ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছে ওরা

অবরোধের আগুনে ঝলসানো রোগীদের স্বজনের আর্তনাদ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৩ জানুয়ারি ২০১৫

অবরোধের আগুনে ঝলসানো রোগীদের স্বজনের আর্তনাদ

শর্মী চক্রবর্তী ॥ আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও, এই ছেলে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমার ছেলে তো কোন অন্যায় করেনি আল্লাহ! তার প্রাণ তুমি ভিক্ষা দাও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে লেগুনাচালক মোঃ সেলিমের পাশে বসে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন তার মা রহিমা বেগম। রবিবার সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে কমলাপুর সর্দার গার্মেন্টসের সামনে পেট্রোলবোমায় আহত হন সেলিম (৩০)। তাঁর শরীরের প্রায় ৩৬ ভাগ পুড়ে গেছে। বর্তমানে তিনি বার্ন ইউনিটের এইচডিইউ পুরুষ ওয়ার্ডে ২ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। দুই সন্তানের জনক সেলিম। বড় ছেলে হাশিম (৭)। প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে শিখার বয়স সাড়ে তিন বছর। বাবাকে দেখে চিনতে পারছে না তারা। সেলিমের পাশে গিয়েই তার মুখ দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে দুই শিশু। শিশুদের বোঝানো যাচ্ছে না এই তাদের বাবা। সেলিমের মা রহিমা বেগম বলেন, এই ছেলেই আমার সম্বল। আমার স্বামী নেই। ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে মুগদা মদীনাবাগে ভাড়া বাসায় থাকি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, প্রায় ৩ লাখ টাকা ঋণ করে লেগুনাটা কিনেছিল সেলিম। প্রতিসপ্তাহে এই ঋণ বাবদ ৮ হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়। সেলিমই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পরিবারের। আমরা দিন আনি দিন খাই। সেলিম একদিন গাড়ি চালাতে না গেলে না খেয়ে থাকতে হয় পরিবারের সদস্যদের। হাসপাতালে সেলিমের বেডের পাশে মেঝেতে শুয়ে আছেন তাঁর স্ত্রী হাসি। স্বামীর এই অবস্থায় নির্বাক হয়ে গেছেন হাসি। শুধু দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। একটু পর পর উঠে স্বামীর পুড়া শরীর দেখে চিৎকার করে উঠছেন তিনি। আর্তনাদ করে বলছেন, এখন আমার কী হবে? আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব। তুমি ছাড়া তো কেউ নাই আমার। হাসির চিৎকারে ভারি হয়ে উঠেছিল বার্ন ইউনিটের বাতাস। শুধু সেলিমের স্বজনরাই নন, অবরোধের আগুনে ঝলসে যাওয়া রোগীর স্বজনদের আর্তনাদে এখন ভারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। সেলিমের পাশের বেডে শুয়ে আছেন রিক্সাচালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণ (৪৫)। অমূল্যের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা থানার কাদেরপুর গ্রামে। স্ত্রী রতœা রানী বর্মন। তিন ছেলে, বড় ছেলে রতন কুমার বর্মণ এসএসসি পরীক্ষার্থী, মেজ ছেলে নিতাই বাবু পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে এবং তিন বছর বয়সী ছোট ছেলে জয় বর্মণ। এছাড়া প্রতিবন্ধী ছোট ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে অমূল্যের সংসার। পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বছরতিনেক আগে পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে ঢাকা এসেছিলেন। ঢাকায় রিক্সা চালান। গত কয়েক দিনের অবরোধে আয়-রোজগারে ভাটা পড়ায় ফিরে যাচ্ছিলেন গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন সামান্য কিছু টাকা আর স্ত্রী-সন্তানের জন্য কেনা কিছু সামগ্রী। তবে অমূল্য চন্দ্র আর প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারেননি। তার আগেই গত ১০ জানুয়ারি শনিবার রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় অবরোধের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন তিনি। পুড়ে গেছে সঙ্গে থাকা ৫ হাজার টাকা ও তার প্রিয় সন্তান ও স্ত্রীর জন্য কেনা সামগ্রীও। অমূল্য চন্দ্র এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। দগ্ধ অমূল্য চন্দ্র সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। তাঁদেরই একজন প্রকাশ জানান, ওই দিন তিনিও বাসে ছিলেন। অমূল্যসহ তাঁরা ৫ জন একই এলাকার। অবরোধে কাজকর্ম কম হওয়ায় সবাই মিলে একসঙ্গে বাড়ি যাচ্ছিলেন। এ জন্য সায়েদাবাদ থেকে গাবতলীগামী চলাচলকারী একটি বাসে ওঠেন তারা। বাসটি ফার্মগেট তেজগাঁও মহিলা কলেজের ফুট ওভারব্রিজের নিচে যেতেই হঠাৎ আগুন ধরে যায়। সবাই বেরিয়ে আসতে পারলেও আগুনে পুড়ে যান অমূল্য। অমূল্য বলেন, রিক্সা চালিয়ে পাঁচ হাজার টাকা ও কিছু সামগ্রী নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষায় ছিল আমি বাড়িতে যাব। কিন্তু তা আর হলো না। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মা শুধু চোখের পানি ফেলছেন। হরতালের কারণে কেউ আসতে পারছেন না। হাসপাতালে তাঁর সঙ্গে থাকা বন্ধুরা দেখাশোনা করছেন। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অমূল্য চন্দ্রের শরীরের ১২ ভাগ পুড়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছে শ্বাসনালীও। গত ৯ জানুয়ারি রাতে মগবাজার আগোরা মেগাশপের সামনে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয় প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম (৩০)। তার শরীরের ৩৩ ভাগ আগুনে পুড়ে গেছে। পুড়েছে শ্বাসনালীও। বর্তমানে তিনি বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। পেট্রোলবোমায় দগ্ধ আবুল কালামের গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট আবুল কালাম রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল নাদিমের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছিলেন। ছেলের পুড়ে যাওয়ার কথা শুনে গ্রামের বাড়ি বরিশাল থেকে ছুটে এসেছেন কালামের বৃদ্ধ মা সাফেয়া বেগম। আইসিইউর বাইরে বারান্দায় বসে তসবিহ হাতে আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করছেন আর চোখের পানি ফেলছেন। কোথায় কী হয়েছে কিছুই জানেন না। তিনি শুধু জানেন, অবরোধে তাঁর ছেলের শরীরটা পুড়ে গেছে। পাশে বসা কালামের বড় ভাই ইব্রাহিম জানান, মালিকের সঙ্গে রাতে মগবাজারে একটি কমিউনিটি সেন্টারে দাওয়াত খেতে যান। খাওয়া শেষে বাইরে গাড়িতে বসে মালিকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কালাম। তখনই পেট্রোলবোমা ছোড়া হয় তার গাড়িতে। আগুন ধরে যায় কালামের শরীরে। কালামের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আরও সময় না গেলে এখনই তাঁর বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা যাচ্ছে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল জানান, হাসপাতালে এখনও অবরোধে পেট্রোলবোমায় আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন তানজিমুল ইসলাম অয়নসহ ১০ জন। নিহত হয়েছে যশোরে দগ্ধ ট্রাকচালক মুরাদ। আহত দশজনের মধ্যে লেগুনাচালক সেলিম, প্রাইভেটকার চালক আবুল কালাম, রিক্সাচালক অমূল্য চন্দ্র বর্মণ ও সিএনজি অটোরিকশাচালক সিদ্দিকুর রহমানের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানান তিনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধের আগুনে পুড়ে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৫ জন এদের মধ্যে ১০ জন এখনও চিকিৎসাধীন। এদিকে সোমবার অবরোধে পেট্রোলবোমায় আহত ও পুলিশ সদস্যসহ প্রায় ২০ জনকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় তিনি ওয়ার্ড ঘুরে সকলের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। তখন তিনি আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন এবং তাঁদের চিকিৎসার দায়ভার সরকার গ্রহণ করবে বলে জানান। আহতদের খোঁজখবর নেয়ার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই হচ্ছে খালেদা জিয়ার আন্দোলনের নমুনা। সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে এখন তিনি মানুষকে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, হত্যা করছেন। তাঁর আন্দোলন-অবরোধের ডাকে জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। তিনি তাঁর গু-াপা-া লেলিয়ে দিয়ে সন্ত্রাস চালিয়ে জনগণকে ভয় দেখিয়ে লক্ষ্য অর্জন করতে চান কিন্তু তা কখনও হতে দেয়া হবে না। এসব সন্ত্রাসীকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। কোন ছাড় দেয়া হবে না।
×