ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তাঁর আঁকা ছবি আজ শুধু ছবি নয়, ইতিহাস বাঙালীর অমূল্য সম্পদ

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

তাঁর আঁকা ছবি আজ শুধু ছবি নয়, ইতিহাস বাঙালীর অমূল্য সম্পদ

মোরসালিন মিজান ॥ চারুকলার চর্চার পক্ষে খুব অনকূল ছিল না সময়টি। তাতে কী? অবলিলায় সে সময়কে জয় করেন জয়নুল আবেদিন। আশ্চর্য প্রতিভা আর স্বপ্ন দিয়ে গড়ে নেন। তাঁর আঁকা ছবি আজ শুধু ছবি নয়, এক-একটি ইতিহাস। বাঙালীর অমূল্য সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত হচ্ছে। শিল্পের ভুবনকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বাংলাদেশে চর্চাটি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। এভাবে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি শিল্পী; শিল্পাচার্য। মহান এই শিল্পস্রষ্টার শততম জন্মদিবস আগামী ২৯ ডিসেম্বর। সঙ্গত কারণেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে বর্ণাঢ্য উৎসব অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। এ উপলক্ষে মহাব্যস্ত এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্র্থীরা। অনুষদের প্রতিষ্ঠাতাকে স্মরণ করতে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হচ্ছে। অনেক বড় আয়োজন। ফলে শুরু থেকেই উৎসবমুখর ক্যাম্পাস। মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। লিচুতলাসহ বিভিন্ন স্থানে বাঁশের কাঠামো তৈরির কাজ চলছে। অনেকটা বৈশাখের প্রস্তুতির মতো। শিল্পীরা জানালেন, প্রতিটি শিল্পকর্মই হবে লোকজ ধারার। বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য, চারু ও কারুকলার বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো হবে গোটা ক্যাম্পাস। এর কারণ ব্যাখ্যা করে চারুকলার শিক্ষার্থী ফাহাদ হোসেন বলেন, জয়নুল আবেদিন বাংলাকে ভালবাসতেন। লোকজ সংস্কৃতির পূজারী ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। এ কারণেই ফোক মোটিভ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। চারুকলার ৮ বিভাগই ব্যস্ত এখন। আয়োজকদের পক্ষে মৃৎশিল্প বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আজহারুল ইসলাম শেখ চঞ্চল জানান, অনেক আগে থেকে জয়নুল জন্মশতবর্ষের প্রস্তুতি চলছে। টুকটাক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে। তবে বড়সড় আয়োজনটি শিল্পাচার্যের জন্মদিবস ২৯ ডিসেম্বর। দিবসটি সামনে রেখেই সব প্রস্তুতি চলছে। এখন কোন পর্যায়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রস্তুতি একেবারেই শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে চারুকলার ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ হয়েছে। বাকি কাজও দুই-একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তিনি জানান, চার দিনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে সোমবার থেকে। এ দিন সকালে ক্যাম্পাসের লিচু তলায় জয়নুল মেলার উদ্বোধন করবেন উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের দুটি কোরাস গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এর পর থেকে চলবে মেলা। আয়োজক সূত্র জানায়, অত্যন্ত আকর্ষণীয় হবে এ আয়োজন। এতে চারুকলা অনুষদের ৮ বিভাগ আলাদা আলাদা স্টল সাজাবে। বিভিন্ন অঞ্চলের লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শনসহ মেলায় অংশ নেবেন ওই সব অঞ্চলের জাতশিল্পী ও দোকানিরা। সন্ধ্যায় বকুলতলায় আয়োজন করা হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করবে ভিন্নধারার গানের দল জলের গান। একই রকম আয়োজন থাকবে দ্বিতীয় দিন শনিবার সন্ধ্যায়। এ দিন লালন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের গান পরিবেশন করবে শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। তৃতীয় দিন রবিবারের আয়োজনটি আরও বেশি আকর্ষণীয় হবে। এ দিন রাখা হবে জনপ্রিয় বাউল গানের পরিবেশনা। তবে উৎসব পূূর্ণতা পাবে চতুর্থ দিন। কারণ এ দিন ২৯ ডিসেম্বর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের শততম জন্মদিবস। এ দিনটিকে কেন্দ্র করেই এত এত আয়োজন। ফলে শতবর্ষ উদ্যাপনের দিনটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যাবে নানা কর্মসূচী। আয়োজকরা জানান, সকাল ১০টায় উদ্বোধনী সঙ্গীত দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠানমালা। চারুকলার শিল্পীরা গাইবেন দুটি সমবেত সঙ্গীত। এর পর সম্মাননা প্রদান ও আলোচনা পর্ব। অনুষ্ঠানে চারুকলা অনুষদের বার্ষিক প্রদর্শনী ও শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হবে। চারুকলার ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের অনেকেই ভাল গান করেন। তাঁদের মোটামুটি খুঁজে নেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে গাইবেন তাঁরা। তালিকাটিও বেশ দীর্ঘ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে শিল্পাচার্যকে জন্মদিনের শুভাশিষ জানাবেন ইসমেখার আহমেদ ও আফসানা হোসেন মুমু। নজরুলসঙ্গীতের মাধ্যমে অঞ্জলি জানাবেন ঋতুপর্ণা সরকার। লোকসঙ্গীত গাইবেন মেহেদী হাসান আরিয়ান ও বৈজয়ন্তী সরকার। অন্যদের মধ্যে থাকছেন- অধ্যাপক ড. রফিকুল আলম, আব্দুস সাত্তার, অধ্যাপক শেখ আফজাল হোসেন, অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক, তমা, সুব্রিতা অলকা, নাজনিন ইসলাম, আব্দুর রহমান নূর, শাওন দাস প্রণয়, মেহনাজ তাবাস্সুম অনন্যা, রুবাইয়া, নদী, সৌরভ বিশ্বাস, সিঞ্চি প্রমুখ। বিকেলের আয়োজনটিও হবে আকর্ষণীয়। এ পর্বে অংশ নেবেন চারুকলার পুরনোরা। দীর্ঘকাল পর তাঁরা পেছন ফিরে তাকাবেন। বলবেন হাসি আনন্দের স্মৃতি। এ পর্বের উপস্থাপক চিরসবুজ অভিনেতা আফজাল হোসেন। সন্ধ্যায় বসবে গানের আসর। এ পর্বে নাশিদ কামাল, কৃষ্ণকলিসহ জনপ্রিয় শিল্পরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। গাইবেন চারুকলার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া ব্যান্ড মেঘদল, বাউলা, তনুশ্রী ও মাস্টারব্যান্ড। এছাড়াও প্রত্যেক বিভাগ একটি করে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের আয়োজন করবে। এসব সেমিনারের মূল প্রবন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হবে জয়নুল আবেদিনকে। হবে বিস্তারিত আলোচনা। এভাবে উৎসবের আগেই উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা চারুকলায়। উল্লেখ করা যেতে পারে আরও বেশ কিছু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে জয়নুলের কাজের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে ছবি এঁকেছেন ১০০ শিল্পী। জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা ছবি নিয়েও আয়োজন করা হবে বিশেষ প্রদর্শনীর। তারও আগে মঙ্গলবার থেকে বেঙ্গল গ্যালারিতে শুরু হয়েছে জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নক্সিকাঁথার প্রদর্শনী। ময়মনসিংহেও বিশাল আয়োজনে উদ্যাপিত হচ্ছে জয়নুল জন্মশতবর্ষ। সব মিলিয়ে দারুণ একটি সময়। এভাবে সব সময় অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন জয়নুল আবেদিন- সকলের তাই প্রত্যাশা।
×