ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লাশ দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজার হাজার মানুষ;###;ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা পরিত্যক্ত ঘোষণার আধা ঘণ্টা পর উদ্ধার হলো জিহাদ

অবশেষে উদ্ধার হলো স্বেচ্ছাসেবী ও জনগণের সহযোগিতায় ॥ এলো জিহাদের নিথর দেহ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪

অবশেষে উদ্ধার হলো স্বেচ্ছাসেবী ও জনগণের সহযোগিতায় ॥ এলো জিহাদের নিথর দেহ

গাফফার খান চৌধুরী/নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ অবশেষে উদ্ধার হলো জিহাদ। তবে জীবিত নয়, মৃত। আর এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটল শ্বাসরুদ্ধকর সাড়ে ২৩ ঘণ্টার টানা উদ্ধার অভিযান আর টান টান উত্তেজনার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সবাই। অবসান ঘটে উৎকণ্ঠা আর নানা ধরনের গুজবের। শনিবার বেলা তিনটার দিকে আইকন নামের একটি পাইলিং কোম্পানির সহায়তায় যুবক বয়সী এক ব্যবসায়ীর প্রযুক্তিতে লোহার রড দিয়ে তৈরি ক্যাচার বক্সের মাধ্যমে উদ্ধার হয় জিহাদ। ফায়ার সার্ভিস জিহাদ উদ্ধার তৎপরতা স্থগিত ঘোষণার আধঘণ্টা পরই উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। লাশ উদ্ধারের পর হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ভুল তথ্য দেয়ার অভিযোগে এবং ব্যর্থতার অভিযোগে ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিতে পুরো এলাকায় বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। জন্ম হয় নানা সমালোচনার। যেভাবে পড়ে যায় জিহাদ ॥ শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে জিহাদ সমবয়সী দুই বন্ধুর সঙ্গে শাহজাহানপুর বালুর মাঠের পূর্ব দিকে চারতলা রেলওয়ে কলোনির একটি ভবন ও রেলওয়ে কলোনি সুপার মার্কেট সমিতির সামনের ছোট্ট মাঠে খেলা করছিল। খেলার এক পর্যায়ে জিহাদ রেলওয়ে কলোনির জন্য তৈরিকৃত ঢাকা ওয়াসার একটি পানির পাম্পের পরিত্যক্ত স্টিলের পাইপের ভেতরে পড়ে যায়। জিহাদের দুই খেলার সাথী খবরটি স্থানীয়দের দেয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস সেখানে ৫টি ইউনিট উদ্ধারে নামে। পরিত্যক্ত পাইপটির ব্যাস ১৮ ইঞ্চি। সেটি প্রায় ৮ বছরের পুরনো। এক বছর আগে পাইপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই পরিত্যক্ত পাম্পটির প্রায় দেড় শ’ গজ সামনে রাস্তার পাশে নতুন পাইপ বসানোর কাজ চলছে। উদ্ধার তৎপরতা ॥ খবর পেয়ে বিকেল ৪টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সেখানে হাজির হয়। তাদের সহযোগিতা করতে এগিয়ে যায় ঢাকা ওয়াসা, রেলওয়ে, র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। বিকেল চারটা থেকেই উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী ও ঢাকা ওয়াসার দাবি, পরিত্যক্ত পাইপটি অন্তত ৫শ’ থেকে ৬শ’ ফুট গভীর। পাইপের উপরের ৩শ’ ফুট পাইপের ব্যাস ১৮ ইঞ্চি। এরপর আস্তে আস্তে আরও কম ব্যাসের পাইপ তার সঙ্গে লাগানো ছিল। পরের ধাপে প্রায় ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ ছিল। এভাবে ধাপে ধাপে পাইপটি চিকন হতে হতে ২ ইঞ্চি ব্যাসে গিয়ে ঠেকে। ৩শ’ ফুট পাইপের নিচে একটি বিশেষ স্টেইনলেস স্টিলের সাব পাম্প বসানো ছিল। পাম্প থেকে প্রায় ৫০ ফুট উপরে একটি লোহার জাল ছিল। সেই জালেই আটকা পড়েছিল জিহাদ। প্রথমেই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা ক্যামেরা পাঠিয়ে জিহাদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে। ক্যামেরায় পাওয়া তথ্য মোতাবেক রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত জিহাদ জীবিত ছিল বলে ফায়ার সার্ভিস তাদের ধারণার কথা জানায়। এরপর ভেতরে পানি, জুস ও অক্সিজেন দেয়া হয়। পানি ও জুস খাওয়ার কোন লক্ষণ পাওয়া যায় না। এরপরই অস্থির হয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা। এরপর পাইপের ভেতরে ওয়াসার শক্তিশালী ক্যামেরা পাঠানো হয়। তাদের জিহাদের বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। রাত এগারোটার দিকে সেখানে হাজির হন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ ও বুয়েটের ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল। বিশেষজ্ঞ দলটি ক্যাচার পদ্ধতিতে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে। স্টিলের তৈরি বিশেষ খাঁচা তৈরি করে কয়েক দফায় উদ্ধার অভিযান চালানো হয়। কিন্তু উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। ভোর চারটার দিকে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য উদ্ধারকারী দল একপ্রকার হাল ছেড়ে দেন। তারপরও শিশু জিহাদের অবস্থান জানার চেষ্টা চলে। কিন্তু কোন হদিস নেই। সকাল ১০টা পর্যন্ত এভাবেই উদ্ধারের চেষ্টা চলতে থাকে। তারপরও হদিস না মেলায় ফায়ার সার্র্ভিসের তরফ থেকে এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভেতরে কোন লাশ বা মানুষের অস্তিত্ব নেই বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতা পরিত্যক্ত ঘোষণা ॥ শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান শাহজাহানপুর বালু মাঠে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে উদ্ধার তৎপরতা সমাপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে উদ্ধার কাজ সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে উদ্ধার তৎপরতা চলবে। উদ্ধার কাজ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, স্থানীয়দের ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনকে উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিস সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, পাইপটির গভীরতা অন্তত ৫শ’ ফুট। আর পাইপটির ব্যাস ছিল ১৮ ইঞ্চি। মাঝামাঝি জায়গায় একটি সাবমারশিবল পাম্প ছিল। সেই পাইপের উপরে শিশুটি আটকে থাকতে পারে। ক্রেনের সাহায্যে সাবমারশিবল পাম্পসহ প্রায় ৩শ’ ফুট পাইপ এসিটিলিন গ্যাসের মাধ্যমে কেটে বের করা হয়। কিন্তু তাতেও হদিস মেলে না জিহাদের। তবে তিন শ’ ফুট গভীরে শক্ত কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকার তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু কোন লাশের অস্তিত্ব মেলে না। তাকে জীবিত উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করে ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট। পাইপটির ব্যাস কম থাকায় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে কাউকে পাইপের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ভোর ৪টার দিকে ৩০ কেজি ওজনের ক্যাচার ক্রেনের সাহায্যে ভেতরে পাঠানো হয়। তাতেও কোন মানবদেহের হদিস মেলে না বা কোন জিনিস সেই ক্যাচারে আসে না। তাতে ধারণা করা হয় ভেতরে কোন লাশের অস্তিত্ব নেই। এছাড়া এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকার কারণে উদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে রেলওয়ে বিভাগ, স্থানীয় উদ্ধারকারী ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারী দলকে সহায়তা করতে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে থাকবে। তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুপুর তিনটায় সংবাদ সম্মেলনে জিহাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানান তিনি। সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মেজর শাকিল নেওয়াজসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পানি ও জুস খাওয়া এবং জিহাদের জীবিত থাকার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক বলেন, ক্যামেরায় প্রাপ্ত ছবি ও ফুটেজ দেখে ধারণা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এমন তথ্য দিতে পারেন। হয়ত ক্যামেরা বা অক্সিজেন দেয়ার শব্দকেই জিহাদের শব্দ বলে ধারণা করেও উদ্ধারকারী ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা এমন কথা বলতে পারেন। এ ধরনের দুর্ঘটনা ফায়ার সার্ভিস ইতোপূর্বে মোকাবেলা করেনি। তাই হয়ত খানিকটা ত্রুটি হয়েছে। ত্রুটির জন্য তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে ফায়ার সার্ভিস অবশ্যই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। এমনকি দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তথ্য দিবে। স্বেচ্ছাসেবীরা যেভাবে উদ্ধার করে জিহাদকে ॥ জিহাদকে উদ্ধার করতে সাভারের রানা প্লাজার উদ্ধারকারী বশির আহমেদ, বেসরকারী পাইলিং কোম্পানি আইকনের প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত আলমগীর হোসেন ও কোম্পানিটির ওয়েল্ডিং বিভাগে কর্মরত মিন্টু, মিরপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিক বাবুলসহ (৩৫) অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রাতেই ঘটনাস্থলে হাজির হন। রাত থেকেই বশির উদ্দিন পাইপের ভেতরে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির আশঙ্কায় তাকে অনুমতি দেয়নি। শেষ পর্যন্ত আইকন পাইলিং কোম্পানির সহযোগিতায় তৈরি বিশেষ ক্যাচার বক্সের মাধ্যমে উদ্ধার হয় জিহাদ। ক্যাচার বক্সটির নকশা তৈরি করেন মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিক বাবলু (৩৫)। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, টেলিভিশনে ঘটনার দেখার পর থেকেই আমার মাথায় জিহাদকে উদ্ধার করার প্রবল ইচ্ছা জাগে। ঘটনার পর থেকেই কিভাবে শিশুটিকে উদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে থাকি। চিন্তার এক পর্যায়ে আমার মাথায় ক্যাচার বক্স তৈরির ধারণা আসে। ক্যাচার বক্সটি লোহার রড দিয়ে তৈরির পরিকল্পনা করি। পাইপটির ব্যাস যেহেতু ১৮ ইঞ্চি, এজন্য সাড়ে ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের ক্যাচার বক্স তৈরির সিদ্ধান্ত নেই। রাতেই আমি ক্যাচার বক্সের নকশা করি। নকশা নিয়ে আমি রাত ১২টার দিকে সোজা ঘটনাস্থলে হাজির হই। কিন্তু আমি কোনক্রমেই কাউকে বুঝাতে সক্ষম হয়নি। ইতোমধ্যেই সেখানে কথা হয় আইকন পাইলিং কোম্পানির প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত আলমগীর এবং কোম্পানিটির ওয়েল্ডিং বিভাগে কর্মরত মিন্টুর সঙ্গে। আমি তাদের সহযোগিতায় আইকন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ক্যাচার বক্সটি বিশেষ কোন জটিল নয়। গ্রামেগঞ্জে মাছ ধরার পলোর মতো। ৫ ফুট উঁচু গোল করে লোহার শক্ত রড দিয়ে প্রথমে একটি গোল খাঁচার মতো বানানো হয়। বক্সটির মাঝে লোহার গোল রিং বসানো হয়। সবার নিচে থাকা গোল রিংয়ের সঙ্গে লাগানো অনেকটা বেয়ারিংয়ের মতো করে বড় বল্টুর সঙ্গে যুক্ত করা হয় রড। ৩টি গোল বল্টুর সঙ্গে ৬ থেকে ৭ ইঞ্চি শক্ত লোহার রড বসানো হয়। বল্টুগুলো ক্যাচার বক্সের নিচের দিকে থাকা রডের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে ওয়েল্ডিং করে আটকিয়ে দেয়া হয়। বল্টুর ভেতরে যেহেতু ফাঁকা এজন্য রডগুলো অনায়াসে ঘুরতে পারে। বল্টুগুলো নিচে সামান্য বাড়তি রড লাগিয়ে দেয়া হয়। যাতে রডগুলো উপরের দিকে উঠতে পারলেও যাতে নিচের দিকে নামতে না পারে। ক্যাচার বক্স নামানোর আগে ওয়াসার ক্যামেরায় শক্ত কোন কিছুর আলামতের আন্দাজ করা যায়। এরপর ক্যাচার বক্সটি ফায়ার সার্ভিসের ক্রেনের সাহায্যে আস্তে আস্তে নিচে পাঠানো হয়। ভোর ৫টার দিকে প্রথম দফায় পাঠানো হয় ক্যাচার বক্স। কিন্তু অভিযান ব্যর্থ হয়। ক্যাচার বক্সের রড একটি আরেকটির উপর পড়ে আটকে যায়। এরপর আবার ক্যাচার বক্সের রডগুলো আরেকটু ছোট করা হয়। এরপর মাটির উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। দেখা যায় ক্যাচার বক্সটি কোন জিনিসের উপর ছাড়ামাত্র বক্সটির রডগুলো উপরের দিকে উঠে যায়। আর ক্যাচার বক্স ধরে টান দিলেই সেই জিনিস ক্যাচার বক্সে থাকা লোহার রডে শক্ত করে আটকে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা অব্যাহত রাখি। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার অভিযান স্থগিত করলে স্বাভাবিক কারণেই মানুষের ভিড় কমে যায়। এরপর সেখানে থাকা ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন দিয়ে ক্যাচার বক্সটি নিচে নামানো হয়। ক্যাচার বস্কটি অনেকদূর গিয়ে ঠেকে যায়। আর যায় না। এরপর সবাই মিলে ক্রেনের রশি টানতে থাকি। টান দিতেই বুঝা যায় ক্যাচার বক্সে ভারি কিছু আটকে গেছে। এরপর খুব সতর্কতার সঙ্গে রশি টেনে ক্যাচার বক্স তোলা হয়। আর সেই ক্যাচার বক্সে উঠে ছোট্ট শিশু জিহাদের নিথর দেহ। একদিকে আনন্দ আরেক দিকে কান্না। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাজার হাজার মানুষ জিহাদ উদ্ধারের আনন্দে আর বিষাদে চিৎকার করতে থাকে। মুহূর্তেই সেখানে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। দ্রুত ক্যাচার থেকে জিহাদকে ছাড়িয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কাছে হস্তান্তর করি। জিহাদকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে নিয়ে যান তারা। বাবুল বলেন, ৬শ’ ফুট গভীর পাইপটির ৩শ’ ফুট পাইপের ব্যাস ১৮ ইঞ্চি। আর ক্যামেরা এবং ভেতরে ছেড়ে দেয়া রশির হিসাব মতে জিহাদ অন্তত আড়াই শ’ ফুট গভীরে ছিল। তার দেহটি অন্তত আড়াই শ’ ফুট গভীরে থাকা একটি লোহার জালে আটকে ছিল। জালের কিছু অংশ ক্যাচার বক্সের সঙ্গে উঠে আসায় বিষয়টি নিশ্চিত হই। পুরো ক্যাচার বক্স তৈরির পরিকল্পনাটি তার। কিন্তু ক্যাচার বক্স তৈরি করতে আইকন পাইলিং কোম্পানি সার্বিক সহায়তা করেছেন। ওয়েল্ডিং মেশিনটিও ওই কোম্পানি সরবরাহ করে। আর কোম্পানির দুইজন আলমগীর ও মিন্টু, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় উদ্ধারকারীদের সহায়তায় অবশেষে উদ্ধার করা সম্ভব হয় জিহাদকে। তবে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ লাগত। কিন্তু সে ভাগ্য হলো না। বাবলু জনকণ্ঠকে আরও বলেন, আমার বাড়ি সোনাখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানাধীন জয়েকবাজার গ্রামে। দুই ভাই তিন বোন। আমি দ্বিতীয়। জয়েকনগর কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছি। অভাব অনটনসহ নানা কারণে আর পড়াশুনা হয়নি। বর্তমানে আগোরা চেইনশপে মালামাল সরবরাহের কাজ করছি। ঢাকার মিরপুরের ১১ নম্বরের ৩ নম্বর সড়কের এ ব্লকের ১৩ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী আর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভাড়ায় বাস করছি। মেয়েটি ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। ছেলেটি ছোট। আইকন পাইলিং কোম্পানির প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত আলমগীর জানান, কোম্পানিটি মূলত পাইলিংয়ের কাজ করে থাকে। ঘটনা জানার পর কোম্পানি স্বেচ্ছায় তাদের সেখানে পাঠায়। সঙ্গে একটি ওয়েল্ডিং মেশিন পাঠিয়ে দেয়। কোম্পানির তরফ থেকেও একটি ক্যাচার বক্স তৈরি করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি সুচারুভাবে কাজ করছিল না। সেখানে যাওয়ার পর বিশেষ ক্যাচার বক্স তৈরির পরিকল্পনাকারী বাবলুর সঙ্গে কথা হয়। যদিও কোম্পানির তরফ থেকে আগে একটি ক্যাচার বক্স বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেটি দিয়ে কার্যকর উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। তাই তরুণ ব্যবসায়ী বাবলুর পরিকল্পনা মোতাবেক ক্যাচার বক্স তৈরি করে সফলতা আসে। কোম্পানিটির প্রধান কার্যালয় রাজধানীর ১/এ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়িতে। কোম্পানিটি রামপুরার আফতাবনগরে পাইলিংয়ের কাজ করছে। সেখানেও তাদের আরেকটি সাব অফিস রয়েছে। উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শাস্তি দাবি ॥ জিহাদ উদ্ধারের পর আনন্দ আর বিষাদে পুরো এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে হাজির হয়। তিল ধারনের জায়গা ছিল না। পুরো এলাকায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিশু জিহাদকে দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন আবালবৃদ্ধবনিতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ও র‌্যাবকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, জানালায়, কার্নিশে, গাছে এককথায় এমন কোন জায়গা নেই যেখান থেকে ঘটনাস্থল দেখা যায় সেখানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। হাজার মানুষের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ নেমে আসে। কিন্তু সে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। মুহূর্তেই তা বিষাদে পরিণত হয়। ফায়ার সার্ভিস ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইতোপূর্বে পাইপটিতে কোন মানুষ বা লাশের অস্তিত্ব নেই বলে মন্তব্য করার প্রতিবাদ করে। হাজার হাজার মানুষ ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীদের শাস্তির দাবিতে এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা শাহজাহানপুর এলাকায় কাঁচাবাজার, বালুরমাঠ সংলগ্ন দোকানপাটসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভসহ ভাংচুর করে। তবে পুলিশের কঠোর তৎপরতার কারণে বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় উঠতে পারেনি। প্রায় আধঘণ্টা পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এছাড়া সময়মতো উদ্ধার করা সম্ভব হলে জিহাদকে হয়ত বাঁচানো যেত, এমন নানা কথা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এমন কথা ছড়িয়ে পড়ায় বিক্ষোভকারীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। তারা পুরো এলাকায় ভাংচুর করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিসহ সরকারের নানা সমালোচনা করে। পাশাপাশি ওয়াসার ওই পাম্পটিতে ভাংচুর চালায়। এ সময় সেখানে থাকা ওয়াসার লোকজন মুহূর্তেই সরে যায়। জিহাদের বাড়িসহ পুরো শাহজাহানপুরে শোকের মাতম ॥ পাইপে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই জিহাদের মতিঝিল ও গ্রামের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। সেই শোকে বাড়তি বিষাদ নেমে আসে জিহাদের নিথর দেহ উদ্ধারের পর। জিহাদের পিতার নাম নাসির উদ্দিন (৪৫)। আগে ভ্যান চালাতেন। ৮ বছর ধরে মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন পূর্বেরচর গ্রামে। জিহাদের মা খাদিজা বেগম (৩৫)। তার বাড়ি একই জেলার ডামুড্যা থানাধীন খোলেশ্বর এলাকার দক্ষিণ সুতলকাঠি গ্রামে। বড় মেয়ে স্বর্ণা (১৫)। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। তার ছোট জিসান (৬)। সবার ছোট জিহাদ। পরিবারটি প্রায় ৫ বছর ধরে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ৪১ নম্বর চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় একরুমে মাসিক ৫ হাজার টাকায় ভাড়ায় বসবাস করছেন। জিহাদ পাইপে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই জিহাদের মা বাসার সামনের বারান্দায় ছেড়া-ময়লা ব্যানার বিছিয়ে ল্যাপ নিয়ে শুয়ে পড়েন। জিহাদের লাশ উদ্ধারের পর সেখানে আর তিল ধারণের জায়গা ছিল না। শত শত মানুষ ভিড় করে আছেন জিহাদের বাড়িতে। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখা গেল, জিহাদের মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। জিহাদের বোন স্বর্ণা বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। আর ছোট ছেলে জিসান ভাই হারানোর ব্যথায় কেঁদেকেটে একাকার। শুধু ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছে। সেই সঙ্গে ঝরে পড়ছে অবুঝ শিশুটির চোখের জল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সবার চোখেই জল। কেউ কান্না থামিয়ে রাখতে পারছেন না। অঝোরে কাঁদছেন। পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। জিহাদের পিতা পাগলপ্রায় হয়ে ছেলে জন্য মূর্ছা যাচ্ছেন। এমন শোকের মাতম চলছে জিহাদের দাদা ও নানার বাড়ি শরিয়তপুরে। জিহাদকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা ॥ উদ্ধারের পর পরই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা মৃত জিহাদকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ এ্যাম্বুলেন্সে। বিকেল ৩ টা ৩৫ মিনিটে জরুরী বিভাগের আবাসিক সার্জন ডাঃ কে এম রিয়াজ মোরশেদ আনুষ্ঠানিকভাবে জিহাদকে মৃত ঘোষণা করেন। জরুরী বিভাগের চিকিৎসক রিয়াজ মোরশেদ জানান, শিশুটিকে মৃত অবস্থায়ই পান তারা। তারপরও শিশুটিকে ২০ মিনিট ধরে পরীক্ষা -নিরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জিহাদ অনেক আগেই মারা গেছে বলে নিশ্চিত হন চিকিৎসকরা। শিশুটির শরীরের কয়েকটি স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। জিহাদকে জীবিত উদ্ধার করতে না পারার প্রতিবাদে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনের চত্বরে বিক্ষোভ করেন জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে অতিরিক্ত র‌্যাব-পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বিকেলে পৌনে ৫টার দিকে জিহাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কড়া পুলিশ পাহারায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে মর্গের চারপাশে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। লাশ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়। শিশুটির পরণে হলুদ হাফপ্যান্ট ছিল। তার দুই পায়ের উপরের অংশ ও পিঠে জখমের চিহ্ন রয়েছে। জিহাদের ঘাতক ওয়াসার সেই পাইপটির অবস্থা ॥ স্থানীয়রা জানান, যে পাইপটিতে জিহাদ পড়ে যায় সেটি ওয়াসার পাম্পের পানি তোলার মোটা পাইপ। তার গভীরতা অন্তত ৫ থেকে ৬শ’ ফুট। পাম্পটি অন্তত ৮ বছরের পুরনো। পাম্পটির পানি রেলওয়ে কলোনিতে সরবরাহ করা হয়। বছরখানেক ধরে ওই পাইপ থেকে প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলিত হচ্ছিল না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলিত হচ্ছিল না। এজন্য বছরখানেক আগে পানির পাম্পের ওই কূপ বা পানি তোলার পাইপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন পাম্প বসানোর কাজ পায় এসআর হাউজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি পরিত্যক্ত পাইপটির প্রায় দেড় শ’ গজ সামনেই নতুন পাম্প বসানোর কাজ চালাচ্ছে। পাইপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও পাইপটির মুখে কোন ঢাকনা ছিল না। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওয়াসার লোকজনকে পাইপের ওপর ঢাকনা দেয়ার কথা বলা হলেও তারা গুরুত্ব দেননি। সে কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় ওয়াসার পাম্প বসানো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান জানান। একই ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
×