ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এটিএম বুথে লেনদেন বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪

এটিএম বুথে লেনদেন বছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ দুই দশকে দেশে অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ সেবার পরিধি বহুগুণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশে কার্যরত ৫৬টি ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৬১টি। লেনদেনে হচ্ছে বছরে প্রায় সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এত টাকা লেনদেন করছেন দেশের প্রায় ৮১ লাখ এটিএম কার্ডধারী গ্রাহক। বড় অঙ্কের গ্রাহকের এই পরিসংখ্যানে বাইরে মাত্র ২ শতাংশ ‘চিপ’ ভিত্তিক, যা তুলনামূলক নিরাপদ ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। বাকি ৯৮ শতাংশ কার্ড চুম্বক প্রলেপ (ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ) দেয়া, যা লেনদেনের জন্য খুবই অনিরাপদ এবং এগুলো জাল করা সহজ। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, এটিএম এবং প্ল্যাস্টিক কার্ডে ৪৩ শতাংশ জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংক ও তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তারা জড়িত থাকে। ১৮ শতাংশ জালিয়াতির সঙ্গে সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা থাকে। ১৫ শতাংশ জালিয়াতি হয় অননুমোদিত ব্যবহারকারী বা গ্রাহকের মাধ্যমে, ভেন্ডর বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জালিয়াতি হয় ৭ শতাংশ। ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, কার্ড হারিয়ে যাওয়া এবং পিন নম্বর ছিনতাইসহ নানান কায়দায় এই জালিয়াতিগুলো হয়। তবে ৫৬ শতাংশ ব্যাংক মনে করে বুথে জাল টাকার জন্য তাঁরা দায়ী নন। বিআইবিএমের গবেষণায় দেখা যায়, দুই দশকে দেশে অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ সেবার পরিধি বহুগুণ বেড়েছে। ১৯৯২ সালে একটি মাত্র এটিএম বুথ থেকে শুরু হয় এর যাত্রা। বর্তমানে দেশে কার্যরত ৫৬টি ব্যাংকের এটিএম বুথের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৬১টিতে। লেনদেন হচ্ছে বছরে প্রায় সাড়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯৯ সালে এটিএম বুথের মাধ্যমে লেনদেন ছিল ৭০ কোটি টাকা। ২০০১ সালে লেনদেন ছিল ২১১ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে ছিল ৩ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এটিএম বুথের মাধ্যমে লেনদেন ছিল ৬৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। দেশে স্থাপন করা এটিএম বুথগুলোর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার ৫১৩টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৬২টি, সিলেট বিভাগে ৪৬১টি, রাজশাহী বিভাগে ৩৪০টি, খুলনা বিভাগে ১৬৬টি, রংপুর বিভাগে ১৬৬ এবং বরিশাল বিভাগে ১০৩টি। আরও দেখা যায়, শহর এলাকায় ৯৫.১৬ শতাংশ এটিএম বুথ এবং ৪.৮৪ শতাংশ গ্রাম এলাকায়। প্রতি এক লাখ ব্যাংক হিসাবধারীর জন্য গড়ে ৭.৩৫টি এটিএম বুথ রয়েছে। প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য এটিএম বুথ রয়েছে ৩.৪০টি। বুথগুলোর মধ্যে ৯৫.৫৪ শতাংশই বেসরকারী ব্যাংকের। ১.৪৮ শতাংশ সরকারী ব্যাংকের, ০.২৬ শতাংশ বিশেষায়িত ব্যাংকের এবং ২.৫৮ শতাংশ বিদেশী ব্যাংকের। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ক্রেডিট কার্ড প্রথম চালু হয় ১৯৯৭ সালে। ডেবিট কার্ড চালু হয় ১৯৯৯ সালে। এর পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্লাস্টিক কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০ লাখ ৮৫ হাজার ৮৩৪টিতে। এর মধ্যে ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৭২ লাখ ৩২ হাজার ৫৫৪টি এবং ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ৮ লাখ ৫৩ হাজার ২৮০টি। এসব কার্ডের মাত্র ২ শতাংশ ‘চিপ’ ভিত্তিক, যা তুলনামূলক নিরাপদ। বাকি ৯৮ শতাংশ কার্ড চুম্বক প্রলেপ (ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ) দেয়া, যা লেনদেনের জন্য খুবই অনিরাপদ এবং এগুলো জাল করা সহজ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ৮টার মধ্যে এটিএম লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। এর পর বেশি লেনদেন হয় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১২টার মধ্যে। গত বছর একদিনে একটি এটিএম বুথে গড় লেনদেন ছিল ৪০টি। এটিএম বুথের মাধ্যমে একটি লেনদেনের জন্য ব্যাংকের খরচ হয় ৪৯ টাকা। এটা অবশ্য লেনদেনের ওপর নির্ভর করে। লেনদেনের সংখ্যা বেশি হলে এই খরচ কমে যাবে। যেমনÑ ২০১২ সালে প্রতিটি লেনদেনের পেছনে ব্যাংকের খরচ ছিল ৭১ টাকা। ওই বছর প্রতিটি এটিএম বুথের একদিনের গড় লেনদেন ছিল ২৭টি। ব্যাংক জানিয়েছে, দেশে এখন যে পরিমাণ এটিএম বুথ রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয় এবং তারা প্রধানত গ্রাম এলাকায় এটিএম বুথ বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তাছাড়া দেশের সব ব্যাংকের আইটি বিভাগের কর্মকর্তারা আরও ১৫ হাজার ৩৭৯টি এটিএম বুথের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছে। সারাদেশের মধ্যে রাজধানী ঢাকা শহরেই ৪৯ শতাংশ এটিএম বুথ রয়েছে। গ্রামে রয়েছে ৪.৮৪ শতাংশ এটিএম বুথ। দেশের ৪৩ শতাংশ এটিএম বুথই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। ব্যাংকটির এটিএম বুথ সংখ্যা ২ হাজার ৪৫২টি। জাল টাকা কোথা থেকে এটিএম বুথে আসছে তার কোন সঠিক উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি গবেষণা প্রতিবেদনে। অনেক ব্যাংকই বলেছে, জাল নোট বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া নোটের বান্ডেলের মধ্যেই ছিল। আবার অনেকে বলেছে, এটিএম বুথে টাকা ভরার কাজে যারা নিয়োজিত তারা জড়িত থাকতে পারে। তাছাড়া এটিএম বুথ থেকে সত্যি সত্যি জাল নোট পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করাও বেশ কঠিন। প্রতিবেদনে এটিএম ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে এটিএম এবং প্ল্যাস্টিক কার্ডে ৪৩ শতাংশ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ২৫ শতাংশ, অনলাইনে টাকা স্থানান্তরে ১৫ শতাংশ, ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে ১২ শতাংশ, ব্যাংক এ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যারে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২ শতাংশ জালিয়াতির ঘটনা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ জালিয়াতির সঙ্গে ব্যাংক ও তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তারা জড়িত থাকে। ১৮ শতাংশ জালিয়াতির সঙ্গে সাধারণ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা থাকে। ১৫ শতাংশ জালিয়াতি হয় অননুমোদিত ব্যবহারকারী বা গ্রাহকের মাধ্যমে, ভেন্ডর বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জালিয়াতি হয় ৭ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের এটিএম ব্যাংকিং প্রযুক্তিতিতে উন্নতি ঘটেছে, তবে এটি খুব বেশি শক্তিশালী না। বুথের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটিএম বুথ স্থাপনে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় সিসিটিভি ও সিকিউরিটি গার্ড রাখা হলেও মাঝে মধ্যেই এর ব্যত্যয় ঘটে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি। এক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জড়িত থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন। এজন্য তিনি এটিএম কার্ড ও পিন গোপনীয়তার সঙ্গে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বুথে নতুন টাকা নিয়মিত দেয়া হলে জাল টাকা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যপক মোঃ মাহবুবুর রহমান আলম বলেন, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, কার্ড হারিয়ে যাওয়া এবং পিন নম্বর ছিনতাইসহ নানান কায়দায় এটিএম ব্যাংকিংয়ের ম্যাধ্যমে জালিয়াতি হয়। তিনি বলেন, এটিএম বুথ চালাতে ব্যাংকগুলোকেও অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কারিগরি ত্রুটিও দেখা দেয় প্রচুর। এর মধ্যে নেটওয়ার্ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার সমস্যাটি এক নম্বর। তাছাড়া পুরনো নোটের কারণেও এটিএম বুথগুলোকে অনেক সময় কারিগরি সমস্যায় পড়তে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে এটিএম ব্যাংকিং প্রযুক্তি আমাদের দেশে খুব বেশি উন্নত নয়। গ্রাহকের চোখের আড়ালে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড পাঞ্জ করার কারণে কার্ড জালিয়াতিও বাড়ছে। এজন্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আরও বেশি সতকর্তা অবলম্বন করা উচিত।
×