ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪

পাঁচ মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে

রহিম শেখ ॥ অর্থবছরের পাঁচ মাসেই সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে সাড়ে ১০ হাজার হাজার কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার কম হওয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের জাল-জালিয়াতির ঘটনায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি ঝুঁকিহীন এবং বেশি মুনাফার কারণে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে বলে মনে করেন তাঁরা। তবে বিনিয়োগে গতি ফিরতে শুরু করায় সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের বোঝা না বাড়ানোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। সঞ্চয়পত্র বিক্রি সংক্রান্ত জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১০ হাজার ৫৪২ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা টাকা বেশি। এ বছর নিট বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। চলিত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বেশি বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৮৬৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ হাজার ৮৬১ কোটি ৭৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর মাধ্যমে পাঁচ মাসে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ৮১৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল্য পরিশোধ বাবদ ৪ হাজার ৮১৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আর সুদ হিসেবে পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে তা এক লাফে বেড়ে এক হাজার ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকায় উঠে। এরপর থেকে বেড়েই চলেছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৬২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এপ্রিলে এক হাজার ২৭৩ কোটি। মে মাসে এক হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ মাস জুনে নিট বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরও বেড়ে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। আগস্ট মাসে এক লাফে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ গিয়ে উঠে দুই হাজার ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। সর্বশেষ গত নবেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ এসেছে ১ হাজার ৪৬৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ২৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে আসে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এতো বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি। আকর্ষণীয় মুনাফা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত কোন ধরনের ঝুঁকি না থাকায় এবং বেশি লাভের জন্য সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটা ভাল সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগ তারা নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে। জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা বেশি এসেছে। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়। এদিকে গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। পুরো অর্থবছরে মাত্র সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার। অথচ তার আগের বছরে (২০১২-১৩) এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় তা বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, এর একটা খারাপ দিকও আছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। এত বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে। আবার সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়লে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাপ কমবে, যাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে গত বছরের মার্চ মাস থেকে সুদের হার কিছুটা বাড়িয়েছে সরকার। পরিবার, পেনশনার, তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, ডাকঘর ও পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করমুক্ত রেখেছে সরকার। বর্তমানে ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে। এদিকে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গ্রাচুইটি ফান্ডের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যাবে না। এতে বলা হয়েছে, গ্রাচুইটি ফান্ডের অর্থ ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা হলে সেগুলো সঞ্চয়পত্র আইন মোতাবেক নগদায়ন করে নিতে হবে। এজন্য কোন সুদ বা মুনাফা পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে যারা গ্রাচুইটি ফান্ডের অর্থ দ্বারা সঞ্চয়পত্রে বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত (যদি থাকে) তাদের চিহ্নিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানাতে নির্দেশ দেয়া হলো। ২০০৫ সালের ১১ জুন থেকে কোন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত ভবিষ্যত তহবিলের টাকা ৫ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার সযোগ ছিল। কিন্তু কর কমিশন কর্তৃক স্বীকৃত ভবিষ্যত তহবিল ছাড়া গ্রাচুইটি ফান্ডের অর্থ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না।
×