ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওষুধ তৈরি করছে ঝুঁকি তালিকার ২৯ কোম্পানি

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৪

ওষুধ তৈরি করছে ঝুঁকি তালিকার ২৯ কোম্পানি

নিখিল মানখিন ॥ ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অব্যাহত রেখেছে দেশের ২৯টি ওষুধ কোম্পানি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘উত্তম উৎপাদন কৌশল (জিএমপি)’ লঙ্ঘন করে ওষুধ তৈরি করছে কোম্পানিগুলো। এসব ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে পরিদর্শন চালিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দু’বছর এই কোম্পানিগুলো বন্ধের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অদ্যাবধি সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে কার্যক্রম চালু রেখেছে। বাকিগুলো নানা কৌশলে অব্যাহত রেখেছে তাদের উৎপাদন ও বিপণন। তবে ওই ২৯টিসহ মোট ৪৭টি ওষুধ কোম্পানিতে তৃতীয় দফার মতো পরিদর্শন কার্যক্রম চালাচ্ছে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটির পরিদর্শন টিম। আগামী জানুয়ারিতে পরিদর্শনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন টিমের সদস্যরা। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কঠোর হস্তক্ষেপে প্রশ্নবিদ্ধ ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আবার আলোচনায় চলে এসেছে। অভিযুক্ত ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তিনি। দেশের ৪৭টি ওষুধ তৈরির কারখানা পরিদর্শনে মাঠে আছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কর্তৃক মনোনীত বিশেষজ্ঞ দল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ টিম পরিদর্শন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক আ ব ম ফারুক শনিবার জনকণ্ঠকে জানান, কয়েক বছর আগে প্রথমে দেশের মোট ১৯৩টি ওষুধ কোম্পানিকে পরিদর্শনের আওতায় আনা হয়। প্রথম দফা পরিদর্শনের প্রাপ্তি প্রতিবেদন শেষে ৭৩টি কোম্পানিকে আরেকবার পরিদর্শন করার সুপারিশ করা হয়। ওই ৭৩টি কোম্পানির ওপর দ্বিতীয়বারের মতো পরিদর্শন চালানো হয়। দ্বিতীয় দফা পরিদর্শনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ৪৭টি কোম্পানিকে তৃতীয়বারের মতো পরিদর্শন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। চলতি মাসেই (ডিসেম্বর) পরিদর্শনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সঠিক সময়ে সম্পন্ন হয়নি পরিদর্শন কার্যক্রম। পরবর্তীতে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে পরিদর্শনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময়সীমা বেঁধে দেয় সংসদীয় কমিটি। প্রতিবেদন জমা দেয়া ছাড়া কোন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন টিমের হাতে নেই বলে জানান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ১০ আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় তৃতীয়বারের মতো পরিদর্শন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সাব-কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন অনুযায়ী তৃতীয় ক্যাটাগরির ২৯টি, চতুর্থ ক্যাটাগরির একটি ও পঞ্চম ক্যাটাগরির ১৭টিসহ মোট ৪৭টি এবং প্রয়োজন মনে করলে প্রথম ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরির আরও ২৬টি কারখানার যে কোনটি পরিদর্শন করার ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ দলের থাকবে। ওষুধ তৈরির কারখানা বিশেষজ্ঞ দল পুনরায় পরিদর্শন করবে। প্রথম ও দ্বিতীয় ক্যাটাগরির কোম্পানিসহ অন্য যে কোন কোম্পানির কারখানা তারা পরিদর্শন করতে পারবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের প্রচলিত মান অনুসরণ করে এসব কোম্পানি ওষুধ প্রস্তুত করছে কিনা এবং আগের পরিদর্শনের পর যে নির্দেশনা দেয়া হয়, তা মানা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে এ বিশেষজ্ঞ দল। বিশেষজ্ঞ দলকে সহায়তা করছেন ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক আলতাফ হোসেন, ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির এ্যানালিস্ট এবি সিদ্দিক এবং মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি। তাঁরা পরিদর্শনের সময় উপস্থিত থাকবেন বলে জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে এ্যাডফ্লেম ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে দেশে ৭৬ শিশুর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। নবম সংসদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এতে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কমিটি উল্লেখ করে, দেশে তৈরি ওষুধ রফতানি হচ্ছে। অথচ দেশী সিরাপ খেয়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এতে স্থায়ী কমিটি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই কমিটির সদস্যরা ২০১০ সালে দেশের ১৯৩টি ওষুধ তৈরির কারখানা পরিদর্শন করেন। সে সময় কোম্পানিগুলো গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) অনুসরণ করে ওষুধ তৈরি করছে কিনা, তা সরেজমিনে দেখার জন্য যান। তাঁরা ৭৩টি কোম্পানির কারখানায় নানা ত্রুটি খুঁজে পান। বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ৭৩টি ওষুধ কোম্পানিকে পাঁচটি ধাপে ভাগ করে। প্রথম ধাপে তিনটি কোম্পানি পেনিসিলিন, সেফালোস্পোরিন ও এ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ছাড়া সব ধরনের ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে। দ্বিতীয় ধাপে ২৩টি কোম্পানির সমস্যা দূরীকরণের শর্তে এ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে, তৃতীয় ধাপে ২৯টি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ ঝুঁকিপূর্ণ, চতুর্থ ধাপে একটি প্রতিষ্ঠান সমস্যা সমাধানের পর প্রাণী চিকিৎসার ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে ও পঞ্চম ধাপে ২৭টি কোম্পানির কারখানা পরিদর্শন করা হয়নি এবং কোন সুপারিশও করা হয়নি। বিশেষজ্ঞ কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলেও এসব কোম্পানির ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ উৎপাদকারী ২৯টি কোম্পানি হচ্ছে : অয়েস্টার ফার্মা লি., রয়েল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., এজটেক ফার্মাসিউটিক্যালস লি., বেঙ্গল টেকনো ফার্মা লি., ব্রিস্টল ফার্মা লি., ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ওয়েসিস ল্যাবরেটরিজ লি., ফার্মিস ল্যাবরেটরিজ লি., রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., রেমো ফার্মাসিউটিক্যালস লি., স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ লি., ইউনিভার্সাল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., এবলেশন ল্যাবরেটরিজ লি., বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস লি., জালফা ল্যাবরেটরিজ লি., মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ লি., নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., প্যারাডাইজ ফার্মা লি., কোয়ালিটি ফার্মাসিউটিক্যালস লি., স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস লি., সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইউনিক ফার্মাসিউটিক্যালস লি., এভার্ট ফার্মা লি., বেলসন ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এবং সেইভ ফার্মাসিউটিক্যালস লি.। উন্নয়নের শর্তারোপ করা ২৩ কোম্পানি : মোট ২৩টি কোম্পানি সমস্যাসঙ্কুল। এদের উন্নতি করতে হবে। এগুলো হচ্ছে- কুমুদিনী ফার্মা লি., ম্যাকস ড্রাগস লি., মার্কসম্যান ফার্মাসিউটিক্যালস লি., অর্গানিক হেলথকেয়ার লি., এপিসি ফার্মা লি., বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যালস লি., সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ক্রিস্টাল ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ডিসেন্ট ফার্মা লি., দেশ ফার্মাসিউটিক্যালস লি., গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যালস লি., মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যালস লি., প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লি., প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যালস লি., সীমা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., সিলকো ফার্মাসিউটিক্যালস লি., সিনথো ল্যাবরেটরিজ লি., ইউনাইটেড কেমিক্যালস এ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লি., হোয়াইট ফার্মাসিউটিক্যালস লি., বেঙ্গল ড্রাগস ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইলিক্সার ফার্মাসিউটিক্যালস লি., গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এবং মমতাজ ফার্মাসিউটিক্যালস লি.। পরিদর্শন না করা ১৭ কোম্পানি : এমিকো ল্যাবরেটরিজ লি., মিসটিক ফার্মাসিউটিক্যালস লি., স্যালটন ফার্মাসিউটিক্যালস লি., এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যালস লি., এলকাড ফার্মাসিউটিক্যালস লি., কসমো ফার্মাসিউটিক্যালস লি., স্কাইর‌্যাব ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইউনিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস লি., মেফনাজ ফার্মা লি., বসকো ল্যাবরেটরিজ লি., সিটি ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ড্রাগল্যান্ড লি., কাফমা ফার্মাসিউটিক্যালস লি., মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যালস লি., রিড ফার্মাসিউটিক্যালস লি. এবং আলট্রা ফার্মাসিউটিক্যালস লি.। অবশিষ্ট ৪ কোম্পানি : সংসদীয় টিমের পরিদর্শন শেষে ৩টি কোম্পানি পেনিসিলিন, সেফালোস্পোরিন ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ছাড়া সব ওষুুধ উৎপাদন করতে পারে বলে জানানো হয়। এই কোম্পানিগুলো হলোÑ রেমিডি ফার্মাসিউটিক্যালস লি. (বর্তমান নাম ডক্টর টিমস ফার্মাসিউটিক্যালস লি.), প্রতীতী ফার্মাসিউটিক্যালস লি. (বর্তমান নাম এসট্রা বায়োফার্মাসিউটিক্যালস লি.) এবং সামসুল আলামিন ফার্মাসিউটিক্যালস লি. (বর্তমান নাম মার্কার ফার্মাসিউটিক্যালস লি.)। এছাড়া এফএনএফ ফার্মাসিউটিক্যালস নামক একটি কোম্পানিকে মানুষের সেবনযোগ্য ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি না দেয়ার সুপারিশ করা হয়। বলা হয়, এই কোম্পানিটি কেবলমাত্র ভেটেরিনারি আইটেম উৎপাদন করতে পারবে। এদিকে, নিম্নমানের ওষুধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস অব হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ রশিদ ই-মাহাবুব জনকণ্ঠকে জানান, দেশে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বাড়াতে হবে মনিটরিং কার্যক্রম। পরীক্ষার আওতার বাইরে থাকা ওষুধগুলো অবশ্যই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। পাশাপাশি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের জনবল ও কার্য দক্ষতাও বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, যে কোন ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ গ্রহণ করাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
×