ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আখেরি মোনাজাতে আজ শেষ হচ্ছে এজতেমার প্রথম পর্ব

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১১ জানুয়ারি ২০১৫

আখেরি মোনাজাতে আজ শেষ হচ্ছে এজতেমার প্রথম পর্ব

ফিরোজ মান্না/ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ চক্ষু তো অন্ধ হয় না, বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়। সূরা হজ-এর ৪৬ নম্বর আয়াতে এ কথার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের কথাকেই বোঝানো হয়েছে। এ আয়াতের নিগূঢ় অর্থ হচ্ছে, স্রষ্টার বিশ্বাসে, ভালবাসায় মানুষের হৃদয়ই মূলত অন্ধ হয়। তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বে টঙ্গীর এজতেমা ময়দানের আশপাশে মাইলের পর মাইল এলাকায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের পদভারে মুখরিত। যতদূর চোখ যায় কেবলই ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সফেদ মুখচ্ছবি। সৃষ্টিকর্তার বন্দনা, আরজ-গুজার, শোকরানা আর ইবাদত বন্দিগীতে মশগুল মানুষের কলরব। টঙ্গী এজতেমা প্রাঙ্গণে লক্ষ প্রাণের এ সম্মিলন যেন দেশ ও দশের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত। অবরোধ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা সবকিছুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভে মানুষের এ এক সাহসী অগ্রযাত্রা। সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালবাসায়, বিশ্বাসে নত মানুষের জয়গানের এ এক মহোৎসবও বটে। এ মহোৎসবের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ থেকে মানুষে। দেশ থেকে দেশান্তরে। আর এ মহান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধ সেঁধেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। এখান থেকে মুক্তি পেতে এজতেমায় আসা মুসল্লিরা বার বার বিএনপি-জামায়াতের কাছে মিনতি করেও কোন সাড়া পাননি। বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে এজতেমায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ আমন্ত্রণকে উপেক্ষা করে উল্টো দেশবাসীকে অবরোধ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। বিএনপি জোটের অবরোধের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের জন্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হেঁটে, র‌্যাব ও পুলিশ পাহারায় বাস ও ট্রেনে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। তাঁরা সৃষ্টিকর্তার নামে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় দিনে (শনিবার) লাখো মুসল্লির জিকির আজগার ও তবলীগ মুরব্বীদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। আজ (রবিবার) বিশ্ব এজতেমার প্রথম দফার আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। বিদেশী নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকেই রবিবার বেলা ১২টা থেকে ১টার মধ্যে শুরু হবে আখেরী মোনাজাত। এর আগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। শনিবার সকালেই টঙ্গী শহর এবং এজতেমাস্থল ও এর আশপাশ এলাকা যেন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব এজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসল্লির পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে। শিল্প নগরী টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। শনিবারও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। রবিবার আখেরী মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে এজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসল্লি নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন সিট ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে তাতেই অবস্থান নিয়েছেন। রবিবার হেদায়তি বয়ান ও আখেরী মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এবারের বিশ্ব এজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। আগামী শুক্রবার শুরু হবে তিন দিনের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। প্রথম পর্বের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার বাদ আসর শতাধিক জোড়া বর-কনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এবারও তবলীগের শীর্ষ মুরুব্বীরা রেডিও-টিভিতে আখেরী মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারে অনুমতি দেননি। ক্যামেরাও মুরুব্বীদের ছবি তোলাও বারণ করে দিয়েছে এজতেমা কর্তৃপক্ষ। তারপরও কিছু কিছু বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এজতেমা কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে আখেরী মোনাজাত সম্প্রচার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যৌতুকবিহীন বিয়ে ॥ শনিবারে বিশ্ব এজতেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরীয়ত মেনে তবলীগের রেওয়াজ অনুযায়ী এজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আছর এজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ওই বিয়ে। শনিবার সকাল থেকেই অভিভাবকরা দম্পতিদের নাম তালিকাভুক্ত করান। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকেই মোনাজাতের মাধ্যমে নব দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করা হয় এবং মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা-খেজুর ছুড়ে দেয়া হয়। এজতেমার ১ম দফার ২য় দিন শনিবার আছর নামাজের পর শতাধিক জোড়া বর-কনের বিয়ে হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ব এজতেমার এক জিম্মাদার। এবার প্রায় ৬ হাজার জামাত তবলীগের দাওয়াত নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ॥ তবলীগ জামাতের অন্যতম মুরুব্বী বলেন, তবলীগের একমাত্র কাজই আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা। রাসূল (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণের মূল বাণী হিসেবে আমরা আল্লাহর পথে ডেকে থাকি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর একমাত্র লক্ষ্য। একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের একক আনুকূল্যে এই এজতেমা হয়ে থাকে। টঙ্গীর এই এজতেমা থেকেই বিশ্বের ১৫০টি দেশে দাওয়াতের এই কাজ করা হয়। প্রতিবছর টঙ্গী এজতেমা থেকেই পাঁচ থেকে ছয় হাজার জামাত বিশ্বব্যাপী পাঠানো হয়। আগত বছরের বিশাল কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা টঙ্গী থেকেই হয়। তিনি সকল মুসলমানের কিছুটা সময় হলেও এজতেমায় ব্যয় করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এবারও প্রায় ছয় হাজার জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তবলীগের কাজে বেরিয়ে যাবে। আরও পাঁচ মুসল্লির মৃত্যু ॥ এজতেমা ময়দানে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত পাঁচ মুসল্লির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী থানার ওসি ইসমাইল হোসেন। তিনি জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত সোয়া ৭টার দিকে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার কীর্ত্তনিয়া গ্রামের মৃত মোহর আলীর ছেলে মোঃ আব্দুস সালাম (৫০), রাত ১১টার দিকে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা এলাকার মাহমুদুল হাসানের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৭১), রাত ১২টার দিকে নাটোর জেলার নলডাঙ্গা (মাঝের পাড়া) এলাকার মৃত নাদের ম-লের ছেলে কফিল উদ্দিন (৬৫), শনিবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব এলাকার খায়রুল কবীর ও পৌনে ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম থানার আব্দুল্লাহপুর এলাকার মৃত আক্কাছ আলীর ছেলে রিয়াজ উদ্দিন (৭৫)। এরা শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এজতেমা মাঠে ও টঙ্গী হাসপাতালে মারা যান। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ৬ মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ ট্রেন ॥ বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে ২৩টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আখেরী মোনাজাতের আগে ও পরে সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার আখেরী মোনাজাতের দিন জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ, লাকসাম-টঙ্গী রুটে বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। এছাড়াও আখেরী মোনাজাতের আগে-পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গীর স্টেশনের কর্মকর্তা মোঃ হালিমুজ্জামান। ১৭ পকেটমার-ছিনতাইকারী গ্রেফতার ॥ বিশ্ব এজতেমা ও আপপাশ এলাকা থেকে শুক্রবার রাতে থেকে সকাল পর্যন্ত পকেটমার ও ছিনতাইসহ নানা অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মোনাজাতের দিন চলবে শাটল বাস ॥ গাজীপুরের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, শনিবার রাত ১২টা থেকে রবিবার আখেরী মোনাজাতের সময় পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, আব্দুল্লাহপুর-কালিয়াকৈর সড়কে সাভারের বাইপাইল থেকে আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে মীরের বাজার পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে আখেরী মোনাজাতের দিন রবিবার সকাল থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকা থেকে এজতেমাস্থল পর্যন্ত মুসল্লিদের সুবিধার্থে প্রায় অর্ধশত বিআরটিসি বাস ও ব্যক্তি মালিকানাধীন আরও প্রায় অর্ধশত (এজতেমার স্টিকার লাগানো) শাটল বাস চলাচল করবে।
×