ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শ্বাসরুদ্ধকর ১০ ঘণ্টার অভিযানেও উদ্ধার হয়নি শিশু জিহাদ

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

শ্বাসরুদ্ধকর ১০ ঘণ্টার অভিযানেও উদ্ধার হয়নি শিশু জিহাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ খেলতে গিয়ে রাজধানীর শাহজাহানপুর বালুরমাঠ সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনিতে ওয়াসার পরিত্যক্ত ৬ শ’ ফুট গভীর পানির পাম্পে আটকেপড়া শিশু জিহাদ উদ্ধারে চলছে শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। বিকেল চারটা থেকে উদ্ধার অভিযান শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। রাত দুটোয় এ রিপোর্ট পর্যন্ত জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত জিহাদ জীবিত ছিল বলে ফায়ার সার্ভিসের দাবি। যদিও তার পরের অবস্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কিছুই জানা যায়নি। জিহাদের অবস্থান জানার জন্য পাইপের ভেতরে শক্তিশালী ক্যামেরা পাঠানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি বুয়েটের ৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল ক্যাচার পদ্ধতিতে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। তার আগে রাত পৌনে বারোটায় পাইপের তলদেশে নেমে শিশুটিকে উদ্ধারের প্রস্তুতি নেয় স্বেচ্ছাসেবক এক সাহসী যুবক বশির উদ্দিন। তাকে গর্তে নামানোর প্রস্তুতি যখন শেষ পর্যায়ে তখন আপত্তি ওঠায় তাকে নামতে দেয়া হয়নি। ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার বিকেল পৌনে চারটায়। শাহজাহানপুর বালুরমাঠের পূর্ব দিকে চারতলা রেলওয়ে কলোনির একটি ভবন ও রেলওয়ে কলোনি সুপার মার্কেট সমিতির সামনেই পরিত্যক্ত এ পাম্পটির অবস্থান। প্রতিদিনের মতো জিহাদ তার সমবয়সী দুই বন্ধুর সঙ্গে খেলতে যায় ওই মাঠে। মাঠটিতে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন চলছিল। সেখানে প্রচুর লোক সমাগম ছিল। ছোট্ট শিশু জিহাদ দুই বন্ধুর সঙ্গে খেলতে সেখানে যায়। তারা দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে ছোট্ট জিহাদ খোলা ওই পাইপে পড়ে যায়। খেলার সাথীরা জিহাদের পড়ে যাওয়ার বিষয়টি সেখানে থাকা লোকজনকে জানায়। তাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে বিকেল চারটা থেকে ফায়ার সার্ভিস জিহাদ উদ্ধারের কাজ শুরু করে। রাত দুটোয় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। স্থানীয়রা জানান, ওয়াসার পাম্পটির পানি তোলার যে পাইপের ভেতরে জিহাদ পড়ে গেছে, সেটি অন্তত ৮ বছরের পুরনো। পাম্পটির পানি রেলওয়ে কলোনিতে সরবরাহ করা হয়। বছরখানেক ধরে ওই পাইপ থেকে প্রয়োজনীয় পানি উত্তোলিত হচ্ছিল না। পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বছরখানেক ধরে পানি উত্তোলনের ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চি ব্যাসের ওই পাইপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই পাইপটির ১৫ থেকে ২০ ফুট সামনেই পানি উত্তোলনের জন্য গভীর পাইপ বসানোর কাজ চলছে। পুরনো পাইপটির ওপর কোন ঢাকনা ছিল না। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওয়াসার লোকজনকে পাইপের ওপর ঢাকনা দেয়ার কথা বলা হলেও তারা আমলে নেননি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, পাইপটির আনুমানিক গভীরতা অন্তত ৫শ’ থেকে ৬শ’ ফুট। তবে জিহাদ পাইপের কত ফুট গভীরে পড়ে গেছে তা সঠিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আনুমানিক ৩শ’ ফুট গভীরে পড়ে গেছে সে। জিহাদ পাইপের ভেতরে থাকা লোহার জালের ওপর পড়ে আটকে আছে বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা। জিহাদকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত কয়েক দফায় পানি ও জুস দেয়া হয়েছে। ভেতরে আলো, অক্সিজেন ও ক্যামেরা পৌঁছানো হয়েছে। ক্যামেরা দিয়ে জিহাদ কী অবস্থায় রয়েছে তা বাইরে থাকা মনিটরে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাইপের ব্যাস কম হওয়ায় সেখানে আরেকজন মানুষ প্রবেশ করে শিশুসহ উদ্ধারকারীর ওঠা কষ্টকর। এজন্য কাউকে পাইপের ভেতরে নামানো হয়নি। রানা প্লাজায় উদ্ধারকারী জনৈক বশির আহমেদ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু বশিরের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কায় তাঁকে পাইপের ভেতরে পরে নামতে দেয়া হয়নি। ফায়ার সার্ভিস পাইপ দিয়ে, রশি ফেলে জিহাদকে দফায় দফায় উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ক্যাচার পদ্ধতিতে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। জিহাদের পিতার নাম নাসির উদ্দিন (৪৫)। আগে তিনি ভ্যানচালক ছিলেন। ৮ বছর আগে মতিঝিল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে তিনি চাকরি পান। প্রায় ১০ হাজার টাকা বেতনে সেখানে কর্মরত। তার বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার পূর্বেরচর গ্রামে। জিহাদের মা খাদিজা বেগম (৩৫)। তার বাড়ি একই জেলার ডামুড্যা থানাধীন খোলেশ্বর এলাকার দক্ষিণ সুতলকাঠি গ্রামে। বড় মেয়ে স্বর্ণা (১৫) শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। তার ছোট জিসান (৬)। সবার ছোট জিহাদ (৪)। পরিবারটি প্রায় ৫ বছর ধরে শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ৪১ নম্বর চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি রুমে মাসিক ৫ হাজার টাকা ভাড়ায় বসবাস করছে। এ ঘটনার পর জিহাদের মা বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। চোখের জল শুকিয়ে গেছে। তিনি আর কাঁদতে পারছিলেন না। মানুষ দেখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান, বুয়েটের চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল, রেলওয়ে, র‌্যাব ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলটি ক্যাচার পদ্ধতি ব্যবহার করে জিহাদকে উঠানোর চেষ্টা করছিল। এ ঘটনায় রেলওয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি গভীর নলকূপ বসানোর কাজ পাওয়া এসআর হাউসকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে ভিড় করেছে। মানুষের ভিড় সামলাতে পুলিশ ও র‌্যাবকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।
×