ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘পি কে’ বনাম ধর্ম ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৭ জানুয়ারি ২০১৫

‘পি কে’ বনাম ধর্ম ব্যবসা

অর্ধেক ভর্তি গ্লাসই যথেষ্ট এই পৃথিবীর জন্য যেখানে শুধু খালি পাত্রই পাওয়া যায়! বলছে ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকা, আরও বলছে ‘মুভি ম্যাজিক’ এর খোঁজে থাকলে অবশ্যই পি কে দেখা উচিত। তবে শুধু বিনোদনের জন্যই নয়, এই উপমহাদেশের সকলের জন্য এই ছবি প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা কমবেশি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস-সন্ত্রাসবাদ, হিংসার শিকার। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাসী, পি কেও শেষে নিমরাজি ঈশ্বরই মানুষ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু ঈশ্বর সম্বন্ধে পি কের কোন ধারণা নেই। এটা একদিক থেকে বেশ ঝুঁকিহীন। কারণ পরিচালককে বক্স অফিসের কথাও তো মাথায় রাখতে হবে। আবার একটা তাচ্ছিল্য ভাবও আছে এতে, কে ঈশ্বর। মানুষের আবেগ নিয়ে ওলটপালট করে সবচেয়ে ভাল ছবি তৈরি করা যায় কিন্তু ধর্মীয় কুসংস্কার এবং ধর্মগুরুদের ভাঁওতাবাজি নিয়ে ছবি করাটা বেশি জরুরী আজ এই সময়ে এই ভারতীয় উপমহাদেশের। চিত্রনাট্য, দৃশ্য নির্মাণ এবং অভিনয়-সেরা স্তরে পৌঁছলে দর্শক স্বেচ্ছায় সমস্ত রকমের অবিশ্বাস্য ব্যাপারকেও সাদরে গ্রহণ করে নেয়। অতএব, ছবির মূল চরিত্র পি আমির ) কে, বোঝার প্রয়োজন পড়েনি। সে নিজে বলছে বটে এ্যাস্ট্রোন-ঠিক কী বা কে (খান, কিন্তু ভিনগ্রহের বাসিন্দা হলেই বা ক্ষতি কী? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু! পি কে প্রমাণ করেছে উগ্রবাদী, অন্ধবিশ্বাসীদের কোন ধর্ম হয় না। পি কে স্পর্শের মাধ্যমে সকলের ভাষা বুঝতে চাইছে কিন্তু মানুষ তাকে তাড়া করছে, স্বাভাবিক অস্পৃশ্যতা তো এখনও কাটেনি সমাজ থেকে বিশেষ করে এই উপমহাদেশে জাতপাতের লড়াই দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে। হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে ‘সর্ব ধর্ম সম্ভব’ যার অর্থ সব ধর্মই সম বা সব ধর্মেরই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। কিন্তু যারা হিন্দুধর্মকে ভাঙ্গিয়ে ব্যবসা করতে চাইবে তারা এর অর্থটা নিজেদের মতো করে বলছেন- হিন্দুধর্ম বাদে বাকি সব ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করুন! তেমনি ইসলামে শান্তির কথা বলা থাকলেও ইসলামের ভেকধারী জেহাদের বার্তাই দেয়। সমাজ সংসারে নিত্যদিন এই ভ- তপস্বীদের ভ-ামি দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষও ক্লান্ত হয়ে এসবকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়, যেমন বারবার একই মিথ্যে বলতে বলতে সেটা সাময়িক সত্য করে দেয়া যায়। পি কে এইসব মুখোশধারীর কার্যকলাপ সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছে যে প্রশ্নগুলো আমাদের মনেও আসে যায় কিন্তু তা ছাই চাপা পড়েই থাকে। পি কে দেখিয়েছে ভারতীয় হিন্দু মেয়ের সঙ্গে পাকিস্তানী মুসলিম যুবকের প্রেম কিন্তু ইসলাম ফোবিয়া থেকে মেয়ের বাবা সেটা মেনে নিতে পারছেন না। বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তর ভারতে চলছে অর্থাৎ যে সব হিন্দু মেয়েরা মুসলিম ছেলে বি ‘লাভ জিহাদ’য়ে করবে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট এবং তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ধর্মীয় উগ্রবাদীদের তা-ব। বিজেপির ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবার, হিন্দুমহাসভা, বজরং দল দেশজুড়ে তাদের সমহিমায় আবার ফিরে এসেছে। এদের বক্তব্য হচ্ছে অন্য ধর্মের তুলনায় হিন্দু ধর্মকেই বেশি টার্গেট করা হয়েছে এই সিনেমায়, যেন অন্য ধর্মকে আঘাত করলে তারা মনে মনে একটু শান্তি পেত! ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ, এদেশে ধর্ম ব্যবসায়ীদের আঘাত করতে গেলে তো হিন্দু ধর্মকেই বাছতে হবে, যেমন পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এই ধরনের কোন চলচ্চিত্র হলে সেখানে ইসলামের নামে যারা ব্যবসা করছে তাদেরকেই একটু খোঁচা দেয়া যেত আবার অনুরূপে পশ্চিমে খ্রিস্ট ধর্মকে। অস্থির সময়ে আমরা চলছি, মূল্যবোধহীনতা গ্রাস করছে, মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, দুর্নীতি বাড়ছে সমাজে আর এই সবকিছুকে ঢেকে ফেলতে মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে ধর্মীয় চাদরে নিজেদের মুড়ে ফেলতে, পি কে শুধু একটু অবাক করা তার দৃষ্টি দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে যাতে আমরা নিজেদের চোখ দুটো পুরোপুরি মুড়ে না ফেলি ধর্মের চামড়ায়। নিজ নিজ ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা থেকেই এইসব যাবতীয় কুসংস্কার আর এই সব কুসংস্কারকে পুুঁজি করেই বিভিন্ন রকমের ম্যাজিক দেখিয়ে চলেছেন বিভিন্ন বাবা, স্বামী, মৌলবী, ফকির, পাদ্রীরা। পিকে রিলিজের প্রথম সপ্তাহেই ছিল বক্স অফিস তোলপাড়। তুমুল জনপ্রিয়তা। দশদিনেই আড়াইশ’ কোটি টাকার ব্যবসা। এখন সেটা ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে, যা বলিউডের সর্বকালীন রেকর্ড। অন্যদিকে, সঙ্ঘ পরিবারের একটি অংশ সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতার স্বঘোষিত ঠিকাদারÑ যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে চান ভারতীয়দের পছন্দ-অপছন্দ, পর্যবেক্ষণ থেকে পরিধান, পড়াশোনা থেকে খাদ্যাভাস-আমির খানের ‘পিকে’র বিরুদ্ধে তাঁরা আস্তিন গুটিয়ে ময়দানে। প্রতিবাদীদের বেশিরভাগই হিন্দু মহাসভার, যার প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার, যার বিশ্বস্ত সদস্য নাথুরাম গডসে, ১৯৪৮ সালে হত্যা করেছিলেন গান্ধীজীকে। সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়া ছবি। বোর্ডের চেয়ারপার্সন লীলা সামসন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ছবিটিকে সঠিকভাবেই ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তাই এর কোন অংশ আর বাদ দেয়া হবে না। তাছাড়া ব্যক্তির নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা বলে একটা জিনিস আছে। সুপ্রীমকোর্ট একাধিকবার বলেছে, ছবি দেখানোর সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। ‘পিকে’র নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলে, দেশের শীর্ষ আদালত তা খারিজ করে দিয়েছে। আবেদনকারীদের উদ্দেশে ডিভিশন বেঞ্চের প্রাজ্ঞ পরামর্শ, ‘ছবিটি না দেখলেই হলো’। কোন্্ ছবি ভাল, কোনটা মন্দ, সেটা ঠিক করবেন মানুষ। কোন ছবি দেখা যাবে, কোনটা দেখা যাবে না, তা বলে দেয়ার হিন্দু মহাসভা, বজরঙ দল কে? কোন ছবি কারও ভাল লাগতে পারে, আবার নাও লাগতে পারে। কারও ছবি না দেখার অধিকার যেমন আছে, তেমনি কাউকে দেখতে না দেয়ার অধিকারও কারও নেই। যে কোন শিল্পকর্মের নিজস্ব স্বাধীনতা থাকা জরুরী। গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক মানুষের, প্রত্যেক শিল্পীর মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। সংস্কৃতির ওপর, সৃষ্টিশীলতার ওপর, শিল্পীর গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর এই মৌলবাদী আক্রমণ আসলে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বহুত্ববাদের ওপর আক্রমণ। ধর্ম ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ে আঘাত আসতে পারে বলেই তারা পিকের বিরুদ্ধে হিংসাত্মকভাবে উন্মত্ত হয়ে ভাংচুর চালাচ্ছে দিল্লী-মুম্বাইয়ের সিনেমা হলে। আরএসএস চাইছে তাদের মতো একটা সংস্কৃতি তুলে ধরতে তারা ফিরে যেতে চাইছে বেদে, পুরানে যদিও তাদের মতো করা নিজস্ব সৃষ্ট ব্যাখ্যায়। তারা চায় না অন্য কোন যুক্তিবাদী সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠুক। কেউ শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ জানাতেই পারেন। কিন্তু যদি তাঁরা আইনকে তাঁদের হাতে তুলে নেন, বাকিদের নিরাপত্তা ও অধিকার বিপন্ন হয়, তবে তাঁদের গ্রেফতার করা উচিত। পি কে তার কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে উৎসাহ দিয়েছে প্রশ্ন করার এবং যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করার। যদিও ধর্ম ব্যবসায়ীরা প্রাণপণে মাঠে নেমেছেন সিনেমা নিষিদ্ধ করার জন্য, কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের চিন্তা ভাবনার স্বাধীনতাকে কি করে নিষিদ্ধ করবেন? সমাজ প্রশ্ন করবেই- আরও ভাল সমাজ গড়ার লক্ষ্যে। ইতিহাস সাক্ষী। লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক
×