ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্যালা নদীর দুই তীরে আটকা পড়েছে ৩শ’ লাইটারেজ

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪

শ্যালা নদীর দুই তীরে  আটকা পড়েছে ৩শ’ লাইটারেজ

রশিদ মামুন/ আহসান হাবিব হাসান, শ্যালা নদী ঘুরে এসে ॥ স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে সুন্দরবনের পরিবেশ। শুক্রবার পুরো শ্যালা নদী ঘুরে দেখা গেছে জেলেরা আগের মতোই মাছের পোনা সংগ্রহ করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন তাঁরা জ্বালানি তেল দেখতে পাচ্ছেন না। যদিও নদীর দুইপাড়ের মাটিতে এখনও কালো তেলের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। আজ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলের তথ্য সংগ্রহ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। চলতি সপ্তাহে পর্যবেক্ষক দল সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারকে সুপারিশ করবে। এদিকে আকরাম পয়েন্ট-বলেশ্বর হয়ে ১০০ কিলোমিটার ঘুরে আসায় মংলাবন্দরে স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্যালা নদীর দুই প্রান্তে আটকা পড়েছে অন্তেত ৩০০ লাইটারেজ। বন্দরের বাণিজ্যিক জাহাজের মাল খালাসেও স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ সময় প্রয়োজন হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, ৯ তারিখ শ্যালায় তেল ট্যাঙ্কার ডুবি পরবর্তী ১৮ দিনে রাত দিনে চারটি করে মোট ৭২টি জোয়ার ভাটা হয়েছে। এতে পানিতে ভেসে থাকা তেল পানির সঙ্গে মিশে গেছে। অধিকাংশ ভাসমান তেল ভাটার পানিতে সমুদ্রে চলে গেছে। স্থানীয় বন কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্ঘটনার সময় মরাকটাল থাকায় নদীর পানির তল নিচু ছিল। এতে নিঃসরিত তেল বনের ভেতর ঢুকতে পারেনি। ফলে বড় বড় গাছ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উজান ও ভাটিতে নদীর উভয় তীরে প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকায় দুই থেকে ২১ ফুট প্রস্থ ছোট ছোট গাছপালায় কালো তেল লেগে যায়। বনবিভাগ এসব এলাকা থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ঘাস এবং চারাগাছ কেটে নিয়ে এসেছে। শ্যালায় মাছের পোনা সংগ্রেহের সময় স্থানীয় জেলে রবিউল জানান, এখন আর তেলের কোন প্রভাব নেই। তাদের সংগ্রহ করা পোনাতেও কোন রকমের কালো তেল লেগে থাকতে দেখছেন না। নাকে আগের মতো আর তেলের গন্ধও ভেসে আসছে না। অপর পোনা সংগ্রহকারী করিম উদ্দিন জানান, এখন আর কোন সমস্যা নেই। প্রথম দিকে নদীর পানি ব্যবহার না করা গেলেও এখন কোন সমস্যা হচ্ছে না। আগের সব জেলেই এখন মাছের পোনা সংগ্রহ করছে। শ্যালায় আশপাশের পোনা ক্রয়-বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে পুরোদমে কাজ চলছে। দুর্ঘটনার পর ছয় থেকে ১০ দিন পর থেকে জেলেরা আস্তে আস্তে জাল ফলেতে শুরু করে। দুর্ঘটনার পর পর পানিতে পুরু তেলের আস্তরণ থাকায় জাল নষ্ট হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় জাল ফেলতে পারেনি। তবে এখন তেমন কোন আশঙ্কা নেই বলে জানান স্থানীয় জেলেরা। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল সূত্র জানায়, আজ সুন্দরবনের তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হচ্ছে এই দলের। ছয়টি দলে বিভিক্ত হয়ে পর্যবেক্ষক দল তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া তেলে জল এবং স্থলের প্রাণীর ওপর প্রভাব, উদ্ভিদ এবং বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ওপর ফার্নেস অয়েলের প্রভাব নিরূপণের কাজ করছে। পর্যবেক্ষক দল ইতোমধ্যে সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার জন্য পেট্রোবাংলা, পরমাণু শক্তি কমিশন এবং পরিবেশ অধিদফতরে পাঠিয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর তা বিশ্লেষণ করে কমিটি রিপোর্ট তৈরি করবে। কমিটির একটি সূত্র জানায়, এখনও এসব নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পায়নি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল। ফলাফল পাওযার পরই তেলের রাসায়নিক সুন্দরবনের ওপর দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রভাব পড়বে কি না তা জানা যাবে। জানতে চাইলে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলের সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আজ শনিবারও পর্যবেক্ষক দল সুন্দরবনে কাজ করবে। তবে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত না হলে সুপারিশ সম্পর্কে কিছুই বলা সম্ভব নয়। ঢাকায় ৩১ ডিসেম্বর তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকায় সরকারের কাছে পর্যবেক্ষক দল এই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মংলা ঘষিয়াখালি চ্যানেল খননের ওপর সব থেকে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। আগামী জুনে এই চ্যানেল চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ এবং বনবিভাগ মংলাবন্দর চালু রাখতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেবেন বলে বন্দর ব্যবহারকারীরা মনে করছেন। দুর্ঘটনার পর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ নুরুল করিমকে প্রধান করে গঠিত ১৩ সদস্যর প্রতিনিধি দল সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে স্থায়ীভাবে নৌযান চলাচল বন্ধের সুপারিশ করেছে। যদিও ওই কমিটি বলছে শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল যদি অপিরহার্য হয়ে থাকে, তাহলে কিছু বিষয় বিবেচনার জন্য পরামর্শ দেয় ওই কমিটি। সেগুলো হলো প্রতিটি জাহাজে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমোদিত নির্ধারিত পাইলট থাকতে হবে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জয়মণিঘোল- আন্ধারমানিক-হরিণটানা- দুধমুখী-শরণখোলা-বগী পথে একই জোয়ার এবং একই ভাটায় জাহাজগুলো সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকা অতিক্রম করতে হবে। চলাচলকারী ট্যাঙ্কারের চেম্বারগুলো পানি নিরোধক হতে হবে। এ পথে জাহাজের গতি কম রাখারও পরামর্শ দিয়েছে ওই কমিটি। মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে এখন শ্যালার দুইপাশে অন্তত ৫০০ সারবাহী লাইটার্জ আটকা পড়েছে। এছাড়া বেসরকারী শিল্পকারখানার পণ্যবাহী আরেও লাইটার্জ আটকা পড়েছে। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, আগে যেখানে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ চার থেকে পাঁচ দিনে মাল খালাস করে বন্দর ত্যাগ করতে পারত এখন ১০ থেকে ১২দিন সময় প্রয়োজন হচ্ছে। দীর্ঘ সময় এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে জাহাজ মালিকরা মংলাবন্দরের প্রতি আগ্রহ হারাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে বন বিভাগ বলছে ঘষিয়াখালি চ্যানেল চালু না হওয়া পর্যন্ত ভাটা এবং জোয়ারে প্রতিদিন পালা করে এক দিকে জাহাজ চলাচল করতে পারে। বনবিভাগ তাদের নিজস্ব প্রহারায় জাহাজগুলোতে শ্যালা নদী পার করে দেবে। এতে বিপরীত দিক থেকে আসা কোন নৌযানের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হবে না। তবে এই সুযোগ মংলা ঘষিয়াখালি চ্যানেল চালু করা পর্যন্ত থাকবে। ওই চ্যানেল চালু হলে এই রুট বন্ধ করে দিতে হবে। মংলাবন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান শুক্রবার বিকেলে এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দর বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব মংলা-ঘষিয়াখালি চ্যানেল চালু করতে হবে। একইসঙ্গে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে আমাদের সুন্দরবনও রক্ষা করতে হবে আবার দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকা- অব্যাহত রাখতে বন্দরও চালু করতে হবে। সরকার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি উদ্যোগ নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মংলাবন্দর দিয়ে ৬৫ ভাগ সার আমদানি হয়। আবার এই সারের মধ্যে ৬০ ভাগ এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নৌপথে চলে যায়। দুর্ঘটনার আগে যেসব লাইটারেজ সার নিয়ে গেছে সেগুলো এখন বরিশালের কাউখালিতে আটকে আছে। আবার এই প্রান্তে যারা আছে তারাও যেতে পারছেন না। চেয়ারম্যান বলেন, বাণিজ্যিক জাহাজ হ্যান্ডেলিং এ দ্বিগুণ সময় লেগে যাওয়ায় খরচ বাড়ছে যাতে জাহাজ মালিকরা বন্দরের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। গত দুই বছরে মংলাবন্দর ঘুরে দাঁড়িয়েছে এ বছর বন্দরে ৫০০ বাণিজ্যিক জাহাজ এসেছে। মংলা বন্দর সচল করার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব মংলা-ঘষিয়াখালি চ্যানেল চালু করতে হবে। এছাড়া আপাতত শ্যালা দিয়ে কোস্টগার্ডের প্রহরায় একমুখি চলাচলের প্রস্তাব দিয়েছি। এছাড়া চ্যানেলের মধ্যে কোন নৌযান নোঙ্গর না করে রাখা ছাড়াও চ্যানেলের মধ্যে প্রবেশের আগে ফিটনেসের ছাড়পএ আছে কি না তা দেখাতে হবে।
×