ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আপোস করিনি কখনওই আমি, এই হলো ইতিহাস- আবৃত্তি

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

আপোস করিনি কখনওই আমি, এই হলো  ইতিহাস- আবৃত্তি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পড়ন্ত বিকেল। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে জনকলরবে পূর্ণ ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর প্রাঙ্গণ। রঙ-বেরঙের কাপড় আর প্রিয় মানুষটির হাত ধরে আগত দর্শক-শ্রোতা উৎসুক চিত্তে অপেক্ষা করছে প্রিয় শিল্পী শিমুল মুস্তাফার একক আবৃত্তি উপভোগের জন্য। অনুষ্ঠান শুরু হতেই জনকলরবের মাঝে হঠাৎ ছিমছাম নীরবতা। ক্ষাণিক আবৃত্তি পরিবেশনার পর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের পুরো চেহারা বদলে যায়। স্বাধীনতার স্মারক স্বরূপ আয়োজক সংস্থা বৈকুণ্ঠ আবৃত্তি একাডেমির ১৯৭১টি মোমবাতি প্রজ্বলন এবং মুক্তাকাশে ৭১টি ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের এক ভিন্ন মাত্রা প্রকাশ পায়। বৈচিত্র্যপূর্ণ এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বৃহস্পতিবার বিকেলে। টানা ৫ ঘণ্টা চলে এই আবৃত্তি অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ‘আপোস করিনি কখনোই আমি, এই হলো ইতিহাস’ শিরোনামের আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন শিমুল মুস্তাফা। তিনি এক এক করে পঁচিশটি কবিতা আবৃত্তি করেন। এরপর মঞ্চে আসেন সঙ্গীত শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল ও প্রিয়াংকা গোপ। শিল্পীদের সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় কালজয়ী গান ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’। এ সময় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী’র মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি পায় ভিন্ন এক মাত্রা। বাঙালী চিন্তা, চেতনা সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং বোধের এই বিশাল মিলন মেলায় প্রাণের টানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় দশ হাজার দর্শক বিমুগ্ধ দর্শক চিত্তে শ্রবণ করে টানা পাঁচ ঘণ্টার আবৃত্তি অনুষ্ঠানের ৭১টি কবিতা। আবৃত্তির পরিবেশনার আগে শিমুল মুস্তাফা বলেন, কবিতার মাধ্যমে মানুষের অব্যক্ত ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, কল্পনা, ইত্যাদি প্রকাশ পায়। মূলত মূক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এ প্রজন্মের তরুণদের উদ্দেশ্যে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানের শেষে একদল শীতার্থ পথশিশুদের মাঝে ৫০টি কম্বল প্রদান করেন আবৃত্তি শিল্পী শিমুল মুস্তাফা। সেই সঙ্গে গেল বছরের মতো অনুষ্ঠানে আগত দর্শকদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এতিম ও দরিদ্র শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি দাতব্য সংস্থাকে প্রদান করেন। আবৃত্তি পরিবেশনা, গান এবং পথশিশুদের প্রতি সহানুভূতির এই অনুষ্ঠানে ক্ষণিকের জন্য হলেও নেমে আসে মানবিক চেতনার এক অমোঘ আহ্বান। নারীর অসমাপ্ত ইতিহাস গীতিকা কথামানবী মঞ্চস্থ ॥ ‘কথামানবী’ একটিই কবিতা, বারো শ’ লাইনের একটি আত্মকথা অথবা একটি অসমাপ্ত ইতিহাস গীতিকা। শৌর্যবীর্যের গল্পে ভরা ইতিহাস বইয়ের তলায় মেয়েদের যে গহন কাহিনী চাপা পড়ে আছে, এটি তারই ভাষ্যকার। এ হলো সেই নারী যে যুগান্তের অপমান আর অবহেলার পরেও ভালবাসতে পারে, প্রতিবাদ করতে পারে, যে নতুন জন্ম ফিরে ফিরে আসে দ্রৌপদী, গঙ্গা, সুলতানা রিজিয়া, মাধবী, মেধা পাটেকর, মালতী মুদি, শাহবানু বা খনার মধ্য দিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ের কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত’র এক দীর্ঘ কবিতার শ্রুতিরূপ ‘কথামানবী’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটম-লে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই কাব্যভাষা পরিবেশন করে মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’র তরুণ সদস্যরা। সংগঠনটির দ্বিতীয় এ মঞ্চায়ন সেই সব বাঙালী নারীর শ্রদ্ধায় নিবেদন করা হয়, যাঁরা একাত্তরে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হয়েছে। এবং উৎসর্গ করা হয় সদ্যপ্রয়াত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। শুরুতে পরিবেশিত হয় কবির আত্মকথা যেখানে তিনি নিজেই কথামানবী। এরপর মঞ্চে আবির্ভূত হন দ্রৌপদী নামে অন্ধকার যুগের এক আলোকোজ্জ্বল নারী, মহাভারতে পঞ্চপা-বের স্ত্রী বলে খ্যাত তেজস্বিনী এই নারী পতিতপরায়ণ, কোমল প্রকৃতি সম্পন্ন কিন্তু লজ্জাশীল নয়। পরের পরিবেশনা ছিল ‘গঙ্গাজন্ম’। নদীর মতো নারীর জীবনও প্রবহমান। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তাঁকে বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। গঙ্গা চরিত্রটি তারই ইঙ্গিত বহন করে। ভারতের মহারাষ্ট্রের মেয়ে মেধা পাটেকর, গুজরাটে গিয়ে নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ দেয়ার ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত রূখে দিয়েছিলেন যিনি, মঞ্চে আসেন সেই চরিত্র। পরে পরিবেশিত হয় শাহবানুর ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনী। মাধবীজন্মে দেখা যায় ত্যাগে ও সেবায় নারীর শক্তি। মাধবী যেমন পিতার প্রতি কর্তব্য পালনে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন গালবের গুরুদক্ষিণা সংগ্রহ করতে। পরিবেশিত হয় অদম্য সাহসিকতার প্রতীক এক ঐতিহাসিক অমর চরিত্র সুলতানা রাজিয়ার কাহিনী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা বন্ধ করে দেয় তাঁকে হত্যা করার মাধ্যমে। ভারতে পুরুলিয়ার আদিবাসী মালতী মুদি ইটভাটার শ্রমিক। মালিক কর্তৃক তাঁকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ থানার ওসি ফিরিয়ে দিলে, গ্রামবাসীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এই প্রান্তিক শ্রেণীর আধুনিক নারী। সবশেষ পরিবেশনা ছিল খনার জন্ম। কিংবদন্তি এই বিদূষী নারী কবি বাংলার লোকজীবন সম্পর্কে অনেক ভভিষ্যদ্বাণী করেছেন, যা খনার বচন নামে পরিচিত। খনা এবং তাঁর স্বামী মিহির উভয়েই জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে পিতার আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। মুক্তধারা প্রযোজিত ‘কথামানবী’ কাব্যনাট্যটি নির্দেশনা নিয়েছেন মু: সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ। এবং বিভিন্ন চরিত্রে রূপ দান করেছেন এমি রশিদ, শফি ইসলাম উষা, রাবিয়া সুলতানা পান্না, তাহের আফরোজ, জেবুন নেসা খানম জীবন, সায়মা নেহাল অর্ণা, তানজিনা ইয়াসমিন, আম্বীয়া তাপসী ও আজরা জেবিন তুলি। মঞ্চায়ন হলো ‘প্রেম পরাণের কথা’ ॥ বাংলা নাট্যদলের প্রযোজনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় ভিন্নধারার গল্পের নাটক ‘প্রেম পরাণের কথা’। নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবন ও তাদের সংস্কৃতি। নাটকে দেখা যায়, জমশেদ বেপারি পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী তার একমাত্র মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে। তাকে তালিম দেয়ার জন্যে নবী উল্লাহর ছেলে মোতাহার বাড়িতে কৌশলে প্রবেশ করে। জমশেদ গুলবাহারের বিয়ের জন্য খুবই চিন্তিত। মারজান জমশেদকে অনেক বিয়ের প্রস্তাব দেয় কিন্তু তাতে রাজি হয় না। মারজান খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে মোতাহার উচ্চ বংশের নবী উল্লাহর পরিবারের ছোট ছেলে। জমশেদ প্রস্তাবে রাজি হয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে গুলবাহারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে নবী উল্লাহ পরিবারের বড় ছেলে আতাহারের। মোতাহার ভালবাসে আবার গুলবাহারকে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক কি করে সম্ভব? এদিক মাখন গুলবাহারকে পাওয়ার জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে কাজল ও মেহেরজানকে দিয়ে। ফলে মোতাহার গুলবাহারের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অবশেষে তাদের ভুলের অবসান ঘটায় মোহাম্মদ আলী ও গোলাপজান। বিয়ে যখন সব কিছুই ঠিক তার আগের দিন রাতে মোতাহার ও গুলবাহার পালিয়ে যায়। নবী উল্লাহর ছেলে আতাহার বর সেজে যখন গুলবাহারের বাড়িতে যায় তখন মেয়ের চিন্তায় জমশেদ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর এভাবে এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনী। হ ম সহিদুজ্জামানের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন-আবিদ আহমেদ, মেহেজাবিন রাত্রি, সেলিম বহুরূপী, রাজু হোসাইন, নাসির আহমেদ, জয়া হাসান, হ ম সহিদুজ্জামান, নিহার হোসেন ফারুক, পলাশ খান, সুবর্ণা আক্তার, মজিবুর রহমান মিয়জি। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা আবিদ আহমেদ, সঙ্গীত পরিচালনায় অনন্যা সাফরিন।
×