স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ ‘চটপটি’ আর ‘চাপিলা’ নামে পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায় চলছে ইলিশের বাচ্চা নিধনের মহোৎসব। গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলাতেই প্রতিদিন অন্তত শতাধিক মণ বাচ্চা নিধন হচ্ছে। একশ্রেণীর জেলে খুঁটা আর বিন্তিজাল দিয়ে গত প্রায় দু’মাস ধরে এ নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মৎস্য বিভাগ মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু বিন্তিজাল আটক করলেও তাতে কমছে না নিধন কর্মকা-। অবাধে ইলিশের বাচ্চা নিধনে শুধু সাধারণ মানুষই নন, প্রকৃত জেলেরাও উদ্বিগ্ন। যে হারে বাচ্চা নিধন হচ্ছে, তাতে আগামীতে নদী-সাগর পুরোপুরি ইলিশশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
গত কয়েকদিন ধরে সাগর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে ইলিশের বাচ্চা নিধনের ভয়াবহ চিত্র। রাঙ্গাবালী উপজেলার সোনারচরের দক্ষিণে কয়েকটি ডুবোচরে তিন-চার হাজার জেলে খুঁটাজাল আর বিন্তিজাল দিয়ে প্রতিদিন ৫০ মণেরও বেশি ইলিশের বাচ্চা নিধন করছে। ইলিশের এসব বাচ্চা এক-দেড় ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। প্রকৃত জেলেরা জানিয়েছেন, গত অক্টোবরে মা ইলিশ উপকূলের মিঠা পানিতে ডিম ছেড়েছে। সেই ডিমের রেণু প্রকৃতির নিয়মেই এখন বাচ্চা ইলিশে রূপ নিয়ে সাগরের গভীরে ঝাঁকে ঝাঁকে রওনা দিয়েছে। কিন্তু অসৎ জেলেরা মাঝপথে খুঁটাজাল আর বিন্তিজাল দিয়ে ইলিশের বংশ উজাড়ে মাঠে নেমেছে। সোনারচর ছাড়াও ইলিশের বাচ্চা নিধনের মহোৎসব দেখা গেছে রাঙ্গাবালীর চরআন্ডা, মৌডুবী, কোড়ালিয়া, বাহেরচর, চরকলাগাছিয়া, চরতুফানিয়া ও গলাচিপার চরবিশ্বাস, চরবাংলা, চরনজির, বদনাতলীসহ কয়েকটি এলাকায়। স্থানীয় জেলেদের ধারণা, কেবল এসব পয়েন্টেই প্রতিদিন শতাধিক মণ ইলিশের বাচ্চা ধরা হচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন এলাকায় বাচ্চা নিধন পর্ব চলছে। আহৃত ইলিশের বাচ্চার বেশিরভাগই গ্রামের হাটবাজারে প্রকাশ্যে ভাগ দিয়ে বেচাকেনা হচ্ছে। কিছু শুঁটকিও করা হচ্ছে। বাচ্চা শিকারী জেলেরা অবশ্য এগুলোকে কিছুতেই ইলিশ বলে স্বীকার করছেন না। তারা একে ‘চটপটি’ ‘চাপিলা’সহ বিভিন্ন আজব নামে চিহ্নিত করছেন। সোনারচরের জেলে আবু জাফর আকন জানান, এগুলো দেখতে ইলিশের মতো হলেও আসলে তা চাপিলা। একইভাবে সাফাই গেয়ে একই চরের আবদুল মন্নান জানান, স্বাদ ইলিশের মতো হলেও এটি আসলে চটপটি। জেলেরা সবাই এভাবেই বাচ্চা নিধনের পক্ষে সাফাই গায়। তবে প্রকৃত ইলিশ শিকারী জেলেরা এর বিপক্ষে। তাদের ধারণা, যেভাবে চাপিলা কিংবা চটপটি নামে একশ্রেণীর জেলে বাচ্চা নিধনের মহোৎসবে মেতেছে তাতে আগামীতে সাগর-নদী ইলিশশূন্য পড়লে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। তাদের মতে, অবিলম্বে বাচ্চা নিধন বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। চরমোন্তাজের ইলিশ শিকারী জেলে আল আমিন ভূইয়া জানান, জাটকা নিধনে সরকার যেভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, একইভাবে বিন্তিজাল ও খুঁটাজাল বন্ধ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আগামী মৌসুমে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক জেলে বেকারে পরিণত হবে। সাগর-নদী কোথাও মিলবে না ইলিশ। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও জেলে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলেরা ডুবোচরে মাইলের পর মাইলজুড়ে খুঁটি গেড়ে এক ধরনের সূক্ষ্ম ফাঁসজাল ব্যবহার করছে। এগুলোর বহর ৮ থেকে ১২ হাত পর্যন্ত। ভরা জোয়ারের সময় এগুলো ডুবোচরে পাতা হয়। ভাটায় টেনে তোলা হয়। এ সময় অন্যান্য মাছের সঙ্গে অসংখ্য ইলিশের বাচ্চা ধরা পড়ে। বিন্তিজাল আরও ভয়াবহ। এর একদিকের মুখ বিশাল খোলা। আরেকদিকে সরু। ফলে এর সূক্ষ্ম ফাঁস দিয়ে এক ইঞ্চি সাইজের মাছও বেরিয়ে আসতে পারে না। জেলেরা একে ‘রাক্ষসি’ জাল নাম দিয়েছে। বিন্তি এবং খুঁটাজাল রাতের আঁধারেই বেশি ব্যবহৃত হয়।