটে রাখা হয়েছে তাঁকে। সারাদিনটাই তিনি বিশ্রাম নিলেন। দেখা করলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সঙ্গে। বিকেলে একটি প্রেস কনফারেন্স করলেন। বঙ্গবন্ধুকে নেয়ার জন্য একটি ভারতীয় ৭০৭ বোয়িং বিমান প্রস্তুত ছিল হিথ্রো বিমানবন্দরে। তিনি ভারতীয় বিমানে উঠলেন না। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছেÑ দুটো কারণে তিনি ভারতীয় বিমান এড়িয়ে গেলেন। প্রথমত, ভারতীয় বিমানে উন্মাদ পাকিস্তানীদের নাশকতার আশঙ্কা ছিল। দ্বিতীয়ত, শেখ মুজিব সবাইকে বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। ভারতের ওপর তারা নির্ভরশীল হতে চায় না। স্বদেশে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু উঠে পড়লেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বহরের কমেট জেটে। মূলত সেখান থেকেই আমাদের পরিশুদ্ধ পররাষ্ট্রনীতির যাত্রা শুরু। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানে একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর পাশেই বসা ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন বঙ্গবন্ধু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন সেই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার তো আনন্দের দিন। আপনি কাঁদছেন কেন?’ বঙ্গবন্ধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘এত যে মানুষ আমার অপেক্ষায়। আমি ওদের খাওয়াব কী? পাকিস্তানীরা তো সব ধ্বংস করে গেছে।’ সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদকের ভাষ্য ছিল এমনÑ ‘ঠিক দুপুর দেড়টায় প্রখর রোদের মধ্যে ঢাকার আকাশে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি কমেট জেট দেখা গেল, ঠিক তখনই জেটটি নামল না। আকাশ থেকে শেখ মুজিব তাঁর সোনার বাংলাকে দেখার ইচ্ছে করেছেন। সে কারণে প্রায় ৪৫ মিনিট আকাশে চক্কর মেরে মেরে পাইলট তাঁকে সোনার বাংলাকে দেখাল। সোনার বাংলা তখন শ্মশান।’ জাতির পিতা না হলে ওই মুহূর্তে এরকম কথা বলা যায় না। বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগ ছিল খুব স্বাভাবিক। রাস্তা নেই, ব্রিজ নেই, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোন অর্থ নেই। আজ ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারির সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার মজুদ আছে। হয়ত এ খবর অনেকের কাছে নেই- কিভাবে শুরু হয়েছিল আমাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার। কানাডা সরকার তখন বঙ্গবন্ধুকে আড়াই মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণের একটা উপহার দেয়। সেটাই রাষ্ট্র্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে শুরু করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বঙ্গবন্ধু যদি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন তাহলে কী অবস্থা হতো আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি। আমরা হয়ত ভুলে যাই ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে না হতেই প্রায় পঞ্চাশটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। শুধু বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই। তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই ১৯৭২ সালের ১২ মার্চে ভারতীয় সব সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থাতেই চীন ও সৌদি আরব ব্যতীত বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই আমরা স্বীকৃতি লাভ করেছিলাম। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলেও বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা ছিলেন বলেই ১৯৭৪ সালের বন্যায় সৌদি আরব আমাদের দিয়েছিল দশ মিলিয়ন ডলারের অনুদান। আমরা আজ প্রবাসীরা যে বিপুল বৈদেশিক অর্থেও যোগান দিচ্ছি তারও সূচনা হয় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর কুয়েত ও আরব আমিরাত সফর এই অঞ্চলে বাংলাদেশীদের কর্মলাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আমরা যে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্যাসক্ষেত্রের মালিক হয়েছি সেটাও বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা ও দেশপ্রেমের কারণে। এগুলোর মালিক ছিল বহুজাতিক কোম্পানি। ১৯৭৫ সালে তাঁর একক সিদ্ধান্তের কারণে বলতে গেলে বিনামূল্যে বাংলাদেশ এগুলো পেয়েছে। মাত্র ৪৫ লাখ পাউন্ডে আমরা এগুলোর মালিক হয়েছি। ফারাক্কার পানি বণ্টনে বঙ্গবন্ধু সরকার শুষ্ক মৌসুমে পেয়েছিল ৪৪,০০০ কিউসিক পানির নিশ্চয়তা। আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৩ হাজার কিউসেক পানি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিপরিষদ। ভারত ও ভুটানের হাইকমিশনারদ্বয় ছাড়াও সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার সেরে ব্রিটেন, রাশিয়ার কনসাল জেনারেল এবং অন্যান্য দেশের কূটনীতিকরা। চীন ও ইরানের কূটনীতিকরা ছিলেন অনুপস্থিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বাড ডি স্পিভাকও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিউইয়র্ক টাইম লিখেছে, স্পিভাক সামান্য ঝুঁকে এই বাঙালী নেতাকে স্বাগত জানালেন। হাত মেলালেন। বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, ঢাকায় ফিরে আসার জন্য স্বাগতম। বঙ্গবন্ধু শুনে হাসলেন। উত্তরে বললেন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। স্পিভাক নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধিকে জানাচ্ছেন, তিনি এ অনুষ্ঠানে সরকারীভাবে আসেননি। ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াত পেয়ে এসেছেন। বাঙালী-আমেরিকার সম্পর্কটা দুর্বল। ভাল নয়। এ উপস্থিতির কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। দি ওয়াশিংটন পোস্ট আরও জানাচ্ছে, স্পিভাক এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের দাওয়াত পেয়ে। এই দেশটিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠানের সাক্ষী হওয়ার জন্য সরকারের তরফ থেকে তাঁকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাক স্পষ্ট করেই বলেছেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি হলেন দেশটির পিতা। দেশে ফিরে এসেই দেশবাসীকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে বিশাল আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তিনি এ জনসভায় দাবি করেন, পাকবাহিনী ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করেছে। এ গণহত্যার জন্য দায়ী অপরাধীদের বিচার দাবি করলেন। তিনি বললেন, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনেই এ বিচার হবে। টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে, এই গণহত্যা তদন্তে জাতিসংঘকে একটি কমিশন তৈরি করতে অনুরোধ করলেন তিনি। তিনি সতর্ক করে বললেন, যদি জাতিসংঘ সেটা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই সেটা করব। কারণ তিনি সবার অগ্রপথিক। বঙ্গবন্ধু অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাবান জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামে তিনিই অধিনায়ক। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পর অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি দেশে ফিরে না আসলে অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কেউ ছিলেন না। আজকে পৃথিবীতে ধনী রাষ্ট্র ও দরিদ্র রাষ্ট্র বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেক বিশ্বনেতা সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু চার দশক আগে বঙ্গবন্ধু সেই কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। এখন অনেকে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের কথা বলছেন। কিন্তু সেই সময় বঙ্গবন্ধুর মতো করে অনেকে ভাবেননি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘আমি বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করে সে অর্থ দিয়ে দরিদ্র দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমানে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা বিপুল অর্থের এক দশমাংশও যদি জনগণের জন্য খরচ করা হয় তবে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য মুছে যাবে এবং তাতে বৃহৎ ব্যক্তিবর্গের মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে।’ সিংহপুরুষ শেখ মুজিব দেশে ফিরে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়। এটা অবশ্যই গবেষণার বিষয় বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কেউ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নেতা হিসেবে শর্তহীন বহির্সাহায্যের কথা বলতে পারতেন কিনা? লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×