ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শ্যালা ও সংলগ্ন খালে অক্সিজেনের অভাব, মরছে জলজ প্রাণী

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২২ ডিসেম্বর ২০১৪

শ্যালা ও সংলগ্ন খালে অক্সিজেনের অভাব, মরছে জলজ প্রাণী

বাবুল সরদার, বাগেরহাট থেকে ॥ সুন্দরবনে অয়েল ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রতিক্রিয়ায় শ্যালা নদী ও আশপাশের খালগুলোর পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রার অক্সিজেন নেই। ওই দুর্ঘটনায় সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে নদী-খালের পানিতে অণুজীব বা জুয়োপ্লাংনটন/ফাইটোপ্লাংকটন কমে গেছে। এ অবস্থায় এ পানিতে জলজ প্রাণীর বাস করা কষ্টকর বা দুঃসাধ্য। যার প্রভাব কম হলেও এখানে জলজ প্রাণীর ওপর পড়ছে। কাঁকড়া, পোনা মাছ, ছোট মাছ এখানে এ তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে প্রচুর পাওয়া যেত। এখন আর তা মিলছে না। যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। তেলের বিষক্রিয়ায় উদবিড়াল, ভোঁদড় এমনকি গুইসাপও মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনা স্থলের অদূরে আন্ধারমানিক এলাকায় দুটি মৃত ভোঁদড় পাওয়া গেছে। যা ময়নাতদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তেল মিশ্রিত পানি পান করেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় শ্বাসমূলীয় এই বনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙ্গে গেছে। এর ফলে বনের খাদ্যচক্রের প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ ক্ষুদ্র প্রাণী ও উদ্ভিদ কণা মারা যাচ্ছে। এখন তারই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সুন্দরবনের প্রাণী এবং উদ্ভিদ আশঙ্কামুক্ত।’ এদিকে রবিবার বিকেলে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকলভুক্ত আন্তর্জাতিক নৌরুটের বাগেরহাটের মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল দ্রুত খননের দাবিতে চ্যানেলের কুমারখালী এলাকায় নদী তীরে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন সংগঠনসহ এলাকাবাসী হাজার হাজার নারী-পুরুষ। এলাকাবাসীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ বিকল্পধারা, কারিতাসসহ অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ওয়াইল্ড লাইফ) জাহিদুল কবির সাংবাদিকদের জানান, ‘শ্যালা নদীতে ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনায় ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় বন্যপ্রাণীর উপর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে বলে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, তা পড়েনি। তবে কিছু প্রাণী মারা গেছে। গত বৃহস্পতিবার দুটি মৃত ভোঁদড় পাওয়া গেছে। এগুলো ময়নাতদন্ত করে দেখা গেছে, তেলমিশ্রিত পানি পান করেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া কাঁকড়া, ছোট মাছ মরেছে। কিছু পাখি, সাদা বকের শরীরে, গুইসাপ এবং কুমিরের গায়ে তেলের দাগ দেখা গেছে।’ তবে এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তেল অপসারণ করা চলছে, সার্বিক পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে পর্যবেক্ষণ করা হবে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ জাহিদুল কবীর রবিবার বিকেলে বলেন, সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর আমাদের বিভাগ বন্যপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানকে নিয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর আমাদের একটি দল সুন্দরবনে যায়। সেখানে গিয়ে শ্যালা নদীর আন্ধারমানিক এলাকায় দুটি বন্যপ্রাণী নদীর জলে ভাসতে দেখে বনকর্মীরা তা তুলে উপরে নিয়ে আসে। মৃত ভোঁদড় দুটির শরীরে ফার্নেস অয়েল লেগে ছিল। বন্যপ্রাণী দুটি উদ্ধার হওয়ার অন্তত দুই তিন দিন আগে মারা গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। পরে তা আমরা সংরক্ষণ করে বন্যপ্রাণী দুটির মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে পরীক্ষাগারে নিয়ে আসি। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চিকিৎসক (ভ্যাটেরিনারি সার্জন) সৈয়দ হোসেন শুক্রবার ওই প্রাণী দুটির ময়নাতদন্ত করেন। তেল মিশ্রিত জলপান করে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি প্রতিবেদন দিয়েছেন। এই মারা যাওয়া বন্যপ্রাণী দুটি প্রাপ্ত বয়স্ক। এরা নদীর মাছ শিকার করে জীবন ধারণ করে থাকে। তারা যখন মাছ শিকার করছিল তখন ওই নদীর জলে তেল ভাসছিল। ওই তেল মিশ্রিত মাছ ও জল পান করে বন্যপ্রাণী দুটির মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসক নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের যেসব এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে সেসব এলাকায় তেল মিশ্রিত জলপান করে সুন্দরবনে বসবাস করা অন্য কোন বন্যপ্রাণী অসুস্থ বা মারা গেল কিনা তা অনুসন্ধান (পর্যবেক্ষণ) করতে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তিনটি দল কাজ করছে। ছড়িয়ে পড়া তেলে সুন্দরবনে বসবাস করা বাঘ, হরিণ, শুকর বা পরিযায়ী (অতিথি পাখি) পাখির কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা অনুসন্ধান করতে আমাদের একাধিক দল কাজ করছে। আমরা এখনও সুন্দরবনের নদী-খালে ছড়িয়ে পড়া তেল বন্যপ্রাণীর শরীরে লেগে আছে এমনটি দেখতে পাইনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় এক লিটার পানিতে ৯ মিলিগ্রাম অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকতে হয়। কিন্তু সুন্দরবনের তেল ছড়িয়ে পড়া শ্যালা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ এখন গড়ে প্রতি লিটারে ৪ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম, যা প্রাণীকূলের জন্য হুমকিস্বরূপ। গত ১৬ ডিসেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের অধীনে একদল শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছে।
×