ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুন্দরবন ॥ কর্মব্যস্ত জাতিসংঘ দল

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

সুন্দরবন ॥ কর্মব্যস্ত জাতিসংঘ দল

রশিদ মামুন/ আহসান হাবিব হাসান সুন্দরবন থেকে ॥ সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি বনবিভাগ। সোমবার থেকে শুরু হওয়া বনবিভাগের জরিপ শেষ হতে অন্তত দুই মাস সময় প্রয়োজন হবে। অন্যদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ দল চারভাগে বিভক্ত হয়ে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করেছে। তাঁরা উদ্ভিদ, প্রাণী এবং বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করছে। ঝুঁকি হ্রাসে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করার কথা রয়েছে পর্যবেক্ষক দলের। আজ বুধবার নৌপরিবহন এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দুই সচিব ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসছেন। স্থানীয়রা বলছেন শুরুতে যা মনে করা হয়েছিল এখন সেই পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে না। তবে যেসব উদ্ভিদে ফার্সেন অয়েল লেগে গিয়েছিল তা কেটে ফেলছে বনবিভাগ। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে বনবিভাগ এবং স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠন কেটে রাখা লতা গুল্ম সুন্দরবনের ভেতর থেকে বের করে আনছে। এখনও কোথাও কোথাও তেল ভেসে উঠতে দেখা যাচ্ছে। জোয়ারে দেখা না গেলেও ভাটার সময় নদীর দুই পাড়ের গাছে তেল দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ পরিদর্শন দলের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, জাতিসংঘের অয়েল স্পিল রেসপন্স মিশনের প্রধান এ্যামেলিয়া ওয়ালটনস নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের দল মঙ্গলবার সুন্দরবনের মৃগামারি এবং বাদামতলা এলাকায় শ্যালা নদী ছাড়াও আটটি খাল পরিদর্শন করে। চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিনিধি দল বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করছে। প্রতিনিধি দল ওয়াইল্ড লাইফ, ম্যানগ্রোভ, জনসম্পদ, অয়েল স্পিলিং কন্ট্রোল এই চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। প্রতিনিধি দল ছড়িয়ে পড়া তেলের বৈজ্ঞানিক তথ্য এবং বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করেছে। এসব উপরকরণ পরীক্ষা নিরীক্ষার পরেই প্রকৃতপক্ষে এই দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের কতটুকু ক্ষতি করেছে এবং তা কাটিয়ে উঠতে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে পরামর্শ দেবেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে ঝুঁকি হ্রাসে কী কী করা যায় তাও সুপারিশ করবে এরা। জাতিসংঘের অগ্রবর্তী প্রতিনিধি দলের সুপারিশের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষক দলের প্রতিনিধিরা সুন্দরবন এসেছেন। তাঁরা আরও বিশদভাবে বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকে প্রতিনিধি দল বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে বিভিন্ন স্যাম্পল সংগ্রহ করেছে। নদী এবং বিভিন্ন খালের যেসব এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছিল সেসব এলাকায় বিভিন্ন উদ্ভিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এসব এলাকায় জল এবং স্থলে কোন কোন প্রাণী রয়েছে তাদের বর্তমান অবস্থা কী সে বিষয়েও খোঁজ নেন। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন। মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চাকপাই রেঞ্জে মতবিনিময় করেন। এতে সুন্দরবন সুরক্ষায় কী করণীয় তা তুলে ধরেন জনপ্রতিধিরা। ওই মতবিনিময়ে স্থানীয়রা বলছেন সুন্দরবনের স্বার্থেই সংরক্ষিত এই বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চরাচল সীমিত রাখা উচিত। দুর্ঘটনার পর পরই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বনবিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের উদাসীনতার কথাও জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেন স্থানীয়রা। তাঁরা বলছেন আরও আগে থেকে কাজ শুরু করলে ক্ষতির মাত্রা কম হতো। স্থানীয় সুন্দরবন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ প্রতিনিধি দলকে বলেন, শুরুতে ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হয়েছিল এখন ওই পরিমাণ ক্ষতি হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পরপর কার্যক্রম শুরু না করায় তেলের বিস্তার বেশি হয়েছে। ঘটনার দুই দিন পর স্থানীয়রা তেল সংগ্রহ করতে নামে। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলে এতটা ক্ষতি হতো না। চিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ রাসেল প্রতিনিধি দলকে জানান, যেহেতু সংরক্ষিত এলাকা তাই এই রুটে নৌযান না চলাচল করাই ভাল। যে কোন সংরক্ষিত এলাকাকে সংরক্ষণ করে রাখাই উচিত। বনবিভাগ সূত্র জানায়, সোমবার থেকে সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল সুন্দরবনের ওপর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ করছে। আগামী দুই মাস চারটি গোনে (ভরা জোয়ার-মন্দা জোয়ার) তথ্য সংগ্রহ করবে তদন্ত দল। এতে অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন নন্দবালা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান, আন্ধারমানিক টহলফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন এবং বনবিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ বিভাগের মহিজুর রহমান। জানতে চাইলে মেহেদী হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তা এখই বলা সম্ভব নয়। আমরা কেবল তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছি। দু’ মাসে চারটি গোনে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তিনি বলেন, আমরা উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করছি। ‘বায়োডায়ভার্সিটি মনিটরিং’ এর আওতায় এসব কাজ শুরু হয়েছে। কাজ শেষ হলে বলা সম্ভব হবে ছড়িয়ে পড়া তেলে কতটুকু ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, এখনও সেই অর্থে কোন জলজ প্রাণীর মৃত্যুর খবর আমরা পাইনি। মরাগোন থাকায় তেল বনের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ায় ক্ষতি কম হবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া বনবিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ মনিটরিং টিম শ্যালার আশপাশের এলাকায় কোন নির্দিষ্ট এলাকায় কি পরিমাণ গাছ এবং প্রাণীর ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণের চেষ্টা করছে। এতে নির্দিষ্ট এলাকায় কি পরিমাণ গাছ এবং প্রাণী আছে তা গণনা করা হয়েছে। ছড়িয়ে পড়া তেলে ওই নির্দিষ্ট এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণও করা হয়। তবে এসব বিষয় আরও সুনির্দিষ্ট করা হচ্ছে বলে বনবিভাগ জানায়। বনবিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা যতদূর দেখেছি শ্যালা নদীর ২৬ কিলোমিটার এবং সুন্দরবনের ২৫ থেকে ২৬টি খালের ১৬ কিলোমিটার ভেতরে বিস্তরভাবে তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে গোটা এলাকার একটি ম্যাপিং করছে বনবিভাগের ঢাকা কার্যালয়। স্থানীয় বনবিভাগের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে এসব তথ্য ঢাকায় পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে তেলযুক্ত পানি, লতাগুল্মও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যাবে ফার্নেস অয়েলের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কি হবে না হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের ওপর কি প্রভাব পড়বে। এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে সুন্দরবনের ভেতর থেকে ফার্নেস অয়েল লেগে থাকা লতাগুল্ম বের করে আনা হচ্ছে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে যাতে পুনরায় ফার্নেস অয়েলের রাসায়নিক ছড়িয়ে না পড়ে। বন বিভাগের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীরা এই কাজ করছেন। বনবিভাগের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, নদী এবং খালের পড়ে যেসব ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের শ্বাসমূলে ফার্নেস অয়েলে লেগে গেছে সেগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। স্বাভাবিকভাবে ওইসব গাছ খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে না। এছাড়া জলাশয়ের উপরিভাগে থাকা অনুজীবের খাদ্যগ্রহণ এবং বংশ বিস্তার বিঘিœত হবে। যাতে পুরো খাদ্যশাসন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। যা পুরো সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই প্রভাব সুন্দরবন কবে কাটিয়ে উঠতে পারবে তা নির্দিষ্ট করা জরুরী। ইতোমধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছিল এইসব এলাকায় বড় কোন প্রাণী দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয়রা বলছেন জলজ এবং বন্য উভয় ধরনের প্রাণীই অন্য এলাকায় সরে গেছে। এতে বনের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রাণীর বিচরণ বাধাগ্রস্ত হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন এই বনকর্মকর্তা।
×