ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনীতির স্বস্তির বছর ॥ সব সূচকে উন্নতি

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৪

অর্থনীতির স্বস্তির বছর ॥ সব সূচকে উন্নতি

এম শাহজাহান ॥ গত বছর ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬৫-১০০ টাকায়। তবে চলতি বছর এ সময়ে রাজধানীর ক্রেতাদের এই দাম দিতে হচ্ছে না। এখন প্রতিকেজি দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়। শুধু পেঁয়াজ নয়, এর সঙ্গে গত এক বছরে হ্রাস পেয়েছে ভোজ্যতেল, ডাল, আটা, চিনি, ডিম এবং মসলার দামও। স্থিতিশীল রয়েছে চালের বাজার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় গত এক বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম আর বাড়তে পারেনি। ঠিক একইভাবে এই সময়ে রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি, মূল্যস্ফীতি, রেমিটেন্স প্রবাহ ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যসহ সব সূচকের উন্নতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা ছিল অর্থনীতির স্বস্তির বছর। ক্যালেন্ডার বছরের পুরোটা সময় ছিল অর্থনীতির। এভাবে চললে ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়ার যে স্বপ্ন রয়েছে সরকারের তা পূরণ করা সম্ভব বলেও মনে করছেন তাঁরা। জানা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে ১৮ বিলিয়ন থেকে বেড়ে বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ হয়েছে ২২ দশকি ৪০ বিলিয়ন ডলার, যা স্বাধীনতার ৪৩ বছরে সর্বোচ্চ। গত তিনমাসের ধারাবাহিকতায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া গত বছরের ন্যায় ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে এবারও রফতানির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে বছর শেষে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক, চামড়া ও চিংড়িসহ অন্যান্য রফতানি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণেই অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরাও। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় বাজেটে ভর্তুকির চাপ কমছে। যদিও দুই বছর আগে ভর্তুকির চাপে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ ছিল জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। এখন জ্বালানি পণ্যের দাম আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় সে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দাম আরও কমতে পারে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার ইতিবাচক প্রভাবে চাপ কমছে মূল্যস্ফীতির ওপর, নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সরকারের ব্যয়, স্থিতিশীল পণ্যমূল্য। সর্বোপরি স্বস্তিতে দেশের অর্থনীতি। তবে অর্থনীতির সূচকগুলোকে ইতিবাচক ধারায় ধরে রাখতে বিদায়ী বছরের ন্যায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বেশি জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে অবকাঠামো উন্নয়নে নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির পথে বড় বাধাগুলো হলো-অপর্যাপ্ত বিদ্যুত সরবরাহ, পরিবহন ও দুর্বল অবকাঠামো খাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, দক্ষ জনশক্তির অভাব এবং বিদেশী বিনিয়োগের প্রতি চ্যালেঞ্জ। জানা গেছে, গত অর্থবছরে ভর্তুকি খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর আগের বছর ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ভর্তুকি হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয়। এই ব্যয় কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে আসছে আইএমএফ। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের দাম কমানো উচিত। এটা করা হলে পণ্যের উৎপাদন খরচ আরও সাশ্রয়ী হবে। জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা কমবে। প্রশমিত হবে মূল্যস্ফীতির চাপ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকায় অর্থনীতিতে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে। তবে এখনও বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ সেভাবে বাড়েনি। এজন্য অবকাঠামো নির্মাণ বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জ্বালানি তেলের দাম কমানো উচিত। এটা করা হলে বিদ্যুত উৎপাদন খরচ কমবে। চাপ কমবে মূল্যস্ফীতির। সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল হবে সামষ্টিক অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। এছাড়া মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিসহ বেড়েছে ব্যাংকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির হার। এতে বেসরকারী খাত চাঙ্গা হওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা যা ভাবছেন ॥ গত ২০১৩ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা মনে করে এখনো আঁতকে উঠেন ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। তবে বিদায়ী বছরের মতো ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদ দিচ্ছে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা। স্বাধীনতার ৪৩ বছরের দীর্ঘসময়ে গত বছর হরতাল-অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির তথ্য মতে, গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় চার খাতে প্রায় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা মোট দেশজ আয়ের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। আর সে সময়ে দেশে ৫৫ দিন হরতাল ও অবরোধ পালিত হয়েছে। তবে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে আবারও রাজনৈতিক সহিংসতার আভাস দিয়েছে রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপি ও জামায়াত শিবির। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে ইতোমধ্যে সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি কাজী আকরামউদ্দীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে অর্থনীতি এখন স্বস্তিতে রয়েছে। আবারও হরতাল-অবরোধ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়বে। তিনি বলেন, অর্থনীতির সব সূচক এখন ভাল অবস্থায় রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম কমে গেছে। রাজনৈতিক সংঘাত বন্ধ হলে ২০২১ সালের মধ্যেই দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। এছাড়া সম্প্রতি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) সাংবাদিক সম্মেলন করে সংঘাতের রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ডিসিসিআই সভাপতি হোসেন খালেদ বলেন, ব্যবসায়ীদের চাহিদা হলো দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকা। এজন্য আমরা আসন্ন দিনগুলোতে নতুন কোন রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচী দেখতে চাই না। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্র, নানা প্রতিবন্ধকতা ও ব্যবসাবান্ধব নীতির অভাবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ কম হচ্ছে। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত না হলে বিদেশী বিনিয়োগও আসবে না। এতে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সঙ্কটের মধ্যেও দেশের অর্থনীতিতে টেকসই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। মহাজোট সরকারের গত ছয় বছরে মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি বেড়েছে, কমেছে মূল্যস্ফীতি। ওই সময়ে মাথাপিছু আয়, সঞ্চয়, রেমিটেন্স, সরকারী বিনিয়োগ, রফতানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মূল্য, মজুরি ও কর্মসংস্থান বেড়েছে। নতুন বছর হবে অর্থনীতির বছর এই কথা জানিয়ে, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বছরে অর্থনীতিতে আরও স্বস্তি ফিরে আসবে এটাই প্রত্যাশা করছি। সবার আগে সরকারকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির ওপর নজর দেয়া প্রয়োজন। পরিবেশ সৃষ্টি হলে এতদিন যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। বর্তমান সরকারের অধীনেই দেশে বিনিয়োগ বাড়বে, সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান এবং দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর হবে বলে মনে করেন তিনি। জানা গেছে, বতর্মান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী রোডম্যাপ প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য পূরণে আগামী ২০১৫ সালের মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালের মধ্যে ৯-১০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০২১ সালের মধ্যে ২ হাজার ডলারে উন্নীত করা, জাতীয় সঞ্চয় ২০২১ সালের মধ্যে মোট জিডিপির ৩৯ শতাংশ অর্জন করা, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ শতাংশ অর্জন এবং ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যতা কমিয়ে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
×