ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪

পাহাড়ে শান্তির সন্ধান

(প্রথম পর্ব) পাহাড়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুত উৎপাদনে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির অধিবাসী চাকমা, মারমা, ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষের ফসলি ভূমি-বসতভিটা কর্ণফুলী নদীর বাঁধের পানিতে বিসর্জন দিয়ে বিনিময়ে এই নিঃস্ব, রিক্ত এবং সংখ্যালঘু ‘ভয়েসহীনেরা’ যে কিছুই পায়নি তা বাঙালীর প্রবীণ-নবীন প্রজন্ম ভালভাবে উপলব্ধি করে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এখানে, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ির পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে জিন্দের বন্দীদের মতো চাকমা, মারমা ও অন্যদের গভীর দীর্ঘকালীন পুরাতন সব হারানোর ক্রন্দন শোনেন যাঁরাই এ অঞ্চলে পার্বত্য সৌন্দর্য দেখার জন্য আসেন। বাঁধের ফলে প্লাবিত শত শত একর জুমচাষের জমি, লাখ লাখ বাড়িঘর, দোকান, শাল, সেগুন নাম না জানা বৃক্ষ, পশুপাখি মানবসভ্যতার নির্মম উন্নয়নের এক দানব-সর্বগ্রাসী বাঁধ বিদ্যুত প্রকল্পের খাতিরে কোন প্রতিবাদ ছাড়া সে সময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্রের হুকুমে যেন মহামতি বুদ্ধের মতো সর্বস্ব ত্যাগ করেছিল, যে ত্যাগের অশ্রুজল যেন রাঙ্গামাটির চারদিকের বাঁধের জলের মধ্যে জমা হয়েছে! এমনটি পৃথিবীর কোন দেশে সংঘটিত হয়েছে কিনা আমার জানা নাই, যেখানে জলবিদ্যুতের বাঁধের জলের নিচে সেই আক্রান্ত গোষ্ঠীর রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত জলের নিচে ডুবে গেছে! এই ইতিহাস যখন সূচিত হয়েছিল মনে পড়ে না এখানে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থ রক্ষায় কোন রাজনৈতিক দল বা সুশীল সমাজের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী কোন দাবি, কোন প্রতিবাদ করেছিল! স্কুলে যখন আমরা শিক্ষিকাদের মুখে শুনতে পাই, কাপ্তাই জলবিদ্যুত উৎপাদন হলে দু’আনা, এমন কি দু’পয়সা হয়ে যাবে বিদ্যুতের মূল্য, পাহাড়ীরা সে বিদ্যুত পাবে বিনামূল্যে, তখন এ ধারণা করা অসম্ভব নয় যে সম্ভবত ষাটের দশকে জলবিদ্যুত উৎপাদনকে পাকিস্তানের চরম বৈষম্যপূর্ণ শাসননীতিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একটি ন্যায্য অধিকার পূরণ হিসেবে গণ্য করেছিল সে সময়ের বাঙালী নাগরিক ও রাজনৈতিক দলগুলো। উপরন্তু জলবিদ্যুতের বাঁধে আটকেপড়া বিপুল জলরাশি ও তার আগ্রাসনে লক্ষ পাহাড়ী মানুষের জীবন- জীবিকা, বসতি বিলুপ্ত হবে তা ছিল অচিন্তনীয় এবং তখনও অদৃষ্ট! তবু, যখন পাহাড়ের বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা ভাসিয়ে নিতে দেখল সমতলের চট্টগ্রাম ও পুরো প্রদেশের মানুষ, তখনও পাহাড়ীদের অধিকার সংরক্ষণের কোন দাবি-প্রতিবাদ দেখা যায়নি! এর একটি প্রধান কারণ ছিল সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানী শাসকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দমনপীড়নে নির্যাতিত বাঙালী সব সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ক্রমশ পূর্ব ভূখ-ের স্বায়ত্তশাসন, পরে স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি জানমাল নিবেদনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব প্রস্তুতিমূলক নানা কার্যক্রমের আড়ালে চলে গিয়েছিল পাহাড়ের বঞ্চনার ক্রন্দন। আশা করা হয়েছিল, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর, স্বাধীন বাংলাদেশে বঞ্চিত, শোষিত বৈষম্যের শিকার সব দল, গোষ্ঠী, শ্রেণীপেশার মানুষ তাদের স্ব-স্ব বঞ্চনার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ লাভ করবে। এ আশায় বাঙালী নারী-পুরুষ, কিশোরের পাশাপাশি পাহাড়, সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর (যদিও আমার মনে হয় ‘আদিবাসী’ বলা হলে কারো কোন ক্ষতি হবে না) সবাই, ক্ষুদ্র একটি অংশ বাদে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় তরুণ প্রজন্মকে, একইসঙ্গে প্রবীণ প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান পরিচালক দলে আওয়ামী লীগের শাসনকাল ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি (যদিও ১৬ ডিসেম্বর থেকে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু“হয়েছিল) থেকে শুরু“হয়ে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় শেষ হয়ে যায়! বঙ্গবন্ধু যখন চাকমা, মারমা, প্রমুখ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের উদ্দেশে সংসদে সদ্য স্বাধীন দেশের সব দল, শ্রেণী, গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে আহ্বান জানান- ‘সবাই বাঙালী হয়ে যাও’ সেটি যে তিনি নাগরিকত্বকে ‘বাঙালী’ নামে অভিহিত করেছিলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি একজন চাকমা, মারমা নৃতাত্ত্বিকভাবে যে বাঙালী হতে পারে না, সে বিষয়ে অজ্ঞ ছিলেন না! আজ রাষ্ট্রের নামে নাগরিকত্বের নাম ‘বাংলাদেশী’ হয়েছে, অনেক রকম বিতর্কের পর, ‘৭২, ৭৩, ৭৪-এ বাঙালীর পেছনে ছিল বাঙালী হবার সুদীর্ঘ’ বাধাবিঘœ অতিক্রম করার পথ পরিক্রমা! উল্লেখ্য, এতে প্রধান বাধা এসেছিল বাংলা ভাষা ও বাঙালীর সাহিত্য, সংস্কৃতির ওপর। পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে একমাত্র ভাষা উর্দু করার বিপরীতে বাঙালী বাংলা ভাষা, মায়ের মুখের ভাষার অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ‘৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙলাকে প্রতিষ্ঠিত করে’। এ সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু, ভারতীয় কবি হিসেবে নিষিদ্ধ করা, মুসলমান কবিÑসাহিত্যিককে রবীন্দ্রসঙ্গীত লিখতে বলা, বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা, আরবী অক্ষরে বাংলা লেখা, রোমান হরফে বাংলা লেখাÑ ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাঙালীর বাঙালীত্বর মূলোৎপাটনের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল! ছিল বাঙালীর অসাধারণ সমৃদ্ধ লোককাব্য-সাহিত্য-সঙ্গীতের চর্চা, প্রচার ও প্রসারে বাধাবিঘœ সৃষ্টি করা। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ থেকে কবি আবদুল হাকিম, রমেশ শীল, লালন সাঁই থেকে শাহ্ আবদুল করিম প্রমুখ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়! এই ধূসর প্রাণহীন সময়ের বাধাকে অতিক্রম করতে অন্যদিকে গড়ে ওঠে রবীন্দ্রচর্চার প্রধান কেন্দ্র- বিদগ্ধ জ্ঞানী সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, সান্্জিদা খাতুনসহ একদল প্রগতিশীল ব্যক্তির উদ্যোগে। এছাড়াও ষাটের দশকে বাঙালী তার ভাষা, রবীন্দ্র, নজরুল, লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীত চর্চা, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত রাজনীতির চর্চা বিপুলবেগে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ দ্রুত প্রবীণ-নবীন প্রজন্মের মধ্যে এমন প্রস্তুতি গড়ে উঠল। ’৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নিরেপেক্ষ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফার দাবির পক্ষে দ্রুত বাঙালীর জনমত গড়ে উঠল। ’৭১-এর শুরু“ থেকে এ দাবি একদফাÑ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হলো! ’২৫ মার্চের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু“হলে বঙ্গবন্ধুর আগে ধারণ করা স্বাধীনতার ঘোষণা জেলায় জেলায় প্রচার শুরু হলো। বাঙালী পুলিশ, সেনা, ইপিআর, সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ সব পেশার জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল! ১৬ ডিসেম্বর বিজয় এনে ঘরে ফিরল তাঁরা ৩০ লাখ শহীদকে এবং প্রায় ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমকে স্বাধীনতার বেদি মূলে উৎসর্গ করে! আগেই বলেছি, ’৭৫-এর আগস্টে মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক প্রধান দলের সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, ক্ষমতা দখল করে হত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী-মিত্র গং, খন্দকার মোশতাক-জিয়াউর রহমান। এরই দু’ মাস পর ৩ নবেম্বর ঢাকা জেলে অন্তরীণ, মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালক তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে জেলে ওই একই খুনীদল হত্যা করে! সুতরাং, যখন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার দেশ গড়ার বিপুল পুনর্বাসন, পুনর্গঠন, ফসল উৎপাদন, বিদেশের স্বীকৃতি ও ঋণ সহায়তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক, শিল্প, টিসিবি, কসকর ইত্যাদি চালু করে সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন করা শুরু“করেছিল, তখনই এ সরকার ক্ষমতাচ্যুত ও প্রধান রাজনৈতিক নেতা নিহত হলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধীদের হতে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক সত্য আর কিছু নেই! কেন? কারণ প্রথমত, জিয়াউর রহমান ’৭৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে দৃশ্যপটে আসেন এবং এসেই প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন পাকিস্তানপন্থী রাজাকার শাহ্ আজিজকে! দ্বীতিয়ত, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকারী ফারুক-রশীদ, গ্রেফতার, বিচার দূরে থাক, তাদের বিচার করা যাবে নাÑ এমন একটি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন এবং তাদের প্রভূতভাবে পুরস্কৃত করে স্বাধীন বাংলাদেশের নানা বিদেশী দূতাবাসে নিয়োগ দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিলাস-বৈভবে থাকার ব্যবস্থা করেছেন! তৃতীয়ত, ক্ষমতা নিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক শুরু“হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তৈরি প্রায় ৭৬টি ট্রাইব্যুনাল বাতিল করেন, যে আইনে বিচার হচ্ছিল সেই ‘দালাল আইন’ বাতিল করেন এবং আটক ও দ-িত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেন, নাগরিকত্ব ফেরত দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতি করার সুযোগ দেন! চতুর্থত, তাদের অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের নামে খুন, গণহত্যার রাজনীতি করা বন্ধ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক প্রণীত সংবিধানের বিধি- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের বিধানটি বাতিল করেন! পঞ্চমত, তিনি সুস্পষ্টভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের মূলভিত্তি- সংবিধানের ৪টি মৌল প্রত্যয়- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালী জাতিয়তাবাদ, ও সমাজতন্ত্র থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করে দিয়ে একদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং সংবিধানের ‘আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস’ নামের একধারা সংযোজন করেন! অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ বঙ্গবন্ধুর এসব ধর্মের সমতার নীতির ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করেন জিয়াউর রহমান! এই সবধর্মের সমানাধিকারের অসাম্প্রদায়িক দেশকে ‘ইসলামিক’ অথবা ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে রূপান্তর করা ছিল মূল উদ্দেশ্য! ষষ্ঠত, জিয়াউর রহমান ‘কু’র নামে সেনানিবাসে প্রায় চার হাজার সেনা মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর করে সেনাদের মধ্যে পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি এবং সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের সংখ্যা হ্রাসের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন! এমনকি, তিনি আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছেন যিনি ভুল বুঝে মুক্তিযোদ্ধা গণ্য করে সৈনিকদের হাত থেকে তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন! জিয়াউর রহমান প্রথম জীবনে পাকিস্তানের আইএসআইতে কর্মরত ছিলেন এবং কেউ একবার গোয়েন্দা বাহিনীতে কর্মরত থাকলে সে চিরকাল ওই বাহিনীর অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দী থাকে- এটি দুনিয়াজুড়ে গোয়েন্দা বাহিনীর নীতি। যে বের হয়েছে, সে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে! এখন পরিষ্কার নয়কি যে, ’৭৫-এ যারা বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৪ জাতীয় নেতা হত্যার মাধ্যমে স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার উৎখাত করেছিল, সেই, মোশতাক, জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট ও মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর হয়ে উপরে বর্ণিত যা যা পদক্ষেপ, কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন সে সবই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে! তাহলে, এই ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করে পুনর্বাসন করে, তাদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি রক্ষা করতেই কি সচেষ্ট ছিল না? জিয়াউর রহমানের স্বাধীন রাষ্ট্রের অশান্তির বীজ রোপণ : পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী বসতি স্থাপন : এবার আশা যাক, পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই জলবিদ্যুত দ্বারা গৃহচ্যুত পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠী, বিশেষত চাকমা জাতির ওপর প্রথম আঘাতকারী পাকিস্তানী শাসকদের পর সম্ভবত ’৭৮ সাল থেকে জিয়াউর রহমান দ্বিতীয়বারের মতো তাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানে! এ আঘাতের মাধ্যমে সুকৌশলে জিয়াউর রহমান নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মধ্যে চিরঅশান্তির একটি বীজ রোপণ করেন, যেটি রাষ্ট্রটির উন্নয়নের গতি রোধ করবে এবং পার্বত্য অঞ্চলে সব সময় যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির জন্য ছাই চাপা আগুন হিসেবে সক্রিয় থাকবে! জিয়াউর রহমান একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন প্রথমত তিনি নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সাতকানিয়াসহ কিছু এলাকার চরের মানুষ, নদীভাঙ্গা মানুষ- নারী, পুরুষ, শিশুদের পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দরবান, এলাকায় পরিকল্পিতভাবে বিনামূল্যে খাসজমির কাগজ দিয়ে লোভ দেখিয়ে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়! এই অদৃষ্টপূর্ব এবং অস্বাভাবিক, অভূতপূর্ব ঘটনার পরিকল্পক যে গভীর একটি দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের বীজ বপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটি পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ীদের প্রথম বঞ্চনার উপর দ্বিতীয়বার চরম বিশ্বাস ঘাতকতার প্রমাণ দেয়! স্মর্তব্য, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিছুসংখ্যক সম্ভবত ৫০-৬০টি কৃষক পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদী অববাহিকায় খাসজমি দিয়ে বসতি স্থাপন করার লোভ দেখিয়ে পাঠিয়েছিলেন! পরে তাদের সিন্ধু অথবা পাঞ্জাবের মরু প্রায় অঞ্চলে চরম দুর্দশায় দিন কাটানোর সংবাদ সে সময় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল! পরে অবশ্য তাদের অবস্থা সম্পর্কে কোন কিছু জানা যায়নি! যাই হোক, পরের পর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা শত বছর ধরে একটি স্বতন্ত্র জাতিত্ব নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে বসবাস করে আসছে, যারা পাকিস্তানযুগে কাপ্তাই জলবিদ্যুতের বাঁধের জলে একবার সর্বস্বহারা হয়েছিল, তারা দ্বিতীয়বার জিয়াউর রহমানের একচক্ষুর রাজনীতির- বাঙালীদের পাহাড়ে সরকারী উদ্যোগে বসতি স্থাপন দ্বারা দ্বিতীয়বার অস্তিত্বহীনতার শঙ্কায় পড়েছে। অপরদিকে বাঙালী বসতি স্থাপনকারীরাও জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রের শান্তি বিনষ্ট করার কূটকৌশলে পা দিয়ে কলুষিত এক রাজনীতির বলি হয়েছে। তাদের দু’পক্ষের বর্তমান অবস্থা, ভাবনা- চিন্তা, পাহাড়ে নিরাপত্তাবাহিনী ও প্রশাসনের বর্তমান অবস্থান সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও সুপারিশ এ রচনায় স্থান পাবে। (দ্বিতীয় পর্ব আগামী সোমবার) লেখক : শিক্ষাবিদ
×