ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

৫ জানুয়ারি সামনে রেখে অশুভ পাঁয়তারা

অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার নেপথ্যে জামায়াত

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

অস্থিরতা সৃষ্টি করে ফায়দা লোটার নেপথ্যে জামায়াত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আলোচিত ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে পরিকল্পিত অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আর এ অস্থিরতা সৃষ্টি প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি মহল ও কিছু সরকারবিরোধী মিডিয়া। নড়বড়ে সাংগঠনিক শক্তি নিয়েই সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে বিএনপি। আন্দোলন ঠেকাতে সরকারী দল আওয়ামী লীগও নিয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। বৃহৎ এ দু’দলের মুখোমুখি অবস্থার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী প্রস্তুতি নিচ্ছে বড় ধরনের নাশকতার। আর তৃতীয় শক্তি বলে খ্যাত অপর গ্রুপটিও ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করার অপেক্ষায়। ফলে ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে চতুর্মুখী এমন তৎপরতায় কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত দেশের সাধারণ মানুষ। ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা যে পূর্বপরিকল্পিত তা গত কিছুদিনের ঘটনা প্রবাহেই উঠে এসেছে। নির্বাচনে না এসে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি গত প্রায় একটি বছরই রাজপথের সামান্যতম আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। আগামীতেও বড় ধরনের আন্দোলন করার তেমন সাংগঠনিক শক্তিও গড়ে তুলতে পারেনি দলটির নীতিনির্ধারকরা। ঢাকাসহ সারাদেশে অগোছালো সংগঠন দিয়ে কঠোর আন্দোলন কতটা ফলপ্রসূ হবে এ নিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডই সন্দিহান। আর এটা নিশ্চিত জেনেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই হঠাৎ করে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিকৃতি ইতিহাস সংবলিত অসংযত বক্তব্য ও পুত্র তারেক রহমানের বঙ্গবন্ধুবিরোধী কটাক্ষমূলক বক্তব্য রাজনীতির মাঠকে উস্কে দিচ্ছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বাগ্যুদ্ধ, ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের পরস্পরকে দেখে নেয়ার হুমকি বছরের শেষ সময়ে এসে সার্বিক পরিস্থিতিকে কিছুটা হলেও উত্তপ্ত করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কথা বললে শাসক দল মাঠে নামবে, এতে রাজপথে সংঘাত-সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন সরকারবিরোধী আন্দোলনের ইস্যু পাওয়া সহজ হবে। এই পরিকল্পনা থেকেই বিজয়ের মাসে বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করে বক্তব্য রাখা হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতি সচেতনরা। তাঁদের মতে, এই পরিকল্পনা থেকেই একটি মহল ৫ জানুয়ারির আগে ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার প্রক্রিয়া চলছে। আর এ কাজে নেপথ্যে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মিডিয়াও। বিএনপি বা জামায়াতের আন্দোলনের বড় কোন প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও ওইসব মিডিয়াতে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যাতে ৫ জানুয়ারিতে বড় কিছু একটা ঘটবেই। এতে দেশের মানুষ উৎকণ্ঠিত হবে, সংঘাত-সংঘর্ষের পথ প্রশস্থ হবে এমন চিন্তা থেকেই সরকারবিরোধী অংশটি পরিকল্পিতভাবেই এসব করে যাচ্ছে। আগামী ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনের এক বছর পূর্তি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দিবসটিকে ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ হিসেবে পালনে নিয়েছে ব্যাপক কর্মসূচী। আর বিএনপি দিবসটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করতে চায়। ৫ জানুয়ারিতে ঢাকাসহ সারাদেশে জোটগতভাবে জনসভা ও বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ওইদিন ঢাকায় জনসভা করতে না পারলে ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা হরতাল করারও পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, ৫ জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ আগেই ঢাকাসহ সারাদেশে কর্মসূচী দিয়েছে। তাই ওই দিন কর্মসূচী পালনে তারা বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। ৫ জানুয়ারি পুলিশ ঢাকায় জনসভা করার অনুমতি না দিলে বা কর্মসূচী পালনে বাধা দেয়া হলে তাৎক্ষণিক হরতাল আহ্বান করা সহজ হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করা হবে। আর এবার আন্দোলনে ব্যর্থ হলে দলের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে। নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই এবার বড় আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামার চেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, দেশের সব ক্ষেত্রে যে অস্বস্তিকর অবস্থা চলছে, তাতে চুপ করে থাকার আর সুযোগ নেই। আমরা সরকারকে এক বছর সময় দিয়েছি। সরকার সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। সরকার আমাদের কথায় কোন কান দেয়নি, উল্টো অবমানকর বক্তব্য রাখছে। তাই দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আন্দোলনে নামার কোন বিকল্প নেই। এদিকে হাত গুটে বসে নেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। আর বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের হুমকিতে মোটেই ভীত নন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের নেতারা মনে করছেন, ৫ জানুয়ারিতে বিএনপি-জামায়াতকে মাঠেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিএনপি মূলত গণমাধ্যম ও বিদেশনির্ভর একটি দল। তারা আন্দোলনের দল নয়। বিএনপির আন্দোলনের হুমকি-ধমকি শুধুমাত্র গণমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে রাজপথে তাদের কোন অস্তিত্বই নেই। আর আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারিতে যেভাবে পুরো সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে, তাতে কোথাও তাদের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। জানা গেছে, ৫ জানুয়ারিকে সামনে রেখে জামায়াত-বিএনপি জোট রাজপথে যাতে কিছুই করতে না পারে সেজন্য বছরের শুরু থেকেই রাজপথ দখলে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে। সংসদের এক বছর পূর্তির দিন ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের মধ্য দিয়ে রাজপথ দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই দিন বিরোধী পক্ষের সহিংসতার আশঙ্কা মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক শো-ডাউন বা শক্তি-সমাবেশ ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানা গেছে, দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও মহানগরে অর্থাৎ ৩শ’ নির্বাচনী আসনেই ৫ জানুয়ারি বিজয় মিছিল, শোভাযাত্রা ও সমাবেশে সর্বোচ্চসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে দলের কেন্দ্র থেকে। এছাড়া ওইদিন ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও লাখ লাখ নেতাকর্মীর সমাবেশ ঘটিয়ে বড় ধরনের শো-ডাউন করারও পরিকল্পনা রয়েছে শাসক দলটির। এরপর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে জনসমুদ্রে পরিণত করে সাংগঠনিক শক্তির মহড়া দিতে চায় আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্র মতে, ঢাকার রাজপথ দখলে রাখতে ৫ জানুয়ারি সকাল থেকেই মাঠে থাকবে নগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই দিন ঢাকার প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন তথা ১৬টি নির্বাচনী আসনেই আলাদা আলাদাভাবে দিনভর বিজয় মিছিল, বিজয় শোভাযাত্রা ও সমাবেশ করবে তারা। মহানগর থেকে নির্বাচিত দলের সংসদ সদস্য ও সংশ্লিষ্ট ইউনিটের নেতারা কর্মসূচী সমন্বয় করবেন। শেষ বিকেলের দিকে পুরো মহানগরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা, ওয়ার্ড-থানা থেকে মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিলিত হয়ে কেন্দ্রীয় সমাবেশকে জনসমুদ্রে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছেন নগরের নেতারা। কর্মসূচী সফল করতে ইতোমধ্যে নগরের প্রতিটি ওয়ার্ড ও থানা কমিটির নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, গণতন্ত্রের বিজয় দিবসে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় বিজয় শোভাযাত্রা, মিছিল ও সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। এদিন সকালে ঢাকা মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ডে নেতাকর্মীরা শোভাযাত্রা ও বিজয় মিছিল করবে। বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এসব কর্মসূচী সফল করতে দলের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাঁরা সবাই কর্মসূচী সফল করতে কাজ করছেন। ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টা এসব কর্মসূচীর সিদ্ধান্ত নিলেও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত প্রস্তুতি নিচ্ছে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টির। বিএনপির মতো আস্তে আস্তে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন জামায়াত নেতারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে কোণঠাসা ও অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়া জামায়াত চাইছে শুরু থেকেই ব্যাপক ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ ও সহিংসতার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে কঠোর আন্দোলন করতে। গত বছরের ৫ জানুয়ারির মতো দেশে ভয়াল অবস্থা সৃষ্টি করতে যাতে সরকার পরবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পরিকল্পনা থেকেই সুযোগ বুঝে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে জামায়াত-শিবির। আগামী ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখবেন দলটির প্রধান খালেদা জিয়া। এদিকে তারেক রহমান জাতির কাছে ক্ষমা না চাইলে গাজীপুরসহ বিএনপি নেত্রী যেখানেই সমাবেশ করতে যাবেন, সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। পাল্টা জবাবে ছাত্রদল ঘোষণা দিয়েছে, ছাত্রলীগ যেখানেই পাওয়া যাবে গণধোলাই দেয়া হবে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের এই মুখোমুখি অবস্থানের সুযোগ নিয়ে জামায়াত-শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা জোটের মধ্যেই পরিকল্পিত নাশকতা চালিয়ে এ সরকারের ওপর দোষ চাপিয়ে ইস্যু সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাতে পারে। নাশকতা ও সহিংসতার তাণ্ডব চালিয়েই ৫ জানুয়ারির আগে থেকেই সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার গোপন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে জামায়াত। সবমিলিয়ে দেশের বর্তমান স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নতুন বছরের শুরুতেই অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এমন আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত দেশবাসী।
×