ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুত বিপর্যয় এবং আমাদের করণীয়

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৩ জানুয়ারি ২০১৫

বিদ্যুত বিপর্যয় এবং আমাদের করণীয়

গত বছরের ১ নবেম্বর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিদ্যুত বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এদিন সকাল সাড়ে ১১টা থেকে রাত্র ১১টা পর্যন্ত সারাদেশ বিদ্যুতবিহীন থাকে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এই সময়ে এমনটি প্রত্যাশিত হতে পারে না। এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর সিডরের সময় সমগ্র দেশে বিদ্যুত বিপর্যয় ঘটেছিল। তবে সে সময় বিদ্যুত ব্যবস্থা পুনর্সচল করতে এবারের মতো এত সময় লাগেনি। বাংলাদেশের বিদ্যুত ব্যবস্থা একটি একক গ্রিড সিস্টেম। অর্থাৎ সমস্ত বিদ্যুতকেন্দ্র এবং ভোগকারী উপকেন্দ্রসমূহ একটি কমন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এই নেটওয়ার্কটি চতুষ্পদ প্রাণীর মেরুদণ্ডের মতো। মেরুদ- দুর্বল হলে প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি গ্রিড নেটওয়ার্ক দুর্বল হলে কোন দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থা অবিরাম, টেকসই ও নির্ভরশীল হতে পারে না। একক গ্রিড ব্যবস্থায় এনএলডিসি (National Load Despatch Center) বা সিএলডিসি (Central Load Despatch Center) এবং সিস্টেম প্রটেক্শন এ্যান্ড মিটারিং ইউনিট (System Protection and Metering Unit) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিভাগ। এখানে সবসময় দক্ষ এবং মেধাবী প্রকৌশলীদের পদায়ন করতে হয় এবং কর্মরতদের সর্বক্ষণ সিস্টেমের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হয়। এনএলডিসি লোড (Load) ব্যবস্থাপনায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। লোড ব্যবস্থাপনার সময়- মানুষ ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা বিধান, অবিরাম ও নির্ভরশীল সেবা এবং মিতব্যয়ী উৎপাদন- এই বিষয়গুলো অবশ্য বিবেচ্য। সিস্টেম প্রটেক্শন বিভাগ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে শুরু করে ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র পর্যন্ত, উপকেন্দ্রের অবস্থান, গুরুত্ব ও সিকোয়েন্স অনুসারে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা/রিলে সেটিং ঠিক করে দিবে। সিস্টেম প্রতিরক্ষায় তারাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিতরণ অথবা বিপণনকারী বা অন্য কোন সংস্থা বা বিভাগকে কোন অবস্থাতেই রিলে ব্যবস্থায় হাত দিতে দেয়া হয় না (বিশেষ করে ফ্রিকোয়েন্সি রিলেতে)। আমাদের দেশে ১.০০ মেগাওয়াট থেকে শুরু করে ৫, ১০, ২০... ১৫০ মেগাওয়াট এবং ২১০ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির জেনারেটর আছে। আবার ভারত থেকে বহরমপুর-ভেড়ামারা হয়ে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত একক সোর্সের মাধ্যমে আমাদের গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। অচিরেই ত্রিপুরা থেকে আগরতলা-কুমিল্লা (দক্ষিণ) হয়ে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানি শুরু হবে এবং সেটি পরবর্তীতে ৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হবে। আগামী ৩/৪ বছরে আরও কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুত আমদানি হবে। একটি ১৫০ মেগাওয়াট বা ২১০ মেগাওয়াটের মেশিন অথবা ৪৫০ মেগাওয়াটের আন্তঃসংযোগ (Back to back) যে কোন সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা সিস্টেমের থাকতে হবে। বিদ্যুত যেমন প্রয়োজনের বেশি উৎপাদন করে সঞ্চয় করে রাখা যায় না, তেমনি উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশিও ব্যবহার করা যায় না। অর্থাৎ বিদ্যুত ব্যবস্থাকে ওভার লোডেড ((Over Loaded) অথবা আন্ডার লোডেড (টহফবৎ খড়ধফবফ) কোনটাই করা যায় না। যে কোন বিদ্যুতকেন্দ্র, গ্রিড উপকেন্দ্র, এমনকি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের ফ্রিকোয়েন্সি মিটার দেখে সিস্টেম ওভার লোডেড কি আন্ডার লোডেড বলে দেয়া যায়। সিস্টেম ওভার লোডেড হলে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি কমে যায় এবং আন্ডার লোডেড হলে সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়। আমাদের দেশে বিদ্যুতের ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ৫০ সাইকেল। পৃথিবীব্যাপী ৫০ সাইকেল এবং ৬০ সাইকেল- দুই ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি প্রচলিত আছে। ফ্রিকোয়েন্সির গ্রহণযোগ্য রেগুলেশন কম/বেশি ২.৫০%, যেখানে ভোল্টেজ রেগুলেশন কম/বেশি ১০% পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এনএলডিসিতে কর্মরত প্রকৌশলীদের জন্য প্রতি মুহূর্তে ফ্রিকোয়েন্সি মিটার একটি অপরিহার্য উপাদান। এনএলডিসি নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মিমিক বোর্ড, টেবিল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ এমনকি দেয়াল পর্যন্ত সর্বত্র ফ্রিকোয়েন্সি মিটার থাকবে যেন সর্বক্ষণ একে মনিটরে রাখা যায়। ফ্রিকোয়েন্সি দেখে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ তথা প্রয়োজনে যে কোন লাইন বা উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার মতো ক্ষমতা (চড়বিৎ) এবং সক্ষমতা (ঈধঢ়ধনরষরঃু) এনএলডিসির থাকে। সকল বিদ্যুত কেন্দ্র এবং গ্রিড উপকেন্দ্রসমূহের সঙ্গে ত্বরিত (ছঁরপশ) যোগাযোগের জন্য পাওয়ার লাইন ক্যারিয়ারের মাধ্যমে এনএলডিসির একটি হট কানেকশন থাকে। বিদ্যুতকেন্দ্র এবং ভোগকারী উপকেন্দ্রসমূহ এনএলডিসির যে কোন কমান্ড মানতে সর্বদা বাধ্য। সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদ্যুত ব্যবস্থাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখার জন্য সকল বিদ্যুতকেন্দ্র, গ্রিড উপকেন্দ্রসমূহ এবং এনএলডিসিকে অবশ্যই একটি সংস্থার অধীনে একক নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়। আমাদের দেশে পিডিবি, আইপিপি, কিউআরপিপি, ইজিসিবি, এসআইপিপি, এনডব্লিউপিজিসিএল-এর ৯৩টি বিদ্যুতকেন্দ্রের ১০৯টি ইউনিট, প্রায় ১০০০০ কিমি. ট্রান্সমিশন লাইন, ১৬টি ২৩০/১৩২ কেভি এবং ১০৪টি ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্র, ৮২০০ কিমি. ৩৩ কেভি লাইন, ৬৫০টির বেশি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। বিদ্যুতকেন্দ্রসমূহের সম্মিলিত স্থাপিত ক্ষমতা ১০৭০০ মেগাওয়াট। এ যাবতকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন ৭২৮০ মেগাওয়াট। এই পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিপণনে ১০/১২টি সংস্থা জড়িত। ফলে সংস্থাসমূহের মধ্যে প্রায়ই সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। মাঝে মাঝে সমন্বয়ের অভাবে বড় ধরনের বিপর্যয়ও ঘটে। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪০.১০% আরইবি, ২৪.৬৪% পিডিবি, ১৮.৫৯% ডিপিডিসি, ১০.৫১% ডেসকো এবং ৬.১৭% ওজোপাডিকো ব্যবহার করে। লোডশেডিং বেশি হলে কখনও কখনও কিছু কিছু বিতরণকারী সংস্থা ও উপকেন্দ্রের এনএলডিসির নির্দেশ অমান্য করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। হঠাৎ ওভার লোডেড অথবা আন্ডার লোডেড হয়ে পড়লে সিস্টেমকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্ষা করার জন্য সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ৩৩ কেভি ফিডারে ফ্রিকোয়েন্সি রিলে লাগানো থাকে। এই রিলেসমূহের সেটিং, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম প্রটেক্শন এ্যান্ড মিটারিং বিভাগের হাতে থাকে। যে সকল ৩৩ কেভি ফিডারে ফ্রিকোয়েন্সি রিলে লাগানো থাকে সেগুলো ফ্রিকোয়েন্সির কারণে মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এতে গ্রাহক এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিরক্তিবোধ করে। গ্রাহকের বা পারিপার্শ্বিক নানা চাপের কারণে সংশ্লিষ্ট বিতরণকারী দফতর বা বিভাগ অনেক সময় কাউকে না জানিয়েই ফ্রিকোয়েন্সি রিলে খুলে রাখে। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড এখনও দেশের বিদ্যুত ব্যবস্থায় মাদার অর্গানাইজেশন (গড়ঃযবৎ ঙৎমধহরুধঃরড়হ)। সঞ্চালনকারী প্রতিষ্ঠান পিজিসিবি (এনএলডিসিসহ) বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে একটি কোম্পানি। তাই পিজিসিবি বা এনএলডিসি সিস্টেমের প্রয়োজনে বিউবো, ডিপিডিসি, ডেসকো বা অন্য সংস্থার ওপর সবখানে সমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ১ নবেম্বর বিদ্যুত বিপর্যয়ের সময় সারাদেশের অনেক উপকেন্দ্রে ফ্রিকোয়েন্সি রিলে সংযোগ ঠিক ছিল না (যদিও এখন আবার ঠিক করা হচ্ছে)। ঐ সময় সিস্টেমে ৪৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রবহমান ছিল, যার মধ্যে ৪৬০ মেগাওয়াট ভারত থেকে আসছিল। সকাল ১১.২৭ মিঃ-এ বাংলাদেশ প্রান্তে কারিগরি ত্রুটির কারণে ভারত থেকে আসা ৪৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত বন্ধ হয়ে গেলে ক্রমান্বয়ে সব বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হয়ে সারাদেশ বিদ্যুতবিহীন হয়ে পড়ে। যদি সে সময় ফ্রিকোয়েন্সি প্রটেক্শন পুরোপুরি সচল থাকত তবে এই অবস্থা হতো না। তাছাড়া ঐ সময় সংশ্লিষ্টরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারলে পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দেয়া যেত। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ঐ সময়ে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা শতভাগ মনোযোগী ছিলেন না। (বাকি অংশ আগামীকাল) লেখক : প্রকৌশলী
×